র্যাগিংকাণ্ডে আবারও আলোচনায় কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। র্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের ঘটনার পরের বছরই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আবার একই ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে।
এ নিয়ে গত এক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের অন্তত চারটি ঘটনা প্রকাশ পেল।
সর্বশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি লালন শাহ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে রাতভর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে।
অভিযুক্তরা হলেন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের মোহাম্মদ সাগর এবং শারীরিক শিক্ষা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের মুদাসসির খান কাফি।
এরই মধ্যে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। লালন শাহ হলের আবাসিক শিক্ষক ড. আলতাব হোসেনকে ওই কমিটির প্রধান করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গত বছরের ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়। এ ঘটনায় দোষী প্রমাণিত জন তৎকালীন হল শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি সানজিদা চৌধুরী ও তার কয়েকজন সহেযোগী।
ওই বছরের ১৯ জুন লালন শাহ হলের এক নবীন শিক্ষার্থীকে র্যাগিংয়ের নামে মারধরের অভিযোগ ওঠে চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও হল শাখা ছাত্রলীগের কর্মী অফিফ হাসান ও তন্ময় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে।
এরপর ২ সেপ্টেম্বর ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষের হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের নামে জ্যেষ্ঠ পাঁচ শিক্ষার্থীর নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতিত শিক্ষার্থী ৯ সেপ্টেম্বর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করেন।
ফুলপরী ও ২ সেপ্টেম্বরের নির্যাতনের ঘটনায় শেষ পর্যন্ত শাস্তি পেয়েছেন অভিযুক্তরা। তবে গত ১৯ জুন লালন শাহ হলে নির্যাতিত শিক্ষার্থীর সঙ্গে অভিযুক্তরা ‘মিটমাট’ করে নেওয়ায় ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন প্রশাসক ও আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এসব ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এ ধরনের ঘটনা যখনই ঘটুক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত এবং ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।”
প্রচার না হলে প্রশাসনও দেখে না
বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে র্যাগিং। যারা র্যাগ দেন, তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাধর হওয়ায় মুখ খুলতে চান না নবীন শিক্ষার্থীরা।
আবার অনেক সময় দুই পক্ষের মধ্যে মিটমাট হয়ে যায়, ফলে সেসব ঘটনার প্রচারও হয় না। মাঝে মাঝে এসব ঘটনায় তদন্ত বা ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গা ছাড়া ভাবও দেখা যায়।
তবে গত বছরের ফুলপরী খাতুনের বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে তা নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সেসময় তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গড়িমসির অভিযোগ ওঠে। এরপর ফুলপরীর ঘটনা উচ্চ আদালতে গড়ায়।
তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাফিলতি খুঁজে পাওয়ায় কর্তৃপক্ষকে তিরস্কারও করে আদালত। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এরপর অভিযুক্ত পাঁচ শিক্ষার্থীকে প্রথমে সাময়িক বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ, পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক জ্যেষ্ঠ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “র্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন বন্ধে ছাত্রলীগের কোনও উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে সংগঠনের ভেতরে কখনও কোনও আলোচনাও হয় না। নেতারা ব্যস্ত থাকেন নিয়োগ বাণিজ্য আর ঠিকাদারি কাজের কমিশন আদায়ে। এসব ঘটনার দায় সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। কারণ এই দুই নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এসব ঘটনা ঘটে।”
অবশ্য ছাত্রলীগ সবসময় র্যাগিংয়ের ঘটনার বিরুদ্ধে বলে নিজের অবস্থান পরিস্কার করলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “সংগঠনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কেউ কেউ এসব ঘটনা ঘটায়। এর দায় শুধু ঘটনায় জড়িতদের। সংগঠন কোনোভাবেই এর দায় নেবে নেবে না। আমি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।”
গত ৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ভুক্তভোগী হল কর্তৃপক্ষের কাছে বলেননি জানিয়ে লালন শাহ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আকতার হোসেন বলেন, “পত্রপত্রিকায় খবর দেখে আমি ঘটনাটি জানতে পারি। বিষয়টি আমরা যথেষ্ঠ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি।”
কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আকতার হোসেন বলেন, “আপনি যতটুকু জানেন আমি শিক্ষক হিসেবে তার চেয়ে অনেক বেশি জানি। আপনি তো বোঝেন বাস্তবতার কারণে অনেক কিছু করা যায় না। অনেক সময় তথ্য প্রমাণ লোপাট করার কারণে কিছু করা কষ্টকর হয়ে যায়।”
ঘটনা সম্পর্কে জানতেন না প্রক্টর শাহাদত হোসেনও। তিনি বলেন, “ঘটনাটি জানার পরপরই প্রক্টোরিয়াল বডির জরুরি মিটিং আহ্বান করা হয়। সেসময় হল প্রভোস্টকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি আমাদের কোনও তথ্য দিতে পারেননি। উল্টো প্রভোস্ট বলেন, স্যার বিষয়টি ওরা নিজেরা মিটমাট করে নিয়েছে।”
এরপরও হল কর্তৃপক্ষ কিছু জানায়নি অভিযোগ করে প্রক্টর বলেন, “পরে পত্রপত্রিকা দেখে আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি।”
৭ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা গুরুত্বে সঙ্গে দেখা হচ্ছে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এইচ এম আলী হাসান বলেন, “ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। লালন শাহ হলের আবাসিক শিক্ষক ড. আলতাব হোসেন এ কমিটির প্রধান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক হেলাল উদ্দিন ও বিবিএ বিভাগের শিক্ষক আব্দুল হালিম। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।”