Beta
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫

ফরিদা পারভীন : লালনের গান আখড়া থেকে বিশ্ব মঞ্চে নেওয়ার কারিগর

farida-parvin-1
[publishpress_authors_box]

লালন সাঁইয়ের গান যার কণ্ঠ ধরে আখড়া থেকে শহুরে মধ্যবিত্তের ড্রইং রুম হয়ে বিশ্ব মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার কারিগর হিসাবে যাকে দেখা হয়, তিনি ফরিদা পারভীন।

সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি দেশে ভূষিত হন একুশে পদকে, জাপানের ফুকুওয়াকা অ্যাওয়ার্ড তাকে দেয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, তার জীবনী লিখেছেন ফরাসি লেখক।

বাংলার লোকসঙ্গীতের বরেণ্য এই শিল্পী শনিবার রাতে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। তার ৭১ বছরের জীবনের ৫৫ বছরই কেটেছে সঙ্গীত সাধনায়, বিশেষ করে লালন সঙ্গীতে। সেই কারণে তাকে ‘লালন সম্রাজ্ঞী’ নামেও ডাকা হয়।

ফরিদা পারভীনের জন্ম ১৯৫৪ সালে ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়ায়। পারিবারিক সূত্রেই গানের প্রতি ছিল টান। শুরুতে নজরুলসঙ্গীত, আধুনিক গান দিয়ে ফরিদা পারভীনের গানের যাত্রা শুরু হলেও পরে লালনের গানেই নিবেদিত করেন নিজেকে।

এক সাক্ষাৎকারে ফরিদা পারভীন বলেছিলেন, কুষ্টিয়ার স্থানীয় এক হোমিও চিকিৎসক তার কাছে লালনের গান শুনতে চাইতেন। তার আগ্রহেই লালনের গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। এরপর লালন সঙ্গীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মকসেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নেন।

এই গানের মধ্য দিয়ে লালন তার অস্তিত্বে গেঁথে গিয়েছিল। তা ভাষায়, “এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি, কী আছে লালনের গানে। তার গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিক কথা ও দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এ পর্যায়ে অনুভব করি, লালন তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনবদ্য এক স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। এটা বোঝার পর লালনের গান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।”

২০২৩ সালে দেশ রূপান্তরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লালনের গানকে জনপ্রিয় করে তোলা নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, “যেই না ফরিদা পারভীন গেয়ে উঠল, লোকজন একটু নড়েচড়ে বসল। ফকির-ফাকরার গান, এত সুন্দর হলো কীভাবে? এত ভালো লাগছে কী করে?

“এরপর ড্রয়িংরুমে লালনের গানের একটি সিডি রাখতেও সম্মানিত বোধ করতে শুরু করেন একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাও ফরিদা পারভীনের সিডি। তখন কেউ কেউ ভাবল, এটা তো মানুষের কাছে খুব সমাদৃত হচ্ছে, তাহলে ধরো, এই গানটাই করতে হবে!”

“ফকিররা কখনও ঢাকা পর্যন্তও আসতে পারেননি সাঁইজির গান নিয়ে, তার পেছনেও আমার গুরুর অবদান রয়েছে। তাদের তো বাংলা একাডেমির প্রোগ্রামে আনা হয়, কিন্তু থাকার জায়গাও দেওয়া হয় না। তারা হাই কোর্টের মাজারেই ছিলেন। এখন তারা আমেরিকা পর্যন্ত যাচ্ছেন। এতে আমার অবদানের কথা বলব না, বলব সব অবদান আমার গুরুর।”

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে লালনের গানকে পৌঁছে দিতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথাও সেই সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছিলেন ফরিদা পারভীন।

তিনি বলেছিলেন, “সুইডেনের রানির গ্রামের বাড়িতে সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসাবে গিয়েছিলাম। শাহনাজ রহমতুল্লাহ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশীসহ আরও শিল্পী ছিলেন। আমি যখন ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’ গেয়ে শেষ করলাম, দেখি রানি কাঁদছেন, আমিও কাঁদছি। পরে তিনি বললেন, ‘তোমার গানের অর্থ আমি বুঝিনি, কিন্তু এই গানে যে গভীর বেদনা রয়েছে, সেটি তোমার গায়কির মাধ্যমে আমার অন্তরে এসে লেগেছে। মনে হয়েছে, তোমার মধ্যে ঈশ্বর বাস করছে।’

“এছাড়া আমি টিমসহ মরক্কোতে গিয়েছি, যেখানে আমি ছাড়া বাংলাদেশের কোনও আর্টিস্ট গান করতে যাননি। আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, ফ্রান্সসহ কত দেশে কত দারুণ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। কদিন আগেই বেলজিয়ামের একটি দলের সঙ্গে আমরা আন্তর্জাতিক কোলাবোরেশন করেছি, সেখানকার বিখ্যাত দাদা রেকর্ডিং স্টুডিওতে। ওদের ছয়টি আর আমাদের ছয়টি গান করেছি, অনবদ্য হয়েছে, যা তারা আর্কাইভ করবে। এমন অনেক কাজ হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।”

জাপানের ‘ফুকওয়াকা অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়ার সম্মানের সঙ্গে বেদনার কথাও বলে গিয়েছিলেন ফরিদা পারভীন।

“এই অ্যাওয়ার্ড যখন পেলাম তখন সেখানে আরও বিভিন্ন দেশের প্রখ্যাত শিল্পীরা একই সম্মাননা পান। তাদের সম্মানে প্রতিটি পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশের মন্ত্রীরা চলে এসেছেন। কিন্তু আমাদের দেশের অ্যাম্বাসাডরেরও সময় হয়নি, ফার্স্ট সেক্রেটারি না কাকে পাঠিয়েছে। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, তখন আয়োজকরা সাফ জানিয়ে দেন, এত নিম্ন পদের লোকের সঙ্গে তার দেখা করা যাবে না! তখন আমার কী পরিমাণ কষ্ট হয়েছিল ভাবুন! এসব নানা কারণে দেশের প্রতি একই সঙ্গে রাগ হয়, আবার মায়া হয়।”

লালন সঙ্গীতের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়ার কথা সেই সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ফরিদা পারভীন।

তার ভাষায়, “এটা ঠিক যে, আমি শুরু থেকেই লালন ফকিরের গানের চর্চা করিনি। আমার গানের শিক্ষা একেবারে সঙ্গীতের যে মূল অংশটি, সেখান থেকেই অর্থাৎ ক্লাসিক্যাল মিউজিক দিয়েই আমার যাত্রা শুরু। গুরু ধরে শেখা যাকে বলে আর কী, সেভাবেই তালিম নিয়েছি। দীর্ঘদিন ধরে ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতই চর্চা করেছি।

“বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হিসেবে আমরা সবকিছুতেই কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আস্তে আস্তে সব আবার আগের মতো করার চেষ্টা করা হলো সর্বমহলে। তেমনভাবেই লালন ফকির কুষ্টিয়াতে যে দোল পূর্ণিমা পালন করতেন, সেটির প্রচলন শুরু হলো। ঢাকা থেকে অনেক গণ্যমান্য শিল্পী সেই প্রোগ্রামে গিয়েছিলেন। তখন তো আমি মাত্র এসএসসি পাস করেছি, তেমন কাউকে চিনিও না। যা হোক, সেই প্রোগ্রামে লালনের গান প্রথমবারের মতো গাওয়ার জন্য রীতিমতো জোর করতে থাকলেন আমার গুরু মোকসেদ আলী সাঁই।”

মকসেদ আলী অনেক দিন ধরে একটি পরিশীলিত কণ্ঠ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, যাকে নিয়ে লালনের গানকে সমৃদ্ধ করা যায়। ফরিদা পারভীনকে পেয়ে তার খেদ ঘুচে যায়।

ফরিদ বলেন, “পরিষ্কার করে বলতে গেলে, লালন ফকিরের গান এতদিন আখড়াতেই গাওয়া হতো। আর আপনি যদি সঙ্গীত বলেন, সেটি হলো গুরুমুখী বিদ্যা। সাতটি স্বরের সঙ্গে গলা মেলাতে হয়, তাল, লয়, উচ্চারণ সবটাই শিখতে হয়। কিন্তু ফকিররা লালনের গান করতেন ভাবের মধ্যে থেকে। সেই কারণে কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা ছিল লালনের গায়কিতে। গানগুলো সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি তখন। ফকিররা সাঁইজির কালামকে পুঁজি করে ভিক্ষা করে বেড়াতেন! এসব কথা যারা একটু গবেষণা করেন তারা সবাই জানেন।

“যা হোক, এসব কারণেই আমার গুরু আমাকে লালনের গান কণ্ঠে তুলতে বারবার বোঝালেন। কিন্তু আমার মনে হতো আমি ক্লাসিক্যাল গানের চর্চা করি, আর তখন আমি ছোট মানুষ হলেও কুষ্টিয়াতে নজরুলের গানের জন্য আমার পরিচিতি ভালোই তৈরি হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল থেকেই রাজশাহী বেতারে আমি নজরুলের গান করি। তাই আমার গুরু অনেক করে বোঝালেও আমি মন থেকে সায় দিতে পারছিলাম না। কারণ এখন যেমন দুটি গান মুখস্থ করেই রিয়েলিটি শোতে এসে লাখ লাখ টাকা, গাড়ি, বাড়ি পেয়ে যাচ্ছে অনেকে। তখন তো সেই সুযোগ ছিল না। শিল্পীরা মনে করত, আমি গান গাইতে পারছি, মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি, এটাই তো বড় বিষয়।

“একপর্যায়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও লালনের গান করি। সত্য বল, সুপথে চল, ওরে আমার মন গানটি দিয়েই সাঁইজির কালাম কণ্ঠে তুলে নিলাম।  এরপর তো আমার গুরু আমাকে শেখালেন। গুরুজি আমাকে বলেছিলেন- ‘তুই একটি মাত্র গান কর, মানুষ যদি পছন্দ না করে আর কখনও গাইতে বলব না’। কিন্তু সেই প্রথম গানেই একেবারে সাড়া পড়ে গেল রীতিমতো। তাই আর আমি সাঁইজির কালাম ছাড়তে পারলাম না!”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত