নিয়ম বোঝাতে গিয়েই কি ইউএনওর ধমক শুনতে হলো একজন এসআইকে? সোশাল মিডিয়ায় এক ভিডিও আসার পর তা নিয়ে বইছে আলোচনার ঝড়।
ঘটনাটি কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার; তা ঘটেছিল গত শুক্রবার এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর সময়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাড়াইলের কাজলা মধ্যপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মামুন। গার্ড অব অনার দিতে গিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ রেঞ্জের এসআই (সশস্ত্র) মো. রফিকুল ইসলাম। তাড়াইল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বাহালুল খানও ছিলেন সেখানে।
ভিডিওতে দেখা যায়, গার্ড অব অনার দিতে দাঁড়ানোর সময় এসআই রফিকুল পাশে দাঁড়ালে তাকে ধমক দিয়ে পেছনে দাঁড়াতে বলেন ইউএনও মামুন। ইউএনওর পক্ষ নিয়ে পুলিশ পরিদর্শক বাহালুলও সরে দাঁড়াতে বলেন অধস্তন রফিকুলকে। এরপর আবার এসআই রফিকুল ইউএনওর সামান্তরালে দাঁড়ালে তাকে পুনরায় ধমক দেন মামুন। এসআই রফিকুল কিছু একটা বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হন। স্থানীয়রাও তখন ইউএনওর পক্ষ নেন। এক পর্যায়ে ইউএনও সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হন।
তখন তাকে অনুরোধ করে ফিরিয়ে আনেন পুলিশ পরিদর্শক বাহালুল। এরপর ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। শেষের অংশটুকু অবশ্য ভিডিওটিতে নেই, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এসআই রফিকুল গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় ইউএনওর সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তাতেই ক্ষুব্ধ হন ইউএনও মামুন। এই ঘটনা ধরে পরিদর্শক বাহালুলও ধমক দেন এসআই রফিকুলকে।
জনসম্মুখে এভাবে একজন সহকর্মীকে ধমক দেওয়ার ঘটনাটি নিয়ে পুলিশ সদস্যদের অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের দাবি, নিয়মের ব্যত্যয় ইউএনওই ঘটিয়েছিলেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান কীভাবে জানাতে হবে, তা নিয়ে ২০২০ সালে একটি আদেশ জারি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, যা অনুসরণ হয়ে আসছে।
তাতে বলা হয়েছে, মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার কফিন জাতীয় পতাকায় আবৃত করার পর সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে কফিনে ফুল দেবেন জেলা প্রশাসক কিংবা ইউএনও; তাদের অনুপস্থিতিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কিংবা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এই দায়িত্ব পালন করবেন।
ফুল দেওয়ার পর অনুমোদিত সংখ্যক পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র গার্ড কর্তৃক মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সশস্ত্র সালাম জানানো এবং বিউগলে করুণ সুর বাজানো হবে।
সশস্ত্র সালাম জানানোর সময় কে কীভাবে দাঁড়াবেন, তা আদেশে লেখা না থাকলেও এই দায়িত্ব পালন করে আসা পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, রীতি হলো গার্ড অব অনার দেওয়ার সময় কফিন এবং গার্ড প্রদানকারীদের মাঝে কেউ থাকবেন না।
এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যখন কাউকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়, তখন ইউএনও ও থানার প্রতিনিধির দায়িত্ব হলো প্রথমে মৃতের কফিন পতাকা দিয়ে আবৃত করবেন।
“এরপর কফিনে পুস্পস্তবক অর্পণ করে সন্মান জানানো শেষে পাশে সরে যাবেন। এসময় সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধার সামনে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র সালাম জানাবেন এবং বিউগলে করুণ সুর বাজাবেন।”
তাড়াইলের ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক পুলিশ সদস্য বলেন, “কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর সশস্ত্র সালাম জানানোর জন্য এসআই রফিকুল ইসলাম সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এসময় ইউএনও স্যার তার পাশাপাশি দাঁড়ানোর জন্য তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে যান, তাকে পেছনে দাাঁড়াতে বলেন।
“তখন এসআই রফিকুল ইসলাম আস্তে করে ইউএনও স্যারকে বিষয়টি বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেন। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ইউএনও স্যার। একপর্যায়ে তিনি রাগ করে পেছনে চলে যান। এই অবস্থায় আশপাশের কিছু মানুষও ক্ষিপ্ত হয়ে যান। তারা ভেবেছে, ইউএনও স্যার যা বলেছে সেটাই সঠিক।”
কিশোরগঞ্জ জেলা রেঞ্জ পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ কবীর আহমদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি ভিডিওটি দেখেছি। কফিনের সামনে তারাই দাঁড়াবেন, যারা সালাম জানাবেন। এখানে এসআই রফিকুল ইসলাম কোনও অন্যায় করেননি। ইউএনও স্যাররা পাশে দাঁড়াতে পারতেন।”
যাদের নিয়ে ঘটনা, কী বলছেন তারা
কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল- জানতে চাইলে এসআই রফিকুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ইউএনও স্যার একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ঘটনার সময় আমি স্যারকে (ইউএনও) আস্তে আস্তে বলেছি, স্যার সালাম জানানোর সময় এভাবে কফিনের সামনে অন্য কারও দাঁড়ানোটা দৃষ্টিকটূ দেখায়।
“স্যার হয়ত বিষয়টি বুঝতে পারেননি, সেজন্য হয়ত আমার ওপর রাগ করেছেন। পরে স্যার চলে যেতে চাইলে আমি তাকে সরি বলে ফিরিয়ে এনে তাকে সামনে রেখেই গার্ড অব অনার দিয়েছি।”
ঘটনাটিকে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বলছেন এসআই রফিকুল। তিনি বলেন, “এটা সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝি। তাই স্যারের প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনও অভিযোগও নেই।”
এই ঘটনার ভিডিও প্রকাশ কীভাবে হলো, সে বিষয়ে কোনও ধারণা নেই এই পুলিশ কর্মকর্তার। তবে তিনি বলেছেন, “ভিডিও ফেইসবুকে ছাড়া ঠিক হয়নি।”
ইউএনও আল মামুন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যেটুকু ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়েছে, তার আগে-পরে আরও ঘটনা আছে। আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে একটি নির্দিষ্ট অংশের ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে।”
ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমি ২০ জনেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দিয়েছি। সবসময় দেখেছি ইউএনও এবং ওসির কিংবা থানার প্রতিনিধির অবস্থানের মাঝের অংশে একটু পেছনে দাঁড়িয়ে সালাম জানান সশস্ত্র সদস্যরা।
“আমি এসআই রফিকুলকে বিষয়টি বলার পরও বুঝতে পারছিল না। তাছাড়া শুরু থেকেই আমাদের কথা মানতে চাইছিল না। পুষ্পস্তবক সবসময় কফিনের মাঝে রাখা হয়, কিন্তু এসআই রফিকুল কফিনের পাশে রাখার জন্য বলছিলেন। বিষয়টি নিয়ে উপস্থিত লোকজনও ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন এসআই রফিকুলের ওপর।”
“তাই পরিস্থিতি শান্ত রাখতেই তার ওপর রাগ করেছিলাম আমি। এখানে আমারও হয়ত কোনও ভুল থাকতে পারে, সেটা আমি অস্বীকার করছি না,” বলেন মামুন।
ঘটনাস্থলে থাকা তাড়াইল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বাহালুল খানের সরকারি মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। ফলে তার কোনও বক্তব্য জানা যায়নি।
তাড়াইল থানার ওসি মোহাম্মদ মনসুর আলী আরিফ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি গুরুত্বপূর্ণ কাজে থাকায় গার্ড অব অনার জানাতে যেতে পারিনি। আমার পরিবর্তে সেখানে গিয়েছিলেন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বাহালুল খান ।
“এরপর সেখানে একটি ঘটনা ঘটেছে, যেটা কিছুক্ষণ আগে আমি জেনেছি। আমার দৃষ্টিতে কাজটি ঠিক করেননি বাহালুল খান। বিষয়টি নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।”
দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার পর জনরোষে পড়া পুলিশ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে।
এরমধ্যে এই ঘটনাটি ধরে ওসি মনসুর বলেন, “এখন দেশের সবার সামনে একটি সুযোগ এসেছে স্বচ্ছভাবে কাজ করার। আমাদের পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব এখন নিজেকে প্রমাণ করার। সে মূহূর্তে এমন ঘটনা দুঃখজনক।”
এবিষয়ে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভিডিওটি আমিও দেখেছি। জনসম্মুখে দুজন সহকর্মীর এমন আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এবিষয়ে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”