এক টানা তিন দশক পশ্চিমবঙ্গ শাসন করে আসা বাম ফ্রন্ট এখনও নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে। গতবারের মতো এবারের লোকসভা নির্বাচনেও এই রাজ্যে শূন্য হাতেই ফিরতে হচ্ছে তাদের।
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের ঘোষিত ফলে দেখা যাচ্ছে, সারা ভারতে চারটি আসনে জিততে যাচ্ছে ফ্রন্টের সবচেয়ে প্রভাবশালী দল সিপিএম, দুটি আসনে এগিয়ে আছে সিপিআই। আর পশ্চিমবঙ্গে তারা কোনও আসনই পাচ্ছে না।
পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস ২৯ আসনে জয়ী হচ্ছে বলে খবর এসেছে আনন্দবাজার পত্রিকায়। বিজেপির আসন কমে দাঁড়াচ্ছে ১২টিতে। বাকি একটি আসন জুটছে কংগ্রেসের ভাগে।
লোকসভার ৫৪৫টি আসনের মধ্যে ছয় সপ্তাহে সাত দফায় ৪৪৩টি আসনে ভোটগ্রহণের পর মঙ্গলবার একযোগে ফল ঘোষণা হচ্ছে।
বুথফেরত জরিপ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বড় জয়ের বার্তা দিলেও ঘোষিত ফলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতায় টিকে যাচ্ছে। তবে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট ধারণার চেয়ে ভালো ফল করছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ১৯৭৭ সালে বাম ফ্রন্ট ক্ষমতায় যাওয়ার পর জাতীয় নির্বাচনেও তাদের সাফল্য ছিল আকাশ ছোঁয়া। লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের অধিকাংশ আসন লাল শিবিরের দখলেই থাকত।
৩৪ বছর পর ২০১১ সালে বাম ফ্রন্ট রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পর লোকসভা নির্বাচনেও তাদের ভরাডুবি ঘটে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বাম ফ্রন্টের মধ্যে শুধু সিপিএম দুটি আসনে জেতে পশ্চিমবঙ্গে। তৃণমূলের জয়জয়কারের মধ্যে শুধূ মহম্মদ সেলিম ও সূর্যকান্ত মিশ্র লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে রাখতে পেরেছিলেন।
অথচ ২০০৯ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে শুধু সিপিএমেরই আসন ছিল ৯টি, জোটের অন্য দলগুলো জেতে ৬টি আসনে।
এরপর ২০১৯ সালে সিপিএম তথা বাম ফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে কোনও আসনেই জিততে পারেনি। ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৯টিতে বাম প্রার্থীদের জামানত খোয়া যায়।
পাঁচ বছর পর এবারের লোকসভায়ও তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে শূন্য হাতে ফিরলেও তামিলনাড়ু, কেরালা, রাজস্থানের কয়েকটি আসনে জিতে লোকসভায় নিজেদের প্রতিনিধিত্ব টিকিয়ে রাখতে যাচ্ছে বাম ফ্রন্ট।
এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে থাকা বাম ফ্রন্টের ভারতে স্বাধীনতার পর নির্বাচনী রাজনীতিতে ছিল শক্তিশালী অবস্থান।
১৯৫১-৫২ সালে প্রথম লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের (৩৬৪ আসন) পরই ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই)। ১৬টি আসনে জিতে দ্বিতীয় স্থানে ছিল তারা।
১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইর আসন সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ২৭। সেবারও তাদের অবস্থান ছিল ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের পরে। ১৯৬২ সালে তৃতীয় লোকসভা নির্বাচনে বামদের আসন আরও বেড়ে হয় ২৯টি।
এরপর রুশ-চীন দ্বন্দ্বে বিশ্বেই কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। তার প্রভাবে ভারতের সিপিআইও ভেঙে যায়। গঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মাক্সিস্ট) বা সিপিএম।
সেই বিভাজন নিয়ে দেশটির ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বামরা। ফলাফলে উপরের দিকে থাকা প্রথম তিনটি দলের মধ্যে ছিল না সিপিআই বা সিপিএমের নাম। তবে সিপিআই ২৩টি এবং সিপিএম ১৯টি আসনে জয়ী হয়।
বিভক্ত হওয়ার ফলে ভোটের রাজনীতিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল, তা দ্রুতই কাটিয়ে ওঠে বামরা। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে আবার ২৫টি আসনে জিতে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসে সিপিএম, তৃতীয় অবস্থানেও ছিল আরেক বাম দল সিপিআই, ২৩টি আসন নিয়ে।
১৯৭৭ সালের নির্বাচনেও কংগ্রেসের পর বেশি আসন (২২টি) পেয়েছিল সিপিএম।
ভারতের বামপন্থিরা লোকসভায় সবচেয়ে বেশি আসনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল ১৯৮০ সালে। তৃতীয় বৃহৎ দল হিসেবে সিপিএম সেবার ৩৭টি আসনে জয় পায়।
সেই ধারা অবশ্য পরের ১৯৮৪ সালের ভোটে ধরে রাখতে পারেনি সিপিএম। সেবার তাদের আসন কমে দাঁড়ায় ২২।
এরপর ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে সিপিএম ৩৩টি আসনে জয় পেয়ে লোকসভায় চতুর্থ বৃহৎ দল হয়। সে বছর প্রাপ্ত ভোটের দিক দিয়ে শীর্ষ তিন দল ছিল যথাক্রমে কংগ্রেস, জনতা দল (জেডি) ও বিজেপি।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে যথাক্রমে ৩৫টি ও ৩২টি আসনে জয় পায় সিপিএম। এরপর ১৯৯৮ সালে আগের নির্বাচনের মতো একই সংখ্যক আসনে অর্থাৎ ৩২টি আসনে জয়ের মাধ্যমে লোকসভায় অবস্থান শক্ত করে সিপিএম। এর পরের বছরের নির্বাচনে দলটির আসন বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩।
২০০৪ সালের নির্বাচনে আগের চেয়ে আরও ১০ আসন বাড়িয়ে লোকসভায় তৃতীয় দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে সিপিএম।
এরপরই বামপন্থিদের উল্টোরথ শুরু হয়। ২০০৯ থেকে সর্বশেষ ২০১৯ সাল পর্যন্ত পরপর তিনটি লোকসভা নির্বাচনে তাদের ভোট কমতে থাকে। ২০০৯ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে দুবারই ৯টি করে আসনে জয় পায় সিপিএম। ২০১৯ সালের নির্বাচনে জেতে ৩টি আসনে।
এবার সম্পূর্ণ ফল এখনও ঘোষণা না হলেও সিপিআই ও সিপিএমের আসন আগের চেয়ে দুই-একটি বাড়ছে বলে আভাস মিলছে।