এক সপ্তাহ আগে মনেই হচ্ছিল, কট্টর ডানপন্থীদের কব্জায় যাচ্ছে ফ্রান্স; ইতিহাস গড়ে তারা বসতে যাচ্ছে ক্ষমতায়।
তবে প্রথম দফা ভোটের পর একাট্টা হয় বাম জোটগুলো; তাতে ফলও পেয়েছে। দ্বিতীয় দফার ভোটে স্বপ্ন ভঙ্গ হচ্ছে ডানদের। বামরাই জিতেছে পার্লামেন্টের বেশির ভাগ আসনে।
তবে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনও জোটই পাচ্ছে না, তা স্পষ্ট। ফলে সংকট থেকেই যাচ্ছে। কারণ ঝুলন্ত একটি পার্লামেন্ট হতে যাচ্ছে ইউরোপের দেশটিতে।
পার্লামেন্টের এই নির্বাচন অবশ্য ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর পদের ওপর কোনও প্রভাব ফেলছে না। কারণ সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আলাদাভাবে হয়।
প্রেসিডেন্ট পদে ম্যাক্রোঁর মেয়াদ আরও তিন বছর রয়েছে। তবে তারও সমস্যা রয়েছে অন্য খানে। অর্থনীতি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় জনপ্রিয়তা হারানো ম্যাক্রোঁকে বাকি তিন বছর সরকারের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পদে পদে জটিলতায় পড়তে হতে পারে।
ফ্রান্সে পার্লামেন্টে আসন সংখ্যা ৫৭৭টি। ফলে সরকার গঠন করতে হলে প্রয়োজন ২৮৯টি আসন।
গত ৩০ জুন প্রথম ধাপের নির্বাচন হয়। তাতে মারিন লো পেন নেতৃত্বাধীন কট্টর ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালির জয়জয়কার দেখা যাচ্ছিল। অনেকে মনেই করছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম ফ্রান্সের ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে ডানরা।
তবে দেশটির নিয়ম অনুযায়ী, কোনও আসনে কোনও প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে দ্বিতীয় দফার ভোট হয়। তাতে শীর্ষ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পাশাপাশি সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি ভোট যারা পান, তারাই কেবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসেন।
রবিবার দ্বিতীয় দফা ভোটের পর দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ আসনে জয়ী হয়েছে বামপন্থী দলগুলোর জোট।
প্রথম দফার ভোটে চাঙা হয়ে ওঠা অভিবাসনবিরোধী দল ন্যাশনাল র্যালিকে হতাশ হতে হলো দ্বিতীয় ধাপে এসে।
ভোট গণনা শেষে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পার্লামেন্টের দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে বামপন্থীদের জোট নুভো ফ পপুলেয়ার (এনএফপি) পার্লামেন্টের ৫৭৭টি আসনের মধ্যে সর্বাধিক ১৮২টি আসনে জয় পেয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বাধীন উদার-মধ্যপন্থি এনসেম্বল জোট পেয়েছে ১৬৮টি আসন। আর প্রথম ধাপের নির্বাচনে এগিয়ে থাকা ন্যাশনাল র্যালি নেতৃত্বাধীন জোট ১৪৩টি আসনে জয় পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে।
৩০ জুন ফ্রান্সে প্রথম ধাপের নির্বাচনে ন্যাশনাল র্যালি নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী জোট ৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে শীর্ষে অবস্থান করে। এরপর নুভো ফ পপুলেয়ার জোট ২৮ শতাংশ ও ম্যাক্রোঁর এনসেম্বল জোট ২০ শতাংশ ভোট পায়।
তবে দ্বিতীয় দফার ভোটে ফল গেছে উল্টে। মারিন লো পেনের জোট শীর্ষ থেকে নেমে গেছে তৃতীয় স্থানে, বামপন্থীরা দ্বিতীয় থেকে উঠে এসেছে শীর্ষে, মধ্যপন্থীরা তৃতীয় থেকে উঠে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে।
দৃশ্যত মূলত ডানদের ঠেকাতে বামদের মরিয়া চেষ্টায় ব্যাপক সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিই ফল পাল্টে দিয়েছে।
রবিবার দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ব্যাপক ভিড় জমায় ফরাসিরা। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রবিবার বিকালের দিকে ভোটগ্রহণের হার ছিল ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ১৯৮১ সালের পর সর্বোচ্চ।
বিবিসি জানিয়েছে, দ্বিতীয় ধাপের ভোটগ্রহণের হার ৩০ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের থেকে বেশি ছিল। ১৯৮১ সালের পর এই প্রথম এত বিপুল সংখ্যক ফরাসি ভোটের মাধ্যমে তাদের রায় জানায়।
ফরাসি দৈনিক লা মঁদের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনে মারিন লো পেনের কট্টর ডানপন্থী জোট, ম্যাক্রোঁর উদার-মধ্যপন্থি জোট বা বামপন্থীদের জোট কেউই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।
এর ফল কী হতে পারে, সে সম্পর্কে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে বলেছে, কোনও দল নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য পর্যাপ্ত আসন না পাওয়ায় ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পেতে যাচ্ছে ফরাসিরা।
অর্থাৎ ফ্রান্সের পার্লামেন্ট এখন কয়েকটি রাজনৈতিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়বে, যাদের মত-পথ একেবারেই ভিন্ন। একসঙ্গে কাজ করার ইতিহাসও তাদের তেমন একটা নেই বললেই চলে।
ঝুলন্ত পার্লামেন্ট ফ্রান্সকে রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে ঠেলে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
ফ্রান্সের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গেব্রিয়েল আতাল সোমবার পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু তার উত্তরসূরি কে হবেন, তানিয়ে ব্যাপক ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
নির্বাচনে জয়ের খবরে ফ্রান্সের কট্টর বামপন্থী দল লা ফ্রান্স আসুমিজের (এলএফআই) নেতা জঁ লুক মেলোশঁ বলেছেন, “নুভো ফ পপুলেয়ারকে দেশ শাসনের জন্য ডাকা প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর এখন দায়িত্ব। ভোটের ফল তাকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে।”
৩০ জুন প্রথম ধাপের নির্বাচনের তিন সপ্তাহেরও কম সময় আগে চারটি বাম দল নুভো ফ পপুলেয়ার জোট গঠন করে। এই জোটে আছে লা ফ্রান্স আসুমিজ (এলএফআই), সোশালিস্ট পার্টি, গ্রিনস ও ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টি।
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নির্বাচনে লা ফ্রান্স আসুমিজ ৭৪টি আসন, সোশালিস্ট পার্টি ৫৯টি আসন, গ্রিনস ২৮টি ও কমিউনিস্ট পার্টি ৯টি আসনে জয় পেয়েছে।
জঁ লুক মেলোশেঁর পাশাপাশি বামজোটের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন গ্রিনস এর মারিন তুন্দলিঁয়ে, সোশালিস্ট পার্টির অলিভিয়ের ফোরে, কমিউনিস্ট পার্টির ফ্যাভিয়ান রাসেল।
দ্বিতীয় ধাপের ভোটের ফল নিয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ এখনও কোনও মন্তব্য করেননি। তবে ন্যাশনাল র্যালির নেতা জরদান বারদেলা বলেছেন, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সকে ‘অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতার’ মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো।
এ বছরের জুনের শুরুতে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ম্যাক্রোঁর উদার-মধ্যপন্থী জোটকে পরাজিত করেছিল মারিন লো পেনের ন্যাশনাল র্যালি। এরপরই হঠাৎ আগাম নির্বাচনের ডাক দিয়ে ফ্রান্সের জনগণের পাশাপাশি মিত্রদের অবাক করেন প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ।
ম্যাক্রোঁর আগাম নির্বাচনের ডাক শেষ পর্যন্ত কোনও সুফল বয়ে আনেনি বলে মনে করছেন ফ্রান্সের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ম্যাক্রোঁর মিত্র এদুয়ার্দ ফিলিপ।
তিনি বলেন, আগাম নির্বাচন ডেকে ম্যাক্রোঁ জুয়া খেলেছেন, যা ‘বড় ধরনের অনিশ্চয়তার’ সামনে ফ্রান্সের জনগণকে দাঁড় করাল।