ব্রিটিশ-ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ— তিন রাষ্ট্রের সাক্ষী কুমুদিনী। বসন্ত, কলেরা আর করোনা— তিন মহামারীর সাক্ষী কুমুদিনী। এই দীর্ঘ জীবনে ইতিহাস কাঁপানো ব্রিটিশবিরোধী কৃষকবিদ্রোহের টংক আন্দোলনের লড়াকু বিপ্লবীও তিনি। এমন জীবন খুব বেশি মানুষের নাই।
‘জীবন্ত কিংবদন্তি’-তে পরিণত হওয়া কুমুদিনী হাজং ২০২৪ সালের ২৩ মার্চ প্রায় শতবর্ষের জীবন পাড়ি দিয়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন। বাংলাদেশের কৃষক শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাসে কিংবা কৃষিউৎপাদন ব্যবস্থা বিকাশে কুমুদিনীর অবদান এখনও নথিভূক্ত হয়নি। এমনকি অভাব, অনটন আর আহাজারিতেই কেটেছে তাঁর সমগ্র জীবন। পারিবারিক সব জায়গাজমি জবরদখল হয়ে যাওয়ায় বনবিভাগের এক ছোট্ট টিলায় কেটেছে শেষ জীবন। সমৃদ্ধ কৃষিজীবনের স্বপ্ন নিয়ে জীবনবাজি রেখে টংক আন্দোলনে যোগ দিলেও তাঁর নিজের সন্তানেরা এখনও ভূমিহীন দিনমজুর। অথচ বাংলাদেশে সমতলের লাঙ্গলভিত্তিক কৃষিকাজ বিকাশে হাজং সমাজের অবদান অনস্বীকার্য। শৈশবে তিনি আশেপাশের যেসব পাহাড়-টিলায় খেলা করেছেন কিংবা বন্দেরপাতায় (বনভাত) মেতেছেন, তাঁর চোখের সামনে সেসব টিলা কেটে ছেনে চুরমার করে দিয়েছে বাইরে থেকে আসা বাঙালিরা।
কুমুদিনী হাজং যখন এই স্বাধীন দেশে ভূমিহীন হয়ে মরে যান, তাঁর জন্মভূমি দূর্গাপুরের চারপাশে যখন আদিবাসীরা ভূমি হারাতে থাকে, রক্তাক্ত ও বঞ্চিত হয়, অবাধে সেখানকার টিলা-পাহাড় কাটা চলতে থাকে, স্থানীয় কৃষি যখন শৃঙ্খলিত হতে থাকে কিংবা সিমসাং নদী যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তখন কুমুদিনীদের যে ক্ষুব্ধ ও বেদনার্ত মুখ দেখেছি তা আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলতাকে প্রশ্ন করে। এসব অমীমাংসিত জিজ্ঞাসা মাথায় নিয়ে মাঠকর্ম-গবেষণার কিছু ভঙ্গুর স্মৃতি থেকে চলতি আলাপখানি টংকবিপ্লবী কমরেড কুমুদিনী হাজংয়ের প্রতি এক ব্যক্তিগত বিনম্র গীত।
টংক আন্দোলন আর লেঙ্গুরা গণহত্যার প্রাচীন বসতি
রংদী নামে এক আন্তঃসীমান্ত নদী আছে বাংলাদেশে। নদীর নামে এক মাহারি বা গোত্র-পদবী আছে মান্দি বা গারোদের। বাঙালিরা নদীটির নাম দিয়েছে গণেশ্বরী। অভিন্ন এই সীমান্ত নদীতে এক রাবার ড্যাম তৈরি করে উজানভাটির প্রাকৃতিক প্রবাহকে বিনষ্ট করা হয়েছে। এই রংদী নদীর তীরেই লেঙ্গুরা বাজার।
নেত্রকোণার কলমাকান্দার সীমান্তে এই বাজারে সেকালের খাজনা আদায়ের কাচারিঘরের কাছে কিছু জায়গা পরিত্যক্ত, জংলা ঝোপ। মাটি খুঁড়লে এখানে মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। গণহত্যার এই নিদারুণ নিদর্শন দারুণ অবহেলিত এবং রুদ্ধ। না, এই গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের না। ঘটেছিল তারও আগে। কৃষি ও কৃষকের অধিকার সুরক্ষায় গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের সময়। ১৯৪৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সংগঠিত হয়েছিল ‘লেঙ্গুরা গণহত্যা’। যদিও টংকপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে ১৯৩৭ সালের দিকেই। অবশেষে টংকপ্রথা বাতিল হয় ১৯৫০ সালে। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং টংক, তেভাগা কিংবা নানকার মতো নিপীড়নমূলক কৃষিব্যবস্থা বাতিল হয়। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ত্ব আইন গ্রহণ এবং অন্যায় খাজনাপ্রথাগুলো বাতিল করতে লেঙ্গুরা গণহত্যা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বাধ্য করেছিল।
লেঙ্গুরা, চৈতানগর, কালাপানি, জিগাতলা, নয়ানকান্দি, ঘোড়াগাও, তারানগর, গোপালবাড়ী, চেঙ্গিনী, বগাঝরা, দমদমা রংদী অববাহিকার সব প্রাচীন হাজং গ্রাম। হাজংরা ছিল স্বচ্ছল কৃষিজীবী গৃহস্থ জাতি। ধানে-দুধে ভরপুর ছিল প্রতিটি হাজং বাড়ি, ঘরে ঘরে ছিল ‘বানা’ নামের তাঁত। লেঙ্গুরার মতো প্রাচীন হাজং জনপদে বর্তমানে আমরা কী দেখতে পাই?
লেঙ্গুরা এখন আর হাজং জনপদ নয়। ‘গিংগো বাইলোবা’ গাছের মতো জীবন্ত জীবাশ্ম হয়ে টিকে আছে কিছু হাজং বাড়ি। আর সবই গেছে বাইরে থেকে আসা নয়া বসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের দখলে। লেঙ্গুরায় টংক-বিপ্লবী হাজং ললিত সরকারের বাড়িটিও হাজংশূন্য। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের লক্ষীপুর থেকে আসা আইনউদ্দীনের পরিবার এখন এই বাড়িটিতে থাকেন। উপনিবেশিক ভারত-পাকিস্তান কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ সব রাষ্ট্রেই এই জবরদস্তি ঘটেছে।
লেঙ্গুরা বাজারের কাছে এক ভঙ্গুর টিলায় হাজং বসতির আদি স্মৃতি নিয়ে এখনও জেগে আছে এক প্রাচীন কামাক্ষ্যা থান। দূর্গাপুরে বহু মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ছিলেন একসময়। তাদের একজন কালিপ্রসাদ ঠাকুর ঘোড়ায় চড়ে হাজং গ্রামে গ্রামে বানা তাঁতের জন্য সুতা বিক্রি করতেন। বর্তমানে লেঙ্গুরা বাজারে বহু কাপড়ের দোকান আছে। প্রায়গুলোই বাঙালি মুসলিমদের। কিছু দোকানে হাজং ও মান্দিদের পোশাক হরদম বিক্রি হয়। কিন্তু এসব আদিবাসী বস্ত্র কোনও আদিবাসী এলাকায় বোনা হয়নি। ট্রাকে করে আসে সিরাজগঞ্জ-পাবনা থেকে। টংক আন্দোলনের কারণেই এই হাজং গ্রামগুলোতে তাঁত বন্ধ হয়ে যায় আর কালিপ্রসাদের মতো সুতাবিক্রেতার ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
হাজং নারী পুরুষ প্রায় সবাই যেহেতু টংক আন্দোলনে জড়িত তাই ব্রিটিশ শাসকের কাছে হাজংরাই ছিলেন প্রধান টার্গেট। সেসময় নেত্রকোণার সীমান্ত অঞ্চল হাজং, কোচ, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, বানাই, হদি ও মান্দি অধ্যুষিত হলেও হাজং বাড়িগুলো চেনার দুটি সহজ উপায় ছিল। বাস্তু থান আর বানা তাঁত। পুলিশের ধড়পাকড় থেকে বাঁচতে রাতারাতি হাজং গ্রামের বানা তাঁত পুড়িয়ে ফেলা হয় টংক আন্দোলনের সময়। এমনকি তাঁতের ‘বেও’ দিয়ে হাজং নারীরা টংক আন্দোলনে বহু জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।
লেঙ্গুরার নয়ানকান্দি গ্রামের শতবর্ষী লীলাবতী হাজংয়ের কাছে তাঁর মা কুমুদিনী হাজংয়ের একটি তাঁতের ‘বেও’ দেখেছিলাম। তাতে ক্ষুব্ধ পোড়া ক্ষত ছিল। নয়ানকান্দির তারকেশ্বর হাজং, চিনিবাস হাজং, উক্কুরমণি হাজং, মহেন্দ্র হাজং, ধৈর্যমণি হাজং, বেড়া হাজং, যমুনা হাজংদের সাথে লীলাবতীরা রংদী নদী পায়ে হেঁটে টংকের মিছিল করেছেন— ‘জান দেব তো, ধান দেব না’, ‘টংকপ্রথার উচ্ছেদ চাই’, ‘বেআইনী খাজনা আমরা দিব না’। বেতগড়ার ভদ্রাবতী হাজং আর রাজনগরের অশ্বমণি হাজং জেল খেটেছেন। হাতিখেদা ও টংক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লীলাবতীর কাছে এইসব গল্প শুনেছিলাম। বহেরাতলীর রাশিমণি আর মা কুমুদিনী হাজংয়ের কথাও তিনি বলেছিলেন।
টংক আন্দোলনের কিংবদন্তি কুমুদিনী
১৯৩৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রধানত চার পর্বে বিভক্ত টংক আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন বহুজন। টংক আন্দোলনে নিহত, আহত, অত্যাচারিত সবার নাম পরিচয় আমরা জানি না। টংকশহীদ রাশিমনি হাজং, ললিত সরকার, সুরেন্দ্র হাজংদের নাম কিছুটা উচ্চারিত হয়। কিন্তু টংক আন্দোলনের সাথে পাবলিক পরিসরে সবচে’ বেশি উচ্চারিত নাম ‘কুমুদিনী হাজং’। হতে পারে কুমুদিনী হাজং টংক আন্দোলনের চারপর্বেই সক্রিয় ছিলেন এবং তাকে ঘিরে হাজংমাতা রাশিমণি হাজং ১৯৪৬ সালের ঐতিহাসিক গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ততা এবং দূর্গাপুরে বিরিশিরির কাছে বহেরাতলীতে থাকার কারণে গণমাধ্যম কিংবা শহরের মানুষ তার সহজ সান্নিধ্য পেয়েছিল। কিন্তু খুব কম মানুষ লেঙ্গুরাসহ কলমাকান্দা এলাকার অন্যান্য টংক-বিপ্লবীদের সাক্ষাত পেয়েছেন।
এখন টংক আন্দোলনের ঐতিহাসিক সাক্ষী টিলাপাহাড়ের নাম হয়েছে ‘চীনামাটির পাহাড়’ বা ‘সাদামাটির পাহাড়’। ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে ‘বিজয়পুরের সাদামাটি’ রাষ্ট্রীয় নিবন্ধনও পেয়েছে। প্রতিদিন বহুমানুষ রক্তাক্ত এই টিলায় পর্যটনে আসেন। যাত্রাপথে টংকআন্দোলনের রাশিমণি স্মৃতিসৌধে পর্যটকেরা ছবি তুলেন। ভোগবিলাসিতার জন্য কেন পাহাড়টিলা চুরমার করা হবে কিংবা বালু বাণিজ্যের নামে কেন খুন হবে সিমসাং নদী? এই প্রশ্ন বাইরে থেকে দূর্গাপুর ঘুরতে আসা কেউ আজও জোরালোভাবে তোলেনি। তাহলে টংক আন্দোলন কিংবা কুমুদিনী হাজং সমাজে কী বার্তা দিলেন?
কুমুদিনীরা জমিন ও ফসলের উপর জনতার শর্তহীন অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়েছিলেন। সমাজ ও রাষ্ট্র প্রবলভাবে টংকের দীক্ষা ও শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন। হয়ত যারা কুমুদিনী বা টংকের নাম শুনেছেন তাদের অধিকাংশই কোনওদিন টংক আন্দোলনের কথা জানার চেষ্টা করেননি। নিম্নবর্গের লড়াইয়ের সাথে প্রবল বিচ্ছিন্নতাই মূলধারার বিবরণে কুমুদিনীকে বাস্তব নয়; ‘কিংবদন্তীতে’ পরিণত করেছিল। ঠিক যেমন আমরা হুলের ফুলমণি, সিধো, কানহু, চাদ, ভায়রো বা উলগুলানের বিরসা মুন্ডার ক্ষেত্রেও দেখতে পাই। শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস থেকে কুমুদিনীর মতো বীরদের বিচ্ছিন্ন করে ‘মহান ও মিথ’ বানানোর জবরদস্তি সমাজে প্রতিদিন প্রতিজনকে কুমুদিনী হয়ে উঠতে বাধা দেয়। অর্গল ও প্রাচীর তৈরি করে।
প্রশ্ন জাগে, কুমুদিনীকে যদি আমরা এমনই ‘মহান’ মনে করি তবে কেন তাঁকে জাতীয় স্বীকৃতি দিতে পারেনি? তিনি তো দুম করে মারা যাননি, প্রায় শত বছর বেঁচে ছিলেন। নেত্রকোণা জেলা প্রশাসন মৃত্যুর তিন বছর আগে ২০২১ সালে তাঁকে একটা সম্মাননা দিয়েছিল। জাতীয় তথ্য বাতায়ন নেত্রকোণা জেলার বিশেষ পরিচিতি তুলে ধরেছে কুমুদিনীর মাধ্যমে। ২০১৯-২০২০ সালে ভূমিহীন হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে একটি ঘর পেয়েছেন। এমনকি মৃত্যুর পর দূর্গাপুর উপজেলা প্রশাসন তাঁর বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন। রাষ্ট্র কুমুদিনীর বিষয়ে অবগত, উপজেলা ও জেলার সরকারি কর্তৃপক্ষ নানা সময়ে তাঁর বাড়িতে গেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের এতো গর্ব এবং অহংকার যাকে নিয়ে, তাঁকে কেন রাষ্ট্র ‘একুশে পদক’ বা ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত করতে পারল না? কুমুদিনীর মতো মানুষদের পক্ষে কী নিজের পদকের জন্য আবেদন করা কোনওভাবে সম্ভব? উপজেলা, জেলা বা বিভাগীয় প্রশাসন তাহলে কী করেছেন?
প্রশ্ন জাগে, টংক আন্দোলনকে যদি আমরা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণি জাগরণ বলে মানি তাহলে বর্তমানের কৃষি কেন বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে বন্দি? টংক আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত দূর্গাপুরের টিলা-পাহাড়, কৃষিজমি ও নদীগুলো কেন আজ উন্নয়নের নামে ক্ষতবিক্ষত? কুমুদিনী হাজং কিংবা টংক আন্দোলনের কথা উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে এসব প্রশ্ন সামনে আসা জরুরি। কারণ কুমুদিনী হাজং আজীবন এসব প্রশ্ন আমাদের সামনে জারি রেখেছিলেন। কৃষিব্যবস্থা ও কৃষক সমাজকে সকল কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার বার্তা প্রতিষ্ঠিত করেছিল টংক আন্দোলন। কুমুদিনী হাজংয়ের মহাপ্রয়াণে আজ এসব জিজ্ঞাসা আমাদের জোরালো করা জরুরি।
মেনকীফান্দা থেকে বহেরাতলী
দূর্গাপুরের আরেক সীমান্ত গ্রাম মেনকীফান্দা। এখানকার প্রাকৃতিক শালবন উপড়ে বনবিভাগ আগ্রাসি একাশিয়া লাগাতে চায়। টিলাপাহাড়ের মান্দি, হাজংরা প্রতিবাদ করে। ১৯৯২-১৯৯৩ সালে বন বাঁচাতে গড়ে ওঠে মেনকীফান্দা আন্দোলন। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক অজিত রিছিল। ২০০০ সালের শুরুর দিকে আমি তাদের বাড়িতে থাকতে শুরু করি। এই টিলা থেকে সেই টিলা, এই গ্রাম থেকে সেই গ্রাম আমরা ঘুরে বেড়াই। অজিত রিছিলের সাথেই প্রথম এসেছিলাম কুমুদিনী হাজংয়ের টিলায়। ২০০০ সালের এক দুপুরে, সেই আমাদের প্রথম সাক্ষাত। পরের সপ্তাহে আমি কুমুদিনীর বাড়ি চলে আসি। একান্তই পারিবারিক অভ্যাসবসত আমি তাঁকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করি। আমাদের খাবারে বসিয়ে কুমুদিনীর কত আলাপ। জানতে পারি, পা ছুঁয়ে প্রণাম করাকে হাজং ভাষায় বলে ‘কুড়ালকাটা হিঙা’। বিয়ের সময় কুমুদিনী নাকি তাঁর স্বামী লংকেশ্বর হাজংকে কুড়ালকাটা হিঙা করেছিলেন। কুমুদিনী অজিত রিছিলকে ‘মাস্টর’ ডাকতেন, আমি তাঁকে প্রথম কিছুদিন ‘গাঁওবুড়ি’ ডেকেছিলাম, পরে কখনও ‘দিদিমা’ আবার কখনওবা আচিক ভাষায় ‘আম্বি’ বলেও ডেকেছি।
বিজয়পুরের পাহাড়কাটা নিয়ে কুমুদিনী বলেছিলেন মেনকীফান্দা আন্দোলনের মতো একটা গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে। কুমুদিনীর প্রেরণাতেই পরবর্তীতে বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পাহাড়-টিলা কাটা, সাদামাটি ও পাথর উত্তোলন নিয়ে এক ধারাবাহিক গবেষণা করার সাহস পাই। কুমুদিনীর বাবা অতিথ চন্দ্র রায় ছিলেন ‘হাতিখেদা বিরোধী আন্দোলনের’ একজন লড়াকু বীর। হাতিখেদা ও টংক নিয়ে কাজ করতে কোন কোন গ্রামে যাওয়া জরুরি এসব বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা পেয়েছি কুমুদিনীর কাছ থেকে। কুমুদিনীর মা জনুমণি হাজং ছিলেন একজন দক্ষ বানা কারিগর। কুমুদিনী তাঁর মায়ের বোনা কোনও কাপড় পড়তে পারেননি। শৈশবেই কুমুদিনী মা বাবাকে হারান। বড় হন মামার কাছে। শৈশবেই কুমুদিনীর বিয়ে হয়। কোনও পণ ছাড়াই মাইজগাঁওয়ের টংকবিপ্লবী লংকেশ্বর হাজংয়ের সাথে।
কলমাকান্দার নয়ানকান্দির টংকবিপ্লবী তারকেশ্বর হাজংয়ের কাছ থেকে শুনেছিলাম তার বাবার বিয়েতে ১৫ টাকার ধান পণ দেওয়া হয়েছিল। এক মণ ধানের দাম ছিল তখন প্রায় তিন টাকা। বিয়ের সময় লংকেশ্বরের বয়স বিশের কাছাকাছি আর কুমুদিনীর ১২/১৩। বিয়ের কথা কুমুদিনীর কাছ থেকে খুব একটা শোনা হয়নি আমার। কেবল মনে আছে হাজং নিয়মে বিয়ের যাহু বা ঘটক হয়েছিলেন তার মামা। লম্বা বাঁশের মশাল জ্বালিয়ে ভোগা নৃত্য হয়েছিল বিয়েতে। কুমুদিনীদের যখন বিয়ে হয় তখন জুলুমবাজ ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় টংকপ্রথা সুসং দূর্গাপুর, শ্রীবর্দী, নালিতাবাড়ি, কলমাকান্দা, হালুয়াঘাট অঞ্চলে চালু ছিল। লংকেশ্বরের বাবা দূর্গাদাস হাজং টংকপ্রথার বিরুদ্ধে জনসংযোগের কাজ করতেন। কুমুদিনী ও লংকেশ্বর হাজংদের উভয় পরিবারের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং সমাজ বদলের ক্ষেত্রে তাদের পারিবারিক যুক্ততা উভয়কেই টংক আন্দোলনে সামিল করেছে। আমি যখন কুমুদিনীর বাড়িতে প্রথম যাই, তখন লংকেশ্বর হাজং অসুস্থ ছিলেন। বলেছিলেন, তার কোনওকিছু খুব একটা মনে থাকে না, ‘কানপারা নাওয়া (ভুলোমন)’ হয়েছেন। তিনি আমাকে কলমাকান্দা এলাকার বহু টংকবিপ্লবীদের নাম দিয়েছিলেন। ২০০০ সালেই লংকেশ্বর অনন্তলোকে যাত্রা করেন। লংকেশ্বর কৃষিমজুর ছিলেন। শেষের দিকে এলাকায় পাহাড় কাটা, বালু-পাথর উত্তোলন শুরু হলেও এসব কাজে তার শরীর কুলায়নি। তারপরেও করেছেন। লংকেশ্বরের মৃত্যুর পর দুই কন্যা এবং তিন পুত্রকে বড় করতে আরেক প্রবল কঠিন জীবনযুদ্ধে নামেন কুমুদিনী।
কুমুদিনীদের যেভাবে ‘ভূমিহীন’ বানানো হয়েছে
কুমুদিনীর আর কোনও ভাই-বোন ছিল না। বিয়ের পর বাবার রেখে যাওয়া চার আড়া জমি বুঝে পান কুমুদিনী। লংকেশ্বরকে নিয়ে নিজেদের পৈতৃকবাড়িতে থাকা শুরু করেন। হাপা, নিলি হাপা, চাম্পালি, গচি, খুরমা, দুধবিনি, কাতিবিনি, চন্দনবিনি, হাতিবান্ধা ধানের আবাদ করেছেন নিজেদের জমিনে। নিলি হাপা দিয়ে খুব ভালো বকনি ভাত রান্না করতেন কুমুদিনী।
কিন্তু শত শত বছরের জুলুমে কুমুদিনীদের টিলা-পাহাড়-বন আর আগের মতো থাকেনি। ১৮৫৮ সালে সেখানে ব্রিটিশ উপনিবেশের জুলুম শুরু হয়। বনের হাতি ধরে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকার বাধ্য করে হাজংদের। শুরু হয় ‘হাতি বেগার প্রথার’ মতো জুলুম। বনের হাতি ধরে বিক্রি করা পাপ বলে গ্রামে গ্রামে হাজংরা ফুঁসে ওঠে। সংগঠিত করে ‘হাতিখেদা বিরোধী আন্দোলন’। মনা হাজং, গোরাচাঁদ হাজং, সোয়া হাজং, রতি হাজং, মংলা হাজং, বেহারী হাজং, জগা হাজং, বাঘা হাজং হাতিখেদা বিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন। ১৮৭৯ সালে হাতিখেদা আইনত নিষিদ্ধ হয়। বনের হাতি ধরে বিক্রি বাণিজ্য বন্ধ হওয়াতে ব্রিটিশ সরকার কৃষকপ্রজাদের কাছ থেকে অন্যায় খাজনা আদায়ে মরিয়া হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসকদের বেশি অর্থের লোভ থেকেই টংকপ্রথা জারি হয়। ১৯৩৭ সালের দিকে সোয়া একরের জন্য ১৫ মণ ধান খাজনা দিতে বাধ্য করা হয় কৃষকদের। অনাবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল কিংবা মহামারী নানাকারণে যদি ধানের ফলন নাও হতো তাও টংকখাজনা জমা দিতে হতো। হাজং কৃষকসমাজ আর কুলাতে পারছিলেন না। শুরু হয় টংকপ্রথার বিরুদ্ধে জনআন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে কমরেড মণি সিংহের যুক্ততা এই আন্দোলনের এক শক্ত ভিত্তিমূল। টংক আন্দোলনের তুখোড় সময়েও কুমুদিনীর জমি কেউ জোর করে কেড়ে নেয়নি। টংকের প্রতিটিপর্বে জুলুমের দাগ ও জবরদস্তি ভিন্ন ভিন্ন ছিল।
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার রাশিমণি হাজংসহ প্রায় বিশজনকে হত্যা করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার হত্যা মামলা করে টংকবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে। কুমুদিনী হাজং, মণি সিংহ, ললিত সরকার, লংকেশ্বর হাজং ও তার চার ভাইকে আসামী করা হয়। আটক এড়াতে হালুয়াঘাটের লক্ষীকুড়া গ্রামের বলেশ্বর হাজংয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ছদ্মনাম নেন ‘সরস্বতী’। হয়ত এ কারণেই সুপ্রকাশ রায় ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় কৃষক’ এবং ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ পুস্তকে কুমুদিনীর নাম ‘সরস্বতী’ বলে উল্লেখ করেছেন। তখন আত্মগোপন থেকে ফিরে এসেও নিজেদের জমি ফেরত পান কুমুদিনী।
দেশভাগের পর বৃহত্তর ময়মনসিংহ সীমান্তে নির্দয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও গণহত্যা হয়। এসব গণহত্যা এখনও অলিখিত ও অস্বীকৃত রয়েছে। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় কুমুদিনীদের পারিবারিক চার আড়া জমি বাঙালিরা জবরদখল করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মেঘালয়ের বাঘমারা ক্যাম্পে চলে যান ওঁরা। কুমুদিনী ও লংকেশ্বর শরণার্থীদের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু স্বাধীনের পর দেশে ফিরে কুমুদিনীরা আর তাদের জমি ও ভিটা ফেরত পাননি।
কৃষিব্যবস্থা ও কৃষকসমাজকে উপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে যারা জীবন দিল, সেই হাজংদের বেশিরভাগকেই দেশ স্বাধীনের পর ভূমিহীন হতে হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের হাজং-বানাই-ডালু-মান্দিদের জীবনে জবরদস্তিমূলক ভূমিহীনতা নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দল কিংবা নাগরিক তৎপরতা আজও কোনও জোরালো প্রশ্ন তোলেনি। যদিও এরাই আবার কৃষক আন্দোলন বা কুমুদিনীদের মতো বিপ্লবীদের নিয়ে ‘মায়াকান্নার’ ঢেউ তুলেন।
কলমাকান্দার চন্দ্রডিঙ্গা গ্রামের সরমা দেবী হাজংদের পরিবারও ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত যেতে বাধ্য হন। দেশ স্বাধীনের পর ফিরে আসেন। কিন্তু চারধারে জটিল হতে থাকা বঞ্চনা ও বাহাদুরি তাকে বারবার কাতর করে। এক দেউলী উৎসবের আসরে আমাদের নানা কথা হয়। আমার এক পুরনো মাঠকর্মের খেরোখাতা থেকে সরমা দেবী হাজংয়ের হাজং ও বাংলা মেশানো আলাপের কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি। সরমা দেবী বলেন, … ‘‘মাও ভূমিলা ছাড়বার না পায়, আমলা দেশ মাটিলা ছাড়বার না পায় (মাতৃভূমি ছাড়তে পারিনা, আমার জন্মভূমি আমি ছাড়তে পারিনা)। বাইরে থেকে আসা মানুষ সব দখল করি নেয়। অহন হাজং গুনা আইতা আনলে বাইতা সিরি (এখন হাজংদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়)। যাগরে জাগা দিসি হেরাই ঠেলতাছে। পুহা হারুক চুখুতে ঠুকরায় (পালা শালিক পাখি চোখেমুখে ঠোকর দিতেছে)। বাঙালরা মনে করে, হাজংলা এক্করে জল্লক ভল্লক (হাজংরা বোকাসোকা)। তারা আমরারে গোণে না। আগিলা পিন্দসি ফুৗলা ধুতি, ফুৗলা পাথিন, অহন ময় পিনিয়া বেড়ায় বাংগাল গামসারা (আগের দিনে ফুলতোলা পাথিন পড়ছি আর এখন বাঙালিদের গামছা পড়ে ঘুরে বেড়াতে হয়)।’’
কুমুদিনীর সন্তোনেরা কেউ স্বচ্ছল স্বাধীন কৃষিজীবনের স্বাদ পাননি। বড় ছেলে রমেন্দ্র হাজং এখন আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করেন, দ্বিতীয় ছেলে অর্জুন হাজং দিনমজুর, তৃতীয় ছেলে সহদেব হাজং ভারত চলে যায়। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে এলাকাতেই এবং ছোট মেয়ে অঞ্জলি হাজংই একমাত্র চাকরি করেন।
রাশিমণির দুনিয়া কাঁপানো ডাক
টংক আন্দোলনে সবচে বড় গণহত্যাটি ঘটে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের আমলে। ১৯৪৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সেই লেঙ্গুরা গণহত্যায় কত হাজং খুন ও নির্যাহিত হয়েছেন তা এখনও অজানা। কুমুদিনী হাজং লেঙ্গুরা গণহত্যার সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না। টংক আন্দোলনে প্রথম শহীদও হন হাজংমাতা রাশিমণি হাজং। তাহলে টংক আন্দোলনের ইতিহাসে কুমুদিনী এত পরিচিত কেন? এর উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে টংক আন্দোলনের তৃতীয়পর্বে, ব্রিটিশ আমলে। কালীপূজা দেউলীর সময় সে বছর কয়েকদিন ধরে চরমাগা কৃত্য হয় হাজং গ্রামগুলোতে। রাতভর রাবণবধ পালা, দূর্গাপালা, গোপনী গাহেন, রসি গাহেন হয়। এসব পরব আর উৎসবের ভেতর মূলত টংক আন্দোলন জোরদারের তৎপরতা চলে। সিদ্ধান্ত হয় দেউলীর পর সমাবেশ হবে।
১৯৪৬ সালের পয়লা জানুয়ারি তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির আয়োজনে সুসং দূর্গাপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে টংক আন্দোলনের নীতি ও কৌশল নিয়ে এক সমাবেশ হয়। রাশিমণি, কুমুদিনী, দিস্তামণি, ভদ্রমণি, অশামণি, সমাপতী, যাদুমণি, বিপুলা, মালতী, সুরূপা, ললিত, রামনাথ, পরেশচন্দ্র, বিপিন, মঙ্গল, বাসন্তি, নবীন ও লংকেশ্বর হাজংরা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এই সভার ব্যাপারে ব্রিটিশ পুলিশ আগে থেকেই নজরদারি করে। টংক সভা সমাবেশ যাতে না হতে পারে এজন্য একইদিনে বিরিশিরিতে ব্রিটিশ পুলিশ ‘ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী’ সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করে। তাদের প্রধান টার্গেট ছিল কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও তার তিন ভাই, ললিত রায়, এবং মণি সিংহদের আটক করা। এক মাস পুলিশ গ্রামে গ্রামে টহল দেয়, যখন তখন হাজংদের ঘরে ঢুকে সবকিছু তছনছ করে। মাচা থেকে ফসল নিয়ে যায়। কিন্তু টিলা-পাহাড় ও সীমান্তনদীময় এলাকায় টংকবিপ্লবীদের গোপন আস্তানা ব্রিটিশ পুলিশ খুঁজে পায়নি। যদিও পাকিস্তানপর্বে এমন আস্তানাগুলির সন্ধান কিছু বাঙালিরা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিল। তো ৩১ জানুয়ারি সকাল দশটার দিকে বিরিশিরি থেকে সিমসাং নদী পাড়ি দিয়ে বহেরাতলী গ্রামে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর একটি সশস্ত্র দল লংকেশ্বর ও তার ভাইদের ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কুমুদিনীদের বাড়ি আক্রমণ করে।
লংকেশ্বরকে না পেয়ে আক্রমণকারীরা কুমুদিনীকে টেনেহেঁচড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সশস্ত্রবাহিনীর এই যৌনসহিংসতার বিরুদ্ধে গ্রামব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ঐতিহাসিক টংকবিপ্লবী হাজংমাতা রাশিমণি হাজং। ঐ দিনই ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রাশিমণি, দিস্তামণি, বাসন্তি হাজং সহ প্রায় ১২ জন টংক বীর। যাকে নিয়ে সংঘাত, সেই কুমুদিনী মূর্চ্ছা যান। কয়েকজন টংকবিপ্লবী ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করে কৌশলে কুমুদিনীকে আড়াপাড়া কমিউনিস্ট পার্টির গোপন আস্তানায় নিয়ে আসে। বহেরাতলী গণহত্যার পর টংকআন্দোলন নিয়ে নানামুখী আগ্রহ এবং সংহতি তৈরি হয়।
বহেরাতলী গণহত্যার পর রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু, আইনজীবী স্নেহাংশু আচার্য ও সাংবাদিক প্রভাত দাশগুপ্ত বহেরাতলী যেতে চান। কিন্তু ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেস্টিন তাদের যেতে বাধা দেন। তারা ক্ষুব্ধ হন এবং ‘রেইন অব টেরর ওভার দ্য হাজংস অ্যা রিপোর্ট অব দ্য এনকোয়ারি কমিটি’ নামের নথি কংগ্রেস নেতা জওয়াহেরলাল নেহরু বরাবর জমা দেন।
আলাপের সময় ব্রিটিশ পুলিশকে কুমুদিনী ‘অকর্মা’ আর ‘রাগী’ বলে সম্বোধন করেন হাজং ভাষায়। বলেন, ‘‘…নিথা কাহলা আঠা বাখার (অকর্মা মানুষের রাগ বেশি হয়)’’। পরে বহেরাতলী থেকে হালুয়াঘাটের লক্ষীকুড়াসহ আশেপাশের গ্রামে ব্রিটিশ জুলুম এবং বৈষম্যমূলক টংকপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেন কুমুদিনী।
জুইলৗ তারা, তারালা জুই
কুমুদিনীর কাছে হারাহারি দেও, গাং দেও, হয়গ্রীব, মইলাদেও, কানিদেও, হয়ৗলাদেও এমন বহু হাজং দেবদেবীর নাম শুনেছিলাম। নবারু, ফলানি, আমাতি, চরমাগা, থুবামাগা, কাতিগাছা, নয়া খাওয়া, বাস্তুরাণী বছরব্যাপি বহু কৃত্যপরবের কথা তিনি বলেছিলেন। বলেছিলেন শৈশবে চৈহঙরাণী পরবে হাজং গ্রামে হুমলি খেলা হতো ও মালদের বিজয়ী ঘোষণা করা হতো। ফারংপাড়া, সাগরদীঘি বা বিজয়পুরে একদিন এক টংক আড্ডায় কিছু লেওয়াতানা আর টংক গীত শুনেছিলাম। সেসবের সঙ্গে কুমুদিনীর বাড়িতে শোনা কয়েকটি গীতের মিল আছে। যেমন, .. চিরচিরি পানি নি, কাছুয়ৗ ডিমৗ পারিছে, চ বুইনী বিচরাবার যাং, কি রামই রাম।
টংক নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কত কিছু নতুনভাবে জানা হলো, শেখা হলো আমার। এক্ষেত্রে কুমুদিনী হাজং আমার এক প্রধান টংকগুরু। আমার কমরেড। জানতে পারি টংকশহীদ হিসেবে যে অগেন্দ্র হাজংয়ের নাম লেখা হয় তিনিই তারানগরের অইগ্যা হাজং, তার স্ত্রী হাফায়মণি হাজং মারা যাননি, দাঙ্গার সময় দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। লেঙ্গুরা গণহত্যার পর শংখমণির লাশ পাওয়া যায় কিন্তু রেবতী হাজংয়ের লাশ পাওয়া যায় না। নানা জায়গায় যার নাম মঙ্গল সরকার লেখা হয়েছে তিনি দক্ষিণ ঘোড়াগাঁয়ের জাবাং হাজং। লেঙ্গুরা গণহত্যার তিন মাস পর প্রাচীন সমৃদ্ধ এক হাজংগ্রাম জাগীরপাড়া সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার। কলমাকান্দার চৈতানগর গ্রামের টংকবিপ্লবী গঙ্গাধর হাজংয়ের মামা টংকশহীদ রটরাজ হাজংদের নাকি কয়েক সের ওজনের তলোয়ার ছিল। টংকের সময় ব্রিটিশ সরকার সেসব বাজেয়াপ্ত করে।
টংক আন্দোলন, রাশিমণি কী কুমদিনী হাজংকে নিয়ে যা কিছু অল্পবিস্তর লেখালেখি হয়েছে তার অধিকাংশেই জনমানুষের আলাপ অভিজ্ঞতার কোনও ছাপ নাই। ঐতিহাসিক মানুষদের অবদানকে অনৈতিহাসিক করবার জন্য তাদেরকে ‘মিথ’ ও ‘মহান’ বানানোর অহেতুক কসরৎ। কুমুদিনী বলেছিলেন, মানুষ মারা গেলে নাকি তারা হয়ে যায়। ধোবাউড়াতে একটি হাজং হীলুক (ধাঁধা) শুনেছিলাম ‘সাতভাই তারা বা সপ্তর্ষিমন্ডল’ নিয়ে। ‘এ দেশনি আছে পুরিয়া, সাত ভাই মরে ঘুরিয়া’। দূর্গাপুরের দাহা মেনকীফান্দা গ্রামের টংকবিপ্লবী বিনত হাজংয়ের কাছে ‘সাত ভাই তারার জন্মকাহিনী’ শুনেছিলাম। অনেক আগে হাজং গ্রামে সাত ভাই নিয়ে বাস করতো এক বিধবা মা। পুত্ররা ছিল মা অন্তপ্রাণ। একদিন মা মারা যান। ৪ পুত্র মায়ের লাশ নিয়ে সৎকারের জন্য রওনা হলো। ৩ পুত্র গেল চিতা ও শশ্মান ঠিক করতে। মাঝপথে তারা কীসে যেন ধাক্কা খেল। পুত্রদের মাথা থেকে মার লাশ পড়ে গেল। পরে শশ্মানে এসে দেখে তাদের মায়ের লাশ নেই। এরপর সাত ভাই মাকে খুঁজতে লাগল। আর তারপর তারা আকাশের তারা হয়ে গেল। এখনও এই সাতভাই একসাথে আকাশে তাদের মাকে খুঁজে বেড়ায়।
কুমুদিনী হাজং আকাশের তারা হয়ে আছেন কিনা জানিনা। তবে জীবিতকালে তিনি বঞ্চিত জনতার জীবনের আকাশে সাহসী এক উজ্জ্বল তারা হয়েই ছিলেন। টংক আন্দোলনের মাধ্যমে উপনিবেশিক জুলুম, বৈষম্যমূলক কৃষিব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেছিলেন। কুমুদিনীসহ প্রতিজন টংকবিপ্লবী এক একজন আগুনের তারা, হাজং ভাষায় ‘জুইলৗ তারা’। আর এই আগুনের তারাদের আগুন ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। ইতিহাস পাঠ করতে হয়, বুঝতে হয়, ধারণ করতে হয়, সম্মান দিতে হয়। টংক আন্দোলনের বীক্ষা চলমান বৈষম্যমূলক খাদ্যব্যবস্থা এবং বহুজাতিক কোম্পানি নিয়ন্ত্রিতি কৃষিকাঠামোকে প্রশ্ন করতে আমাদের দারুণভাবে জাগাতে পারে। আগুনের তারাদের আগুন (তারালা জুই) দাবিয়ে রাখা অসম্ভব, এই আগুন তারার মতোই সত্য হয়ে ওঠে বারবার।
লেখক: প্রাণ ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক ও লেখক।
ইমেইল: [email protected]