চলছে ভোটের বছর। ক্ষমতার পালাবদল চলবে বছরজুড়ে। বিশ্ব মোড়লদের কে ক্ষমতায় টিকবেন, আর কে ঝড়ে পড়বেন, এনিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। হেভিওয়েট নেতাদের মধ্যে ঘুরেফিরে যাদের নাম আসছে, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন উত্তর কোরিয়ার চেয়ারম্যান কিম জং উন।
পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে এ বছর নির্বাচন হওয়ার কথা। ফলে কে হতে যাচ্ছেন কিমের উত্তরসূরী, এনিয়ে সরগরম আন্তর্জাতিক মিডিয়া।
কিমের পর দেশটির প্রধান হতে যাচ্ছেন তার বোন কিম ইয়ো জং। গত দুই বছর ধরেই তার নাম আসছিল মিডিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সরব উপস্থিতি ছিল তার।
কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু ছাপিয়ে উত্তরসূরী হিসেবে উনের মেয়ে কিম জু-য়ার নাম এসেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ’র (ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্স সার্ভিস) এমন দাবির পর নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ২০১৪ সালে তাই যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উত্তর কোরিয়াকে ‘বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ফলে উনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।
ধারণা করা হয়, কিম জু-য়া হলেন উনের দ্বিতীয় সন্তান। তার বয়স আনুমানিক ১০। ২০২২ সালের শেষের দিকে প্রথম জনসম্মুখে দেখা যায় তাকে। সেবছর দেশটির প্রশাসন এক ডিক্রি জারি করে জু-য়ার নামে যাতে অন্য কারও নাম রাখা না হয়, সেই আদেশ জারি করা হয়।
উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ফের প্রকাশ্যে এসেছিল জু-য়া। সেদিন বাবার সঙ্গে গার্ড অব অনারও পায় সে। এরপর থেকেই মূলত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে গুঞ্জন শুরু হতে থাকে।
আসলে কে হবেন উনের উত্তরসূরী, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে তাকাতে হবে কিম পরিবারের ইতিহাসের দিকে। খুব সরল পথ ধরে আগায়নি এই পরিবারের ক্ষমতা কাঠামো।
উনের দাদা কিম ইল সাং দ্বিতীয়ের হাত ধরেই সূত্রপাত আধুনিক উত্তর কোরিয়ার। ১৯৪৫ সালে জাপানের ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে কোরিয়াকে স্বাধীন করেন তিনি। তার যুদ্ধক্ষেত্র ছিল চীন ও উত্তর কোরিয়ার সীমান্তে অবস্থিত পায়েকতুর পাহাড়। এই পাহাড় কোরীয়দের পবিত্র স্থান। যার কারণে উত্তর কোরিয়ায় কিম পরিবারকে আলাদা সম্মান করা হয়।
ইল সাং ছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জাপানের আত্মসমর্পনের পর স্তালিন তাকে উত্তর কোরিয়ার নেতা হিসেবে নিয়োগ দেন।
১৯৪৮ সালে তার হাত ধরেই আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর কোরিয়ার নাম বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা পায়। এজন্য তাকে উত্তর কোরিয়ার জাতির পিতাও বলা হয়।
কিম ইল সাং মারা যান ১৯৯৪ সালে। এরপর দেশের ক্ষমতায় আসেন তার ছেলে কিম জং ইল। অবশ্য খুব সহজে তিনি ক্ষমতায় বসতে পারেননি। এজন্য তাকে লড়াই করতে হয়েছে তার চাচা কিম জং নারের সঙ্গে। নার ছিলেন তখন দেশটির সেনাবাহিনীর এজন শক্তিশালী নেতা। জনসমর্থন কাজে লাগিয়ে চাচাকে সরিয়ে শেষমেষ ক্ষমতায় বসেন জং ইল। তবে তাকে ক্ষমতায় আনতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছিলেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী চুং কু রাক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জু ইক।
২০১১ সালে জং ইলের মৃত্যু হয়। এরপর উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্বে আসেন ২৭ বছর বয়সী কিম জং উন। তিনি জং ইলের ছোট ছেলে।
উনকেও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে ক্ষমতায় বসতে। তাকে তার বাবা মনোনিত করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর তাকে একাধিক পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল। প্রত্যেকটি চ্যালেঞ্জকেই তিনি কঠোরভাবে দমন করে এখনও ক্ষমতায় টিকে আছেন।
একাধিকবার উনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছিল। তিনি অসুস্থ হলে বা মারা গেলে, কেন হবেন উত্তরসূরী এনিয়ে কৌতুহল অনেকের।
উনের বোন কিম ইয়ো জং প্রথম আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ২০১৮ সালে। সেবছর কিম পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া সফরে যান। তার হাত ধরে দুই কোরিয়ার সম্পর্কের অনেকটা উন্নতিও হয়। এরপর থেকে আন্তর্জাতিক কূটিনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ৩৭ বছর বয়সী ইয়ো কিম জং ইলের সবচেয়ে ছোট মেয়ে।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কিম জং-উনকে নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকবার। তখন সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে সামনে এসেছে কিম ইয়ো জংয়ের নাম।
তবে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কিম জং উনের ভাইপো কিম হান সোল হতে পারেন দেশটির পরবর্তী নেতা। উনের সৎ ভাই কিম জং নামের ছেলে তিনি। ২৯ বছর বয়সী হান সোলের বাবা ছিলেন উত্তর কোরিয়ার শাসন ব্যবস্থার কঠোর সমালোচক। এজন্য তাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন তার চাচা উন।
২০১৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালামপুর বিমানবন্দরে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয় জং নামের। অভিযোগ রয়েছে, উনই নামের হত্যার জন্য দায়ী। বাবার মৃত্যুর পরে অনেকটা নিরুদ্দেশ হন সোল।
কিম জং নাম উত্তর কোরিয়ায় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তাই অনেকে ধারণা করেন, উনের অবর্তমানে হান সোল দেশে পা রাখলে হয়তো নেতৃত্বের চেহারা বদলে যেতে পারে।
বিবিসির প্রতিবেদনে উনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আরও দুই ব্যক্তির নাম সামনে এসেছে। তাদের একজন হচ্ছেন উনের বড় ভাই কিম জং-চাওল অন্যজন সৎ চাচা কিম পিয়ং-ইল।
কিম জং চাওলকে কখনোই রাজনীতি বা রাষ্ট্রক্ষমতার ব্যাপারে আগ্রহী মনে হয়নি। অন্যদিকে কিম পিয়ং-ইল হলেন উনের সৎ চাচা। উনের বাবার মৃত্যুর পর কিম পিয়ং-ইলের মায়ের ইচ্ছে ছিল তার ছেলেই যেন উত্তরাধিকারী হয়। যদিও এই ইচ্ছে পূরণ হয়নি কখনো।
উনের বাবা প্রভাবশালী হবার পর তার সৎ মাকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে পিয়ং-ইলকে ইউরোপে পাঠানো হয়। পড়াশোনা শেষে পিয়ং ইল বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে তিনি উত্তর কোরিয়া ফিরে আসেন। পিয়ংইয়ংয়ের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে পিয়ং ইলের নেটওয়ার্ক আছে বলে মনে করেন অনেকে।