শুক্র ও শনিবার ঢাকার তেজগাঁওয়ের একটি কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দুইদিনব্যাপী খাদি কাপড় থেকে তৈরি পোশাকের ফ্যাশন শো। ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল (এফডিসিবি) ‘খাদি উৎসব ২০২৪’ এ আয়োজনটি করে। অনুষ্ঠানটি নিয়ে নয় বরং এ লেখাটি এবারের প্রতিপাদ্য ‘খাদি: দ্য ফিউচার ফেব্রিক শো’- স্লোগানটি নিয়ে। সুলুক সন্ধানের চেষ্টা হয়েছে খাদি কাপড়ের সত্যিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে।
নাটাই ঘুরানোর মতো চরকায় কাটা কার্পাস সুতায় বানানো মোটা কাপড় হলো খাদি। খাদ হতে নাকি খাদি নামকরণ হয়েছে। কীভাবে?
মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনে এই চরকায় বোনা কাপড়ের চাহিদা বাড়তে থাকে। বাড়তি চাহিদা মেটাতে দ্রুত তাঁত চালানোর জন্য পায়ে চালিত প্যাডেলের নিচে মাটিতে গর্ত করা হয়। গর্ত মানে খাদ। আর এই খাদ থেকে হলো খাদি। আবার অনেকে বলেন, মহাত্মা গান্ধীর দেওয়া নাম খদ্দর থেকে খাদি শব্দটি এসেছে। তিনি গুজরাটের ছিলেন, তাই খদ্দর শব্দটি গুজরাট হতে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। কাপড়ের অমসৃণ ধরনকে মহাত্মা গান্ধী খাদি বলেছিলেন।
খাদিতে আরাম
সুতি, রেশমি আর পশমি সুতা মিশিয়ে হাতের বুননের শৈলী মিলে হয় খাদি। প্রথমে হাতে কেটে কার্পাস তুলোর গোলা থেকে বানানো হয় সুতা। এরপর ওই সুতা থেকে হাতে চালানো তাঁতে বোনা হয় খাদি কাপড়। বাকি তাঁত থেকে খাদি এখানেই আলাদা তাই।
বিশেষজ্ঞদের কাছে খাদি পরিবেশ-বান্ধব। খাদি কাপড় অনেকটা মোটা হয় এবং দীর্ঘদিন পরলেও সহজে ছেঁড়ে না। শার্ট, পাঞ্জাবি, কামিজ, কোটি অথবা শাড়ি যাই হোক, গরমে খাদি কাপড়ের পোশাক শরীর শীতল রাখবে; শীতে দেবে উষ্ণতা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই খাদি পরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হবে।
খাদির ইতিহাস
সতের শতকের দিকেও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে খাদি কাপড়ের বোনা হতো। হাতে বোনা খাদি কাপড় ভারতের গুজরাটে সবরমতী আশ্রমে প্রথম বানানো হয়েছিল ১৯১৭ কি ১৯১৮ সালে। এখন এখানে খাদি তৈরিতে গান্ধীর ব্যবহৃত চরকাটি রাখা আছে। দারিদ্র বিমোচন থেকে ব্রিটিশ হঠাও আন্দোলনে এই চরকা হয়েছিল তার মূল হাতিয়ার। ‘মোটা কাপড়, মোটা ভাত’ স্লোগানের মোটা কাপড় হলো এই খাদি।
১৯১৮ সাল থেকে খাদি আন্দোলন সূচনা হয়। এরমধ্যে যা একশ বছর পার করেছে।
পরে স্বদেশি আন্দোলনে নিখিল ভারত তন্তুবায় সমিতির শাখা হিসেবে কুমিল্লার অভয়াশ্রম, চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘ ও নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমে খাদি বোনা আরও বেগবান হয়। ১৯২৭ সালে ভারতের কলকাতায় সোদপুরে খাদি প্রতিষ্ঠানে কলা শাখা উদ্বোধন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী; এই আশ্রম তার ‘দ্বিতীয় বাড়ি’ হয়ে উঠেছিল।
সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর কুমিল্লার খাদিবাবু শৈলেন্দ্রনাথ গুহ চান্দিনার খাদি বিকাশে বড় অবদান রেখেছেন। ১৯৯৫ সালে দেশে এই ’খাদির জনক’ মারা গেলে ছেলে বিজন গুহ ও অরুণ গুহ গ্রামীণ খাদি প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন।
খাদি গায়ে যারা
সাদামাটা মহাত্মা গান্ধী খাদির চাদর পরতেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে জি-২০ সম্মেলনে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের গলায় হাতে বোনা অফ-হোয়াইট রঙের হাতে বোনা খাদি চাদর জড়িয়ে দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ভারতে ২০০২ সালের পতাকা আইনে শুধু খাদি কাপড়েই জাতীয় পতাকা বানানোর অনুমতি ছিল। পরে অবশ্য ২০২১ সালের সংশোধনীতে খাদির সঙ্গে সুতি, পলিয়েস্টার, রেশমি-পশমি কাপড়ের অনুমতিও দেওয়া হয়।
পশ্চিমবঙ্গের বিট্রিশ বিরোধী বিপ্লবী মাতঙ্গিনী হাজরা অনেকের কাছে ’গান্ধী বুড়ি’ নামে পরিচিত। তিনি গান্ধীবাদে সমর্থন দিয়ে চরকা যোগে খাদি বুনতেন এবং নিজে খাদি পরতেন।
বঙ্গবন্ধু এক সময় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকার নিউ লাহোর টেইলার্স থেকে খাদি কাপড়ের মুজিব কোট বানিয়ে পরতেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ১০০ রকমের মুজিব কোট সেলাই করেছিলেন ডিজাইনার বদরুন নাহার রক্সি। পাট, জামদানি, মসলিন, বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতের পাশাপাশি তিনি খাদির কাপড়ও বেছে নিয়েছিলেন।
২০২১ সালে ২৬ ও ২৭ মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফর করেন। ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী সংস্কৃতি কেন্দ্র ওই সময় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে একশটি মুজিব কোট বানাতে প্রস্তাব করে।
ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনের পিআইবির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই মুজিব কোট পলি খাদি ফেব্রিক দিয়ে তৈরি। কালো রংয়ের মুজিব কোটে ছিল ছয়টি বোতাম এবং সামনে নিচের দিকে দুটি পকেট।
ভারতের খাদি অ্যান্ড ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ কমিশন (কেভিআইসি) একশটি মুজিব কোট সরবরাহ করে।
২৬ মার্চ মুজিব কোট পরে প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত হন এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন নরেন্দ্র মোদী। তার সফরসঙ্গীদের পরনেও ছিল খাদির মুজিব কোট।
দেশে খাদি কারিগর
মুরাদনগরের সাঁইচাইল ও চান্দিনার বেলাশ্বর সহ পুরো কুমিল্লাজুড়ে এক হাজার পরিবার খাদি কাপড় তৈরি করতো। স্বাধীনতার পর দেবিদ্বারের বরকামতায় ৫০টি পরিবার সাঁইচাইল থেকে এসে খাদি কাপড় বানাতো।
এখন এই তিন গ্রামের মোটে সাত পরিবার খাদি কাপড় উৎপাদন কাজে জড়িত আছে।
তুলার উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি কমে এসেছে জনবলও। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে ১২ থেকে ১৫ গজ খাদি কাপড় তৈরির পর কারিগর মজুরি পান ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। কম পারিশ্রমিকের কারণে অনেকেই এই পেশাবিমুখ হয়ে পড়ছেন।
খাদির চরকা কি চলে?
আগামী ৫০ বছর বহাল তরিয়তে টিকে এমন একটি চরকা বানিয়েছে ভারত। ৪২ জন শ্রমিকের পরিশ্রমে ৫৫ দিনে শেষ হয় এই চরকা বানানোর কাজ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ চরকার ওজন চার টন। বানানো হয়েছে সেগুন কাঠে। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের তিন নম্বর গেটে চরকাটি বসানো হয়। সেগুন কাঠে বানানো এই চরকার ওজন চার টন, প্রস্থ ৯ ফুট, উচ্চতা ৯ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট।
ফ্যাশনে ফিরছে খাদি?
আগে খাদি মানে ছিল শুধু সাদা ও মেটে রঙের কাপড়। পাঞ্জাবি ও কোটি বানানো হতো খাদি দিয়ে। এখন খাদির শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়াও পাওয়া যাচ্ছে। খাঁটি সুতি, লিলেন, সিল্কের পোশাকের চেয়ে খাদি কাপড়ে বানানো পোশাকের দামও কম পড়বে।
ডিজাইনার এবং মডেল বিবি রাসেল ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে দেশীয় ঐতিহ্য জামদানি, মসলিন, চেক এবং খাদি কাপড়ের জনপ্রিয়তা বাড়াতে জোর দেন।
আগে ৪০ ও ৬০ কাউন্টে খাদি বোনা হতো। এখন বাংলাদেশে ৮০ থেকে ১০০ কাউন্ট দিয়েও খাদি কাপড় বোনা হয়। এতে মোটা খাদি ছাড়াও নরম ও মিহি খাদি কাপড়ের পোশাক করা যাচ্ছে।
ফ্যাশন বাজারে খাদি ডেনিম জিনস চলে এসেছে। বিয়েতে খাদি কাপড়ের লেহেঙ্গাও বেছে নিচ্ছেন ফ্যাশনে উৎসুক কনে।
কিন্তু দেশে এখন অধিকাংশই মেশিনে তৈরি সুতা দিয়ে মেশিনে বোনা কাপড়। একে খাদি বলা যায় না।
কুমিল্লার ‘হাতে বোনা খাদি শিল্পের বাজার সম্প্রসারণ ও সক্ষমতা উন্নয়ন’ প্রকল্প পরিচালক শেখ মাসুদুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে জানান, প্রথাগতভাবে খাদি বোনা নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বা বার্ড।
তিনি বলেন, “আমরা তুলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে তুলা নিয়ে আসি। চান্দিনায় আমরা নারীদের দিয়ে তুলা থেকে সুতা বোনার কাজ করি। এখানে বড়কামতা গ্রামে কয়েকটা পরিবার এখনও ‘খাদে’ বসে প্রথাগতভাবে খাদি কাপড় বানায়। আমরা মহিলাদের হাতে সুতা তৈরি করে তা থেকে খাদি কাপড় বানানো শুরু করেছি।”
“এখন অনেক খাদি আছে; কিন্তু যেটা হয় নরসিংদী থেকে সুতা এনে মেশিন দিয়ে বোনে। এখানে আরও বিষয় আছে, শ্রমিক পাওয়া যায় না, মূল্য পাওয়া যায় না। আমরা এসবের মধ্যে দেখতে চাচ্ছি আমাদের প্রক্রিয়ায় খাদি বাজারে কেমন টেকসই হয়। সামনে আমরা হয়ত একটা সেমিনার করে পুরো বিষয়টা আদ্যোপান্ত তুলে ধরবো। আমরা শাড়ি, মেয়েদের আরও পোশাক করছি খাদি কাপড়ে। প্রায় সতেরো ধরনের খাদি উপকরণ নিয়ে এগোচ্ছি আমরা।”
“আমাদের এখানে প্রথাগত তাঁতীরা তো কাজ করতেনই। স্বদেশী আন্দোলনের সময় কুমিল্লারি এদিকে মহাত্মা গান্ধী সরাসরি এসেছিলেন। তিনি এখানে তাঁতিদের নতুন ভাবে উজ্জীবিত করেন। ১৯৪৭ সালের পর বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান খাদি শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি ভারত থেকে অম্বর চরকা নিয়ে আসেন।”
“মেশিনে কাপড়, রেডিমেড কাপড় নির্ভরতা বেড়ে গেলে খাদি ও এমন হাতে বোনা কাপড়ের পোশাকের ব্যবহার কমে এলো। কিন্তু খাদির প্রতি সেন্টিমেন্ট ঠিকই ব্যবহার হতো; কাপড় যাই হোক বলা হতো এটি খাদি।”
“মেশিনে বোনা কাপড়ে হাত দিলে পার্থক্য বোঝা যাবে; রেডিমেট সুতা থেকে কাপড় একটু শক্ত ধরনের হবে। পুরোপুরি হাতে বানানো খাদি বেশ মোলায়েম হয়।”
“আমাদের দেশে মহিলারা যারা দীর্ঘদিন বোনে নাই তারা হঠাৎ করে ৪০ বা ১০০ কাউন্ট বানাতে পারবে না। একটু সময় লাগবে। তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এখন ২০ বা ৩০ কাউন্ট হলে সেটা কিন্তু খারাপ না। একটু মোটা হবে। এই কাপড়ে শাল করা যাবে।”
“আমরা চাই আদি গৌরব ফিরে আসুক। আজকাল তরুণ প্রজন্মও খাদি কাপড় খুঁজছে।”
“এখানে আমরা ৬০-৭০ জন মহিলা নিয়ে কাজ করছি। আট-১০ দশ কারিগর, দুটো পরিবার দুটো তাঁতে বোনে। আমরা মেশিন ছাড়া কাজ করছি। চরকাতে কাজ করছি।”
“একজন লোক আট থেকে ১০ গজ বোনে এক দিনে। মহিলারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড়াইশো থেকে ৫শ গ্রাম সুতা বোনে তুলা থেকে। মেশিনে যদি ১০ টাকা গজ হয়, তাহলে হাতে বুনলে খরচ হবে ৪০-৫০ টাকা। খাদি কাপড়ের মানে কোনো ছাড় দিচ্ছে না বার্ড। যদিও আমরা অলাভজনক ভাবে কাজ করছি।”