দেশে চলছে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক যুগসন্ধিক্ষণ। শত শত মানুষ, ছাত্র, শ্রমিক, জনতা এবং শিশু-কিশোরের প্রাণের বিনিময়ে ফিরে পাওয়া গেছে এক সম্ভাবনা, দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলি চালিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ সংস্কার হবে বলেই ভাবছে সবাই। এই সবার মধ্যে যেমন রয়েছে সমতলের মানুষ, তেমন আছে পাহাড়ের মানুষেরাও। যে আশায় বুক বেঁধে আছে মুসলিম, একই রকমের প্রত্যাশা রাখছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীরাও। পুরুষের মতন অপুরুষ অর্থাৎ নারী ও অন্যান্য লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষেরাও নিজের নিজের জায়গা থেকে অধিকার চাইছে, চাইছে লৈঙ্গিক সমতা। এরই অংশ হিসেবে গত ১৭ অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেওয়া হয় এক অভিনব কর্মসূচি— ‘মেয়েরা রাত দখল করো’।
এই কর্মসূচির শুরুটা নিয়ে একটু বলা উচিৎ। পাশের দেশ ভারত, যাকে কিনা অনেকেই বন্ধু রাষ্ট্র মনে করে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সম্প্রতি একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। নৃশংস সেই ধর্ষণের বিচারের দাবিতে সরব হয় সে রাজ্যের নারীসমাজ। ‘মেয়েরা রাত দখল করো’— এই কর্মসূচির মাধ্যমে অপরাধীদের সাজা দাবি করা হচ্ছে, নারীর জন্য নিরাপদ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবি উঠছে। তার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-তে মেয়েদের রাত দখলের ডাক আসে। কলকাতা ও ঢাকার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও পালিত হয় রাত দখলের কর্মসূচি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েরা এমনিতেই রাত-বিরাতে নিশ্চিন্তে ঘোরাঘুরি করতে পারে। এই ক্যাম্পাসে এমন একটা কর্মসূচি পালন করা নিতান্তই অর্থহীন বলে আমার মনে হয়েছে। ওই কর্মসূচিতে যারা যোগ দিয়েছিলেন তাদের সদিচ্ছার প্রতি সকল সম্মানসহই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৭-৯৮ সালের ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনর পর থেকে এই ক্যাম্পাসে মেয়েরা দেশের অন্য অনেক অংশের থেকে একটু বেশি মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে। সে যাই হোক, রাত দখলের ডাকে সাড়া দিতে ওই কর্মসূচিতে যোগ দিতে আমি যাইনি। অথচ, অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্তও আমি নারীদের ডাকা এমন দুই একটি কর্মসূচি-সমাবেশে গিয়েছি, বৈঠকে যোগ দেওয়ার আগ্রহ রেখেছি। তাহলে এই কর্মসূচিতে যোগ না দেওয়ার কারণ কি বা কারণগুলো কি কি?
প্রথমত, আমার মনে হয়েছে সদ্যগঠিত সরকারের বয়স এক মাসও হয়নি। এখনই সকল দাবি দাওয়া নিয়ে হামলে পড়া কোনও বুদ্ধিমানের মতন কাজ নয়। বরং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নারী প্রসঙ্গে অবস্থান কেমন সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করা উচিৎ।
দ্বিতীয়ত, ‘মেয়েরা রাত দখল করো’— এই নামটি সমস্যাজনক। পশ্চিমবঙ্গের নারীর প্রতি জুলুমের বিরুদ্ধে পথে নামা নাগরিকদের প্রতি সকল সম্মানসহই বলা যেতে পারে যে, এই নামটির মধ্যে একটি কর্তৃত্ববাদী সুর আছে। নারীর প্রতি অত্যাচার কি মানুষের ওপরই অত্যাচার নয়? নারীর প্রতি নৃশংসতার বিরুদ্ধে সব সময় নারীকেই কেন আওয়াজ তুলতে হবে? এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি প্রশ্ন মনে পড়ে গেছে আমার। কোনও এক ইসলামপন্থী নেতা পর্দাহীন নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করায় তিনি দেশের নারীসমাজের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, নারীরা কেন এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করছে না? সে সময়ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে একই রকম সমস্যাযুক্ত বলে দাবি করেছিলাম। নারীকে তেঁতুল বলে খাদ্যের সঙ্গে তুলনা করা মানে একই সঙ্গে পুরুষদেরও নারীমাংসলোভী, বর্বর রকমের কামুক বলে অপমান করা হয়। ফলে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে হলে নারী পুরুষ উভয়কেই করতে হবে— এই ছিল আমার মত।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হতে সময় লাগেনি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও একই রকম ঘটনা ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঢাকায় বসে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে সংহতি জানানোই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়েছে। এর জন্য পথে নামবার অন্য অর্থ হতে পারে। বিশেষত যখন ভারতের গণমাধ্যম বাংলাদেশের ছাত্র জনতার আন্দোলনের সংবাদ ভয়াবহ নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছে। ঢাকার রাত দখলের আন্দোলনকেও অন্যভাবে প্রচার করা বিচিত্র নয় তাদের জন্য। সত্য বটে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে হাসিনাবিরোধী মিছিল করেছে, শ্লোগান তুলেছে। কিন্তু সেই খবর বাংলাদেশ বা ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমে কতইবা গুরুত্ব পেয়েছে?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে, জনগণের সমর্থন ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে গঠিত হওয়া এবং একজন বিশ্বখ্যাত নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী ব্যক্তির নেতৃত্বে গঠিত একটি সরকারের কাছে প্রত্যাশা অনেক বেশি হবে, এটাই হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু মানবাধিকার তথা নারী অধিকার কর্মীদেরও জানতে হবে কোন সময় কোন প্রসঙ্গে মাঠে নামতে হয় আর কখন কোন বিষয়ে আলাপ তুলতে হয়, এমনকি কোন বিষয়ে কোন পরিস্থিতিতে চুপ করে থাকতে হয়। খবরে, ভিডিওতে দেখেছি, ওই মিছিলে শ্লোগান উঠেছে, ‘‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’’, ‘‘আমরা চাই আজাদী’’।
ধর্ষণের বিচার ও পিতৃতন্ত্রের চোখ রাঙ্গানি থেকে আজাদী নারীমাত্রই চান। কিন্তু চাইছি কার কাছে? বাংলাদেশের সরকার তো ভারতে মৌমিতা ধর্ষণ ও হত্যার বিচার করবার এখতিয়ার রাখে না। সত্য বটে, রাত দখলের কর্মসূচিতে এদেশের তনু-মুনিয়া-নুসরাত এমন অনেক আলোচিত ধর্ষণের বিচার চাওয়া হয়েছে। নারীর জন্য সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব, গর্ভপাতের অধিকার দাবি করা হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনায় ‘ভিকটিম ব্লেইমিং’ ও ‘স্লাট শেমিং’-এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাও হয়েছে। এই সকল কিছু নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম সব সময় জারি থাকবে। ফলে নারীর স্বার্থে সংগ্রাম করতে হলে কাজটা চালিয়ে যেতে হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার ধর্ষণের মামলায় বিচার করা শাস্তি দেওয়া একদিনের কাজ নয়। আমরা সবাই জানি, ফ্যাসিজমের প্রভাবে দেশের প্রশাসন, আইন ও বিচার ব্যবস্থা নানাভাবে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে গেছে এবং সরকার পতনের পর অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ, আর্মি, বিজিবি, আনসার ইত্যাদি নানা বাহিনীতে অস্থিরতা দেখা গেছে ।
নারীর প্রতি ঐতিহাসিকভাবেই বৈষম্যমূলক বাস্তবতার সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই বা থাকে না। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগেও অনেক সময় দেখা গেছে, দেশে যা কিছুই ঘটে যাক না কেন, নারীর ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। আমাদের দেশেই মুক্তিযুদ্ধের পর প্রচুর বীরাঙ্গনার স্থান হয়েছে বেশ্যালয়ে। ‘বীরাঙ্গনা’র মতন উপাধিও বেশ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া থেকে বাঁচাতে পারেনি ৭১-এর নির্যাতিত নারীকে। তবে যখন কিনা রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের প্রসঙ্গ উঠছে, তখন নারীর প্রতি নেতিবাচক সকল আইন সংস্কারের দাবিও উঠতে বাধ্য। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে নারীর মুক্তির লড়াই একটা আলাদা রাজনীতি, একটা ভিন্ন মতাদর্শ— যা এখনও সমাজকাঠামো ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলধারার সঙ্গে সমান্তরাল নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের একজন প্রতিনিধি ১৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়ে তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানান। এরপর ২০ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে নারী নেত্রীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নারী প্রসঙ্গে কাজ করার সদিচ্ছার একটা উদাহরণ হতে পারে একজন উপদেষ্টার সমাবেশে যোগ দেওয়া ও অবিলম্বে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রের নারীদের সভা ডাকা। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম, ফরিদা আক্তার, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ, নারী নেত্রী শিরিন হক, সামিয়া আফরিন, সীমা দাস সিমু, তাসলিমা আক্তার, রিতু সাত্তার, বিথী ঘোষ, সুলতানা বেগম, নিগার সুলতানা, সুফিয়া রহমান, তাসকিন ফাহমিনা, মেঘনা গুহঠাকুরতা, রানী ইয়ান ইয়ান, অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, শাহীন আনাম, নিরূপা দেওয়ান, অধ্যাপক ফাহমিদা খাতুন, শ্যামলী শীল, আইরিন খান, নাবিলা ইদ্রিস ওই বৈঠকে অংশ নেন। এই বৈঠকে অংশ নেওয়া নারীর সংখ্যা আরও বেশি হতে পারত, নারীনেত্রীদের বৈচিত্র, বহুমুখিতা আরও বিস্তৃত হতে পারত— কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ। এটি একটি প্রক্রিয়ার আরম্ভমাত্র, শেষ নয়। ফলে আশায় বুক বাঁধা যেতেই পারে।
২৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্যেও আশাবাদী হওয়ার মতন অনেক কিছুই রয়েছে। দেখা গেছে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত সকল খাতে কাজ করবার জন্য এই সরকার বদ্ধপরিকর। দুর্নীতির বিচার, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, আহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তৎপরতা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, পরিবহন এমন অনেক খাত নিয়েই কথা বলেন মুহাম্মদ ইউনূস যা ইতিবাচক। কিন্তু তার বক্তব্যে অন্তত একটি শব্দবন্ধকে পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট বলে চিহ্নিত না করলে অন্যায় হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস মুক্তিযুদ্ধে নারীর প্রতি নিপীড়ণকে ‘‘মা-বোনদের আত্মদান’’ বলে অভিহিত করেছেন যেমন করে এর আগেও সবসময় বলা হতো। পার্থক্য হচ্ছে আগে বলা হতো ‘‘মা-বোনদের ইজ্জত/সম্ভ্রমের’’ বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা। তিনি ইজ্জত, সম্ভ্রমের মতন ছেদো কথা না বলে আরও এক কাঠি মাহাত্ম্য আরোপ করে বলেছেন ‘‘আত্মদান’’।
‘মেয়েরা রাত দখল করো’— এই বাক্যে যেমন সমস্যা খুঁজে পেয়েছি, ‘মা-বোনদের আত্মদান’ কথাটিতেও একই রকম সমস্যা দেখতে পাই। প্রথম কথা, দান অর্থ স্বেচ্ছায় কিছু দিয়ে দেওয়া। ধর্ষণ এমন এক ঘটনা যা থেকে বাঁচতে নারী মৃত্যুবরণ করতেও রাজি থাকে, এমন নজির বহু আছে। জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাইদ স্বেচ্ছায় পুলিশের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল। ভিডিও দেখে আমার মনে হয়েছিল, প্রথম গুলি চলার পর সে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। সাহসে ভর করে বুক পেতে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার নিজের দেশের পুলিশ সামনে থেকে গুলি করে তাকে মেরে ফেলতে পারে, এ কথা সে হয়ত দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। সে যা-ই হোক, যে কোনও অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামে মৃত্যুর ভয় আছে জেনেই লৈঙ্গিক পরিচয় নির্বিশেষে মানুষ রাজপথে নামে। কিন্তু ধর্ষণের জন্য কেউই প্রস্তুত থাকে না। একে আত্মদান বলা মানে ধর্ষণের মতন ভয়াবহ একটি যুদ্ধাপরাধকে লঘু করা। দ্বিতীয় কথা, নারীকে ‘মা-বোন’ বলে আখ্যায়িত করা এক ধরনের ‘অডাসিটি’। এতে ব্যক্তি হিসেবে নারীর আত্মপরিচয় বিঘ্নিত হয়, পরিবারে পুরুষের অবস্থানের সাপেক্ষে নারীর পরিচয় নির্ধারিত হয়— যা কাম্য নয়। যে নারী কারো মা নয়, কারো বোন নয় তার ওপর নিপীড়ন কি নিপীড়ন নয়? যে নারীর পরিবার নেই সে কি ব্যক্তি নয়?
এই প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান করে আলোচনার ইতি টানতে চাই। আমার জীবনে এমনটা একবারই ঘটেছে কিন্তু আমি ঘটনাটা কোনওদিন ভুলতে পারিনি, পারব বলে মনেও হয়না। একবার এক নারী অন্য এক নারীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে, ‘‘ও হচ্ছে প্রভুর মা’’। বলা বাহুল্য আমার গর্ভজাত সন্তানের নাম প্রভু এবং প্রভুকে গর্ভে ধারণ করা, জন্ম দেওয়া, লালন পালন করা, ভাষা শেখানো, দুনিয়া চেনানো আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু কেউ আমার নাম উচ্চারণ পর্যন্ত না করে প্রভুর সাপেক্ষে আমার পরিচয় নির্ধারণ করতে পারে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। প্রভু আমার জীবনের ভরকেন্দ্র হলেও ওইভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া আমার আত্মমর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছিল, আমার অহংকারে আঘাত লেগেছিল।
ভাষার রাজনীতি সামান্য নয়। আগের দিনে অনেকেই গৃহকর্মে সাহায্যকারী নারীদের ‘অমুকের মা’, ‘তমুকের মা’ বলে ডাকতেন। মানুষ মারা গেলে মসজিদে মাইকে মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করা হয়, মৃত ব্যক্তি নারী হলে তার নাম উচ্চারণ করা হয় না, কোনও না কোনও পুরুষের মা, স্ত্রী বা বোন হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। এভাবে জনপরিসরে ব্যক্তি হিসেবে নারীর স্থান সংকুচিত করা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্রের শুরুতে নারী, শিশু, দাস ও পাগলরা ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল কেননা এদের ব্যক্তি হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়নি। নারীকে রীতিমত রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রাম করে ভোটাধিকার আদায় করে নিতে হয়েছিল।
স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর গণতন্ত্রের পদধ্বনি শুনতে শুনতে যদি নারীকে ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য আবারও যুদ্ধ করতে হতো, তা হয়ত সহজই হতো। কিন্তু ভাষার মধ্যে এইসকল সাটল মারপ্যাঁচ যার গভীরে নিহিত রয়েছে বঞ্চিত করার বীজ, তার সঙ্গে লড়াই করা এত সহজ নয়। এর শুরুটা হতে পারে নারীকে নারী, মহিলা, মেয়ে, মেয়েরা এমন নানা শব্দে সম্বোধন করলেও পুরুষের সাপেক্ষে ‘মা-বোন’ বলে সম্বোধন করা থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে।
রাষ্ট্র সংস্কার চলছে, ভাষাও সংস্কার করা প্রয়োজন। রাস্তা বা রাত দখল করবার চেয়ে ভাষা দখল করা আরও বেশি জরুরি। কেননা নারীকে ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করার মাধ্যমেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বাস্তবতার পরিবর্তন আনা সম্ভব।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক।
ইমেইল: [email protected]