আদালতে যখন হাইপ্রোফাইল কিংবা দুধর্ষ কোনও অপরাধীর বিচারের দিন নির্ধারিত থাকে, স্বাভাবিকভাবেই সেদিন নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যা নিশ্চিত করে ওই আসামির নিরাপত্তা, পাশাপাশি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাও।
তবে ভিআইপি এসব আসামির জন্য নেওয়া কঠোর নিরাপত্তা বলয় মাঝেমাঝে সাধারণ বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি যার মুখোমুখি হচ্ছে দেশের বিভিন্ন আদালতপ্রাঙ্গণ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার ভার নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। প্রতিবারের মতো এবারও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে হত্যা মামলা থেকে শুরু করে নানা ধরনের মামলার হিড়িক।
বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ড শুনানিতে এখন সরগরম আদালতপাড়া। এক সময়ের হাইপ্রোফাইল এসব আসামিদের আদালতে আনা-নেওয়াকে কেন্দ্র করে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে সাধারণ আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের।
সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা বলছেন, এই আসামিরা আগেও ভিআইপি ছিলেন, মামলার আসামি বা অভিযুক্ত হওয়ার পরেও ভিআইপিই থাকছেন। আর তাদের জন্য নানা বিড়ম্বনায় পড়ছেন সাধারণ মানুষ।
ঢাকার নিম্ন আদালতপাড়ায় কথা হলো তেমনই কয়েকজন সাধারণ বিচারপ্রার্থী আর আইনজীবীর সঙ্গে।
গত কয়েকদিনের চিত্র বর্ণনা করে তারা বললেন, সাত সকালে ভিআইপি আসামিদের জন্য আদালত প্রাঙ্গণে থাকে কড়া নিরাপত্তা। সাধারণ আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের বার বার নিরাপত্তা তল্লাশির মুখে পড়তে হয়। অনেক সময় আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশেও বাধার মুখে পড়তে হয়।
এই ভোগান্তি থেকে মুক্তির জন্য ভিআইপিদের বিচারে বিশেষ আদালত গঠনের দাবিও জানালেন তারা।
প্রতিদিন সকালে মামলার হাজিরা ও দরখাস্ত শুনানি নিয়ে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে দৌড়াতে হয় আইনজীবী রাজিব হাসানকে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সকাল ভোরে কারাগার থেকে তাদের আদালতে নেওয়া হয়। এসব ভিআইপি আসামিকে আদালতে আনা-নেওয়ার সময় সেনাবাহিনী, পুলিশ কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। তখন সিএমএম আদালতে প্রবেশের দুই পাশের প্রধান দুটি ফটকই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের চেকিং।
“এসব কার্যক্রম চলতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত ভিআইপি আসামিদের কারাগারে নেওয়া হচ্ছে। আমি না-হয় আইনজীবীর পরিচয়ে কোর্ট অঙ্গণে প্রবেশ করতে পারি। কিন্তু আমার যারা ক্লায়েন্ট তারা তো পারেন না। ফলে দীর্ঘসময় তাদের সিএমএম আদালতে প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।”
গত ৩ মাস ধরে এই ভোগান্তি চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর একটা সুরাহা হওয়া উচিত।
ঢাকার সিএমএম আদালতে প্রতারণার এক মামলায় বাদীপক্ষে হাজিরা জমা দিতে এসেছিলেন আইনজীবী ফয়সাল আহমেদ। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রতিদিনই সকালে কোনও না কোনও ভিআইপি আসামিকে আদালতে আনা হচ্ছে। ভিআইপি আসামিদের জন্য সকাল থেকেই আমাদের দুর্ভোগ শুরু হয়। অনেক সময় পুলিশের বাধার মুখে পড়ে ক্লায়েন্টের সামনে অপমানিতও হতে হয়েছে।”
ভিআইপি আসামিদের জন্য বিচারপ্রার্থীদের আদালত প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ভোগান্তির স্বীকার হতে হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর ফলে বিচার ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটছে, মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে।
সে কারণে ভিআইপি আসামিদের জন্য বিশেষ আদালতের ব্যবস্থা করার দাবি জানালেন তিনি।
আগেই ভিআইপি আসামিদের জন্য বিশেষ আদালত গঠন করা হয়েছে দেশে, ফলে এবারও তা করা যেতে পারে বলে মনে করেন ফয়সাল। এতে অন্তত সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে।
ঢাকার সাভার থেকে বিমানন্দর থানার এক মামলায় হাজিরা দিতে এসেছিলেন রুবেল আহমেদ।
তিনি বলেন, “মামলার হাজিরার জন্য প্রতিটি ধার্য তারিখে সকাল ৯টার মধ্যে আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকতে হয়। আগে অনেক সময়ে ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে কাজ শেষ করে সাড়ে ৯টার দিকে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিতে পারতাম। তবে গত ৩ মাস ধরে তা আর হচ্ছে না। আগের সময়ে আদালত পৌঁছলেও ভিআইপি আসামিদের কারণে কোর্টের ভেতরে ঢুকতে পারি না।
“যদি আদালতে কোনোমতে ঢুকেও পড়ি, হাজিরা দিতে গিয়ে দেখি জিআরও শাখাও ভিআইপি আসামিদের নিয়ে ব্যস্ত। ভিআইপিদের কাজ শেষ হলে তারপর আমাদের হাজিরা নেওয়া হয়।”
ঢাকা সিএমএম আদালতের হাজতখানার ওসি কারুজ্জামান বললেন, “আদালতে আসামিদের আনা নেওয়ার বিষয়ে আমাদের কোনও হাত নেই। আমরা শুধুমাত্র ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করি। মূলত কোনওে ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। তারই একটি অংশ এটা।”
আদালত চত্বরে বিশৃঙ্খলা এড়াতেই বিশেষ আসামিদের সকালে হাজির করা হয় বলে জানালেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন বিভাগ) তারেক জুবায়ের।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নিরাপত্তার স্বার্থে স্পেশাল আসামিদের সকাল সকালে আনা হয়। যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। এরই মধ্যে কয়েকদিন দুপুরে আসামি আনা-নেওয়া কেন্দ্র কিছুটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। এখন আসামিদের সকালে আনায় কোনও ঝামেলা হচ্ছে না।”
নিরাপত্তার স্বার্থে সিএমএম আদালতের বাইরের ফটক বন্ধ রাখা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সাধারণত সকাল ৯টার আগেই সব শুনানি শেষ হয়ে যায়। ফলে সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা বা অন্য কারও তো এ নিয়ে ভোগান্তি হওয়ার কথা নয়!”