এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার পর খাগড়াছড়িতে আবার সংঘর্ষ বেধেছে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন।
আগের সহিংসতার তদন্ত চলার মধ্যে মঙ্গলবার খাগড়াছড়িতে আবার সংঘাত ঘটল।
নিহত আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোহেল রানা খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিল্ডিং মেইনটেন্যান্সের ইন্সট্রাক্টর ও সিভিল কন্সট্রাকশন অ্যান্ড সেফটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।
বাঙালি এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে পাহাড়ি শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা ছিল। সেই মামলায় খালাস পেয়ে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরার পর তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলছিল।
এরমধ্যে মঙ্গলবার আবার আরেক ত্রিপুরা শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের উদ্দেশ্যে আটকে রাখার অভিযোগ তুলে তার ওপর হামলা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এক ত্রিপুরা শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা সোহেল রানাকে ব্যাপক মারধর করে। তাকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি জেলা আধুনিক হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. রিপল বাপ্পি চাকমা সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই সোহেল রানার মৃত্যু হয়।
কেন গণপিটুনি
খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি আবদুল বাতেন মৃধা সাংবাদিকদের বলেন, “সোহেল রানা সম্প্রতি চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা তার বিরূদ্ধে বিক্ষোভ করে আসছিল। আজ এক ত্রিপুরা ছাত্রীকে আটকে রেখে ধর্ষণ করার অভিযোগে শিক্ষার্থীরা গণপিটুনি দেয় তাকে।”
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী উক্যনু মারমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “সোহেল রানা সকাল ৯টার দিকে সপ্তম শ্রেণির এক ত্রিপুরা ছাত্রীকে তার কোয়ার্টারে ডেকে নিয়ে যান। এটা তার সহপাঠীরা দেখে ফেলে এবং আমাদের জানায়। আমরা বেশ কয়েকজন কলেজে উপস্থিত হয়ে অধ্যক্ষের কাছে যাই মেয়েটির খোঁজ নিতে।
“সেখানে পুলিশ ও প্রশাসনের উপস্থিতিতে আমরা মেয়েটিকে ওই শিক্ষকের রুম থেকে উদ্ধার করি। মেয়েটি জানায় যে ওই শিক্ষক তাকে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছেন। তখন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষকের ওপর চড়াও হয় এবং তাকে মারধর করে। এই ঘটনার জের ধরে সেখানকার সেটলার বাঙালিরা আমাদের ওপর হামলা চালায়।”
কলেজটির অধ্যক্ষ আমান উল্লাহ আল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, “আজ সকাল ১১টার দিকে কলেজ ক্যাম্পাসে আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন শিক্ষক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সোহেল রানার ওপর হামলা করে। আহত অবস্থায় তাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।”
কেন ওই শিক্ষককে মারধর করা হয়েছে- েসই প্রশ্নে তিনি বলেন, “তাকে কেন মারধর করা হয়েছে, সেটা জানি না।”
আগেও অভিযোগ ছিল সোহেল রানার বিরুদ্ধে
খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি আবদুল বাতেন সাংবাদিকদের বলেন, কয়েক বছর আগে সোহেল রানার বিরূদ্ধে এক পাহাড়ি ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা হয়েছিল। তবে ওই কিশোরী আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে বলে যে পাহাড়ি একটি সংগঠনের চাপে সে মামলা করেছে। এরপর সোহেল রানা খালাস পান এবং চাকরিতে পুনরায় যোগ দেন।
সোহেল রানা ২০১৮ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর হোসেনাবাদ টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কর্মরত থাকাকালেও তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। এরপর তাকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়।
প্রশাসনকে দায়ী করে বিবৃতি
ইউপিডিএফ সমর্থিত দুই নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য নারী সংঘ এক যৌথ বিবৃতিতে শিক্ষক সোহেল রানাকে পুনর্বহাল করে ঘটনাটি এত দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে দায়ী করেছে।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান বলেন, খাগড়াছড়িতে আজকের ঘটনার জন্য প্রশাসন কোনও অবস্থাতেই দায় এড়াতে পারে না।
বিবৃতিতে বলা হয়, “খাগড়াছড়ি সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা গেল ৫ সেপ্টেম্বর ধর্ষক সোহেল রানাকে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পুনঃনিয়োগের প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল করে। ইতিপূর্বে কুষ্টিয়ায় থাকাকালে তার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের গুরুতর অভিযোগ ছিল, সাজাস্বরূপ তাকে বদলি করা হয়।
“২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সোহেল রানা এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের (পাহাড়ি-বাঙালি) প্রবল প্রতিবাদের মুখে তার সাজা হয়। পরে সাজামুক্ত হয়ে একই প্রতিষ্ঠানে পুনঃনিয়োগ লাভ করলে তার প্রতিবাদে আবারও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ডিসি বরাবর স্মারকলিপি দেয়। তা সত্ত্বেও তাকে পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়।”
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা বাঁধানোর চেষ্টা হচ্ছে বলেও দাবি করেন নীতি ও কনিকা।
ভাংচুর-সংঘর্ষ, ১৪৪ ধারা
সোহেল রানা মারা যাওয়ার পর পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। প্রথমে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন কক্ষ ও আসবাবপত্র ভাংচুর হয়।
এরপর জেলা শহরে পাহাড়ি-বাঙালি শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। চেঙ্গী স্কয়ার, মহাজন পাড়ায় সংঘর্ষে ১৫-২০ শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। হামলায় আহত এক পাহাড়ির পিঠে ধারাল অস্ত্রের জখমের চিহ্ন দেখা গেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে খাগড়াছড়ি শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে বলে জানান খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান।
থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে তিনি বলেন, শহরজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
রাঙ্গামাটিতেও আতঙ্ক
খাগড়াছড়ির ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পাশের পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি শহরেও। জেলা শহরের বিজন সরণী থেকে কল্যাণপুর এলাকা পর্যন্ত পাহাড়ি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় মঙ্গলবার দুপুরেই।
তবে শহরজুড়ে মোতায়েন রয়েছেন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। শহরে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর টহল দেখা গেছে।
রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সাইফুল ইসলাম বলেন, “খাগড়াছড়ির ঘটনায় কিছু সময়ের জন্য রাঙামাটির কিছু এলাকায় অনেকে আতঙ্কে দোকানপাট বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে আমরা হ্যান্ড মাইকিংয়ে আশ্বস্ত করায় অনেকে দোকানপাট খুলেছেন। রাঙ্গামাটি শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।”
রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, “শহরের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি করার মতো পরিবেশ এখানে নেই।”
গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি শহরের পানখাইয়া পাড়ায় মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যার পরও জেলা শহর ও দীঘিনালায় সংঘর্ষ বেধেছিল। সহিংসতার মধ্যে পরদিন তিনজন নিহত হয়েছিল।
এরপর ২০ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটি জেলা শহরে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। তখন শহরের বনরূপা থেকে বিজন সরণী পর্যন্ত বিভিন্ন দোকানপাট, ঘরবাড়ি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে আগুন ও ভাঙচুর করা হয়। শহরের কালিন্দীপুর এলাকার মুখে এক পাহাড়ি শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
তখনও খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। সহিংসতার ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরীসহ সদস্যরা রবিবার খাগড়াছড়ি এবং সোমবার রাঙ্গামাটিতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন।