চোট তাকে এতটা ভোগাবে সেটা কি কৃষ্ণা রানী সরকার নিজেও ভেবেছিলেন? ঘরের মাঠে দু দুটো ফিফা ফ্রেন্ডলি সিরিজের একটিতেও যে বাংলাদেশ দলে জায়গা পাননি এই স্ট্রাইকার!
প্রথমবার কৃষ্ণা বাদ পড়েন সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে, গত বছর ডিসেম্বরে। প্রায় ৫ মাস পর শুক্রবার আরেকটি ফিফা ফ্রেন্ডলি সিরিজ শুরু হচ্ছে ঢাকায়। বসুন্ধরা কিংস অ্যারিনায় বিকেল ৫টা ৪৫ মিনিটে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি হবে চীনা তাইপের। দুই ম্যাচের এই সিরিজের একটিতেও তাকে বিবেচনায় রাখেননি বাংলাদেশ দলের নতুন ব্রিটিশ কোচ পিটার জেমস বাটলার।
রাখবেনই বা কোন ভরসায়? সেই ২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকেই চোটে ভুগছেন কৃষ্ণা। তবে কৃষ্ণার চোট প্রথম আমলে নেন কোচ সাইফুল বারী টিটু। গত বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ দল যখন চীনে এশিয়ান গেমসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, এর আগে টিটুকে দেখা গেছে কৃষ্ণাকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে।
ওই সময় কৃষ্ণা এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, “ আমার চোট ফুটওয়্যারের কারণে (বুট) হতে পারে। ডান পায়ের মেটাটারসালের মাঝখানে যে নার্ভ আছে, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
এই অবস্থায় চীনে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই খেলতে পারেননি। বেঞ্চে বসে বাংলাদেশের হার দেখেছেন।
এবারও ঘরের মাঠে খেলা। অথচ দর্শক হয়ে তাকে গ্যালারিতে থাকতে হচ্ছে। তবে কি কৃষ্ণার ক্যারিয়ার শেষ হতে চলেছে? হতাশায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে কৃষ্ণা তো লিখেই ফেলেছেন সেই কথা, “অনেক খেলোয়াড়কে দেখেছি এভাবে হারিয়ে যেতে। মনে হয় সেই দিনটা আর বেশি দিন নেই আমার জন্য।” অথচ একটা সময় ছিল যখন কৃষ্ণা ছাড়া দল ঘোষণা ভাবাই যেত না।
ফুটবলে কৃষ্ণার হাতেখড়ি ২০১১ সালের বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে। গোপালপুরের সুতি ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলের হয়ে খেলেছিলেন। সেখানকার কোচ গোলাম রায়হানের হাত ধরে উঠে আসা কৃষ্ণার।
এরপর ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেন প্রথমবার জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে। সেবার বাংলাদেশ দল খারাপ খেললেও কৃষ্ণা ছিলেন উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রম।
২০১৫ সালে নেপালে একই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দলে খেলেন। কিন্তু পরের বছর তাজিকিস্তানে হওয়া এই প্রতিযোগিতায় বয়সের কারণে সুযোগ পাননি। এর আগে পাকিস্তানে ২০১৪ মহিলা সাফ গেমসে জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে। ভারতে অনুষ্ঠিত ২০১৬ দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে মালদ্বীপের বিপক্ষে যখন কেউ গোল পাচ্ছিলেন না, তখন দুটি দর্শনীয় গোল করেন এই কৃষ্ণা।
প্রায় ১০ বছর একটানা জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দল মিলিয়ে করেছেন ৫৮ গোল। নেপালের বিপক্ষে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ম্যাচেও করেছিলেন দুর্দান্ত দুটি গোল। কখনও পারফরম্যন্সের কারণে বাদ পড়েননি জাতীয় দল থেকে।
টানা দুবার দল থেকে বাদ পড়ে হতাশায় কৃষ্ণা ফেসবুক পেজে লিখেছেন, “ টুকটাক ইনজুরিতে পড়েছি। কিন্তু হঠাৎ করে এত বড় ইনজুরিতে পড়বো কখনও ভাবি নি। অনেকদিন বিশ্রামে থাকার পর আর ভালো লাগছিল না এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছিলাম। তাই ব্যথা নিয়ে অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছি।”
চোটের যা অবস্থা সেটার ব্যাখ্যা নিজেই দিয়েছেন কৃষ্ণা, “প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে। পা আগের চেয়ে ভালো কিন্ত এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়ে উঠতে পারিনি। অনুশীলন করলেই ব্যথা হয়। বাফুফের ফিজিও দিয়ে আমার চিকিৎসা চলছে। সবাই জানে ইনজুরিটা অনেক রেয়ার। ব্যাথা নিয়েই অনুশীলন করছি। দেশে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।”
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ফিজিও দেবাশীষ চৌধুরীকে দেখিয়েছিলেন কৃষ্ণা। ওই চিকিৎসক দীর্ঘদিন চিকিৎসা করেও ব্যথা কমাতে পারেননি। তখন দেবাশীষ কৃষ্ণাকে অস্ট্রেলিয়া বা ভারতে গিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দেন।
কিন্তু কৃষ্ণার চিকিৎসার দায়িত্ব যাদের সেই বাফুফেকে দেখা গেছে উদাসীন। কৃষ্ণা বলেন, “ যখন আমি বাফুফেকে জানাই, উনারা বলেন আরও কিছুদিন দেশের ডাক্তার দেখাতে। আমি অনেকদিন তাদেরকে ভারতে যাওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু উনারা আমার কথায় কোনও গুরুত্ব দেযননি। আজও পর্যন্ত ব্যাথা নিয়ে অনুশীলন করছি।”
এমনকি এই দুঃসময়ে কৃষ্ণা পাশে পাচ্ছেন না কোনও সতীর্থ বা কর্মকর্তাকে, “কষ্ট একটাই কখনও কোনও টিমমেট, প্লেয়ার বা কোচকে বলতে দেখলাম না কৃষ্ণার ইনজুরি। তাকে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করানো হোক। কারও যেন কোনও মাথা ব্যথা নেই।”
মনে অনেক ক্ষোভ আর যন্ত্রণা নিয়ে জাতীয় দল ছেড়েছেন আঁখি খাতুন, সিরাত জাহান স্বপ্না। তবে কি এবার কৃষ্ণাও সেই পথে হাঁটছেন?