ঐতিহাসিক দ্বিতীয় দফার গণনা শেষে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন বামপন্থী রাজনীতিবিদ অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে। ১৯৮২ সাল থেকে শুরু করে গত ৮টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফাতেই জয় নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এবারই প্রথম তা দ্বিতীয় দফার গণনায় গড়ায়।
প্রথম রাউন্ডে কোনও প্রার্থী মোট ভোটের ৫০ শতাংশ ভোট জিততে পারেননি। দিসানায়েকে পেয়েছিলেন ৪২.৩১ শতাংশ। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা পেয়েছিলেন ৩২.৭৬ শতাংশ।
তবে দ্বিতীয় রাউন্ডের গণনায় তথা ভোটারদের দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থীদের ভোট গণনায় দিসানায়েকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন।
শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে অন্তত ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হয়। তবে কোনও প্রার্থী তা না পেলে অগ্রাধিকার ভোটের ভিত্তিতে বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়।
এজন্য নিয়ম অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সময় ভোটাররা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দের প্রার্থীও বাছাইয়ের সুযোগ পায়। তবে চাইলে কেউ শুধু একজন পছন্দের প্রার্থী বা প্রথম ও দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে দুজনকেও বাছাই করতে পারে।
ভোটদান শেষে গণনার সময় প্রথম ধাপে ভোটারদের প্রথম পছন্দের প্রার্থী বাছাই করা হয়। তাতে কেউ এককভাবে অন্তত ৫০ শতাংশ ভোট না পেলে ভোটপ্রাপ্তিতে প্রথম ও দ্বিতীয় হওয়া প্রার্থীকে রেখে বাকি প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হয়। এরপর বাদ পড়া প্রার্থীদের ব্যালটগুলোতে অগ্রাধিকার ভোট বা দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থী হিসেবে পাওয়া ভোট গণনা করে বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়।
দিসনায়েকে সুশাসন এবং দুর্নীতিবিরোধী কঠোর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রীলঙ্কার ভোটারদের মন জয় করে নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কা প্রথমবারের মতো কোনও বামপন্থী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছে।
দুবছর আগে ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালানোর পর শনিবার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে দেশটিতে।
গত কয়েক দশকের মধ্যে ২০২২ সালে নজিরবিহীন এক অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা, যার জেরে গণঅভ্যুত্থানের মুখে রাজাপাকসে পরিবারকে ক্ষমতা হারাতে হয়। শ্রীলঙ্কার জনগণ সেসময় তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের বাসভবন ও কার্যালয় দখল করে নিয়েছিল।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে প্রথমবার এমন আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল শ্রীলঙ্কাকে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে কার্যত দেউলিয়া হয়ে যায় তারা। সেই আর্থিক সংকটের আবহে ২০২২ সালের গণঅভুত্থানে রাজাপাকসে সরকারের পতন হয়।
জনবিক্ষোভের জেরে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে।
তারপর পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটাভুটিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে।
সেই অর্থনৈতিক সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠলেও এখনও পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি দেশটি। এমন পরিস্থিতিতেই শনিবার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেন শ্রীলঙ্কার ভোটাররা।
৫৫ বছর বয়সী অনুড়া কুমারা দিসানায়েকে দেশটির বামপন্থী জনতা বিমুক্তি পেরেমুনা (জেভিপি) পার্টির নেতা। দলটি কখনও শ্রীলঙ্কার কোনও সরকারের সঙ্গে জোটে ছিল না। এমনকি ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) নামের যে জোট থেকে দিসানায়েকে নির্বাচন করেছেন, সেই জোটও তেমন কোনও আলোচনায় ছিল না বহুদিন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে শ্রীলঙ্কার ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে এই জোট মাত্র তিনটি আসন জিতেছিল।
তারপরও এই জোট এবার নির্বাচনে ভালো করেছে, আর এর পেছনের কারিগর হলেন দিসানায়েকে। ২০২২ সালে ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারকে উৎখাতে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলতে সক্রিয় ছিল দিসানায়েকের নেতৃত্বাধীন জেভিপি।
গণঅভ্যুত্থানের সময় ও পরে দিসানায়েকে হয়ে ওঠেন জনগণের আস্থার জায়গা। রাজাপাকসে পরিবারের পলায়নের পর রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেখানে বড় পরিবর্তনের ডাক দেন তিনি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার তিনি আগে থেকেই ছিলেন, সঙ্গে যুক্ত করেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা, রয়টার্স