আজ ২৭ জানুয়ারি। পূর্ণ হলো সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের ১৯ বছর। এই দীর্ঘ সময়েও আওয়ামী লীগের এই নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ শেষ হয়নি। এই ধীরগতির পেছনে রয়েছে নিয়মিত সাক্ষী হাজির না হওয়াসহ নানা কারণ।
এ পরিস্থিতিতে মামলার বিচারকাজ শেষ হওয়া নিয়ে স্বজনদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ ও সংশয়।
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি নিজ নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে একটি জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য এএসএম কিবরিয়া। চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পথে মৃত্যু হয় তার।
এ ঘটনায় কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মঞ্জুরুল হুদা, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা আবদুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলীও নিহত হন, আহত হন আরও ৭০ জন।
ঘটনার পরদিন হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা হয়। এর একটিতে তিন দফা তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র গঠনের মাধ্যমে সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৫ সালে। এরপর থেকে বারবার পিছিয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণ।
২০০৫ সালের ১৮ মার্চ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সী আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এরপর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে হাইকোর্টে আপিল করেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সরকারের প্রতি ‘কেন অধিকতর তদন্ত করা যাবে না’ মর্মে রুল জারি করেন।
এই রুলের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ১৮ মে লিভ টু আপিল করে সরকার, যা আপিল বিভাগ খারিজ করেন।
এরপর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলামকে।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২০ জুন আরও ১৪ জনকে আসামি করে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ছয় বছর পর নতুন এ প্রতিবেদনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামের প্রধান মুফতি হান্নানসহ মোট ২৪ জনের নাম উঠে আসে।
ওই অভিযোগপত্রের ওপর ২০১১ সালের ২৮ জুন কিবরিয়ার স্ত্রী আসমা কিবরিয়া হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপনথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের না-রাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।
এরপর সিআইডির এএসপি মেহেরুন নেছা দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাড়ে ৯ বছর পর ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনসহ মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়।
তখন আসামির তালিকায় যুক্ত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া।
একইসঙ্গে পূর্বের অভিযোগপত্রে থাকা ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আব্দুল করিম ও মরহুম আহছান উল্লাহকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়।
২০১৫ সালের জুনে মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে সেখানে বিচার কার্যক্রম চলছে। এখন চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব। মোট ৩২ জন আসামির মধ্যে অন্য একটি মামলায় ৩ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে, এক জন মারা গেছেন। জামিনে আছেন ১২ জন, পলাতক ৬ জন ও হাজতে রয়েছেন ১০ জন।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচারকাজের অগ্রগতি নিয়ে কথা হয় সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সাবেক সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট কিশোর কুমার করের সঙ্গে।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, ‘‘এ হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামিরা দেশের প্রায় সবকটি জেলাতেই বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়ায়, এক জেলা থেকে তাদের অন্য জেলায় প্রতিনিয়ত যেতে হয়। এ কারণে সবসময় আসামিরা আদালতে উপস্থিত হতে পারেন না।
“এছাড়া অসুস্থতাসহ নানা কারণে জেলে থাকা আসামিদের উপস্থিত করা যায় না। ফলে দীর্ঘায়িত হচ্ছে সাক্ষ্যগ্রহণ। সব আসামিদের আদালতে উপস্থিত করতে না পারায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা অপর মামলার অভিযোগপত্র এখনও গঠন করা যায়নি।”
সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, একের পর এক তদন্ত এবং বাদীপক্ষের নারাজির কারণে মামলার বিচারকাজ শুরু হতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। মূলত হত্যাকাণ্ডের সাড়ে ১০ বছর পর মামলার বিচার শুরু হয়। হত্যা মামলার ১৭১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। আর বিস্ফোরক মামলায় ১৯১ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১১ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। অনেক সাক্ষীর মারা যাওয়া, সাক্ষী হিসেবে থাকা সরকারি কর্মকর্তাদের অবসরে চলে যাওয়াসহ নানা কারণে সাক্ষীরা ধার্য তারিখে অনুপস্থিত থাকছেন। এ অবস্থায় সাক্ষীদের উপস্থিত করতে সমন জারিসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে।
সিলেট বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি সরওয়ার আহমদ চৌধুরী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন পর্যন্ত এ মামলার ১৭১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫০ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। ৩২ জন আসামির মধ্যে জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ তিনজনের অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
“বিএনপি সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১০ জন আসামি হাজতে, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও হবিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র জি কে গউছসহ ১২ জন আসামি জামিনে, পলাতক আসামি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরীও মারা গেছেন। বাকি ৬ আসামি পলাতক রয়েছেন।”
তিনি বলেন, “সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা মামলায় অভিযুক্ত তিন আসামিকে অন্য মামলায় ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত, তারা ঢাকায় কারাগারে বন্দী। ওই তিন আসামি আদালতে না থাকায় এবং সাক্ষীরা উপস্থিত না হওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ পেছানো হয়েছে। একই কারণে আগের তারিখে সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।”
সর্বশেষ গত ২৪ সেপ্টেম্বর সাক্ষীরা আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ পেছানো হয় বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ওইদিন মো. শাহাদাত হোসেন প্রামাণিকের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল। এর আগে গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি ও ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর একই কারণে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ পেছানো হয়েছিল।
সর্বশেষ তারিখে উপস্থিত না হওয়া কয়েকজন সাক্ষীর নামে পরোয়ানা ও সমন জারি করেন আদালত। তবে ওইদিন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ কয়েকজন আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া মামলায় অভিযুক্ত জামিনে থাকা কয়েকজন আদালতে উপস্থিত হতে না পেরে সময় চেয়ে আবেদন করেছেন বলে জানান তিনি।
সরোয়ার আহমদ আরও বলেন, “ধার্য দিনে সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় নিষ্পত্তি হতে সময় লাগছে, তবে সাক্ষীদের হাজির করে মামলা শেষ করার চেষ্টা রয়েছে।”
এত দিনেও মামলার বিচারকাজ শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা।
এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া শনিবার সকালে বনানী কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “১৯ বছর অপেক্ষা করেও আমরা বিচার পাইনি। দেশে যে কোনও আইনের শাসন নেই, এটিই তার প্রমাণ।
“এতদিনে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি, সুষ্টু বিচার হয়নি। বিরোধী দলের কিছু নিরীহ লোককে জড়িত করা হয়েছে এই মামলায়। তাদেরকে অন্যায়ভাবে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। এজন্য বর্তমান সরকারের সময় হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার আশা করি না।”
শাহ এ এম এস কিবরিয়া ছিলেন ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধে কূটনৈতিক যোদ্ধা। কর্মজীবনে তিনি পররাষ্ট্র সচিব ও এসকাপের নির্বাহী সচিবসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৪ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে কিবরিয়া অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০০১ সালে হবিগঞ্জ-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।