দেশ তো স্বাধীন হলো। কিন্তু জীবন সহজ হবে ভাবলেও তেমনটা হয়নি।
সদ্যস্বাধীন দেশে অনেক ধরনের অস্থিরতা আমাদের জীবনে ছায়া ফেলে। জিনিসপত্রের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়। লোকের আয় পুরান পাকিস্তান আমলের আর দাম নয়া বাংলাদেশের। ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। কেবল সরকার ও বিরোধী দলের রাজনীতি নয়, চরমপন্থী সশস্ত্র রাজনীতির অস্থিরতা। ছিল মাওবাদী রাজনীতি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল খারাপ। সেটা কেবল ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট, ৩রা নভেম্বর ও ৭ই নভেম্বরই নয়। আরও আগে থেকেই।
চারদিকে জীবন-মরণের একসাথে বসবাস। জীবনটাই ছিল অনিশ্চিত ও বিপদময়। সামাজিক অস্থিরতা প্রবলভাবে বেড়ে যায়। যুদ্ধ শেষ কিন্তু তার প্রভাব চলছেই। কে সামলাবে, কিভাবে সামলাবে এই জীবন ও মরণ? আর ওই অস্থিরতার দরজা দিয়েই দেশে ঢুকে পড়ে ড্রাগস। তারুণ্য ওই মাদকের অস্থিরতার বড় শিকার।
২.
তখনকার যে তরুণদের কথা লোকে কম বলে— তারা হলো সেই তরুণ, যাদের আত্নীয়-স্বজন যুদ্ধে শহীদ, যেভাবেই হোক। এই শহীদের তকমা কষ্ট কমায় না স্বজন হারাবার। আমার খুব ঘনিষ্ট দুই বন্ধুর বাবাকে আর্মি উঠিয়ে নিয়ে যায়— একজনের বাবা খুব নামকরা বুদ্ধিজীবী, আরেকজনের বাবা আমলা। কারও লাশই পাওয়া যায়নি।
বুদ্ধিজীবীর ছেলে ওই বন্ধুটা খুব ডানপিটে গোছের ছিল। মুক্তিযোদ্ধা। এমনিতেই একরোখা। গোপন অর্ডার ছিল যে ঢাকায় যেন ওকে কোনও এসাইনমেন্ট দেওয়া না হয়। কারণ যদি শিক্ষকতার চাকরিরত তার বাবাকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ ভেবে হত্যা করতে চায়!
যুদ্ধের পর সে খুব দ্রুতই ড্রাগসে জড়িয়ে পড়ে। শেষে সবার চেষ্টায় বিদেশে পড়তে পাঠানো হয়। কয়েক বছর বাদে ফিরে আসে। তখনও আসক্ত। কিন্তু একটা চাকরি পেয়ে যায়। তারপর অন্যজীবন শুরু, ঘর-সংসার ইত্যাদি। এখন ভালো আছে। দেশ-বিদেশ ঘুরে থিতু হয়েছে।
৩.
অন্য বন্ধুও বাবাকে হারায়। খুব কম মানুষই ওই আমলাকে চেনে। তারা খুব নীরব তার অন্তর্ধান নিয়ে। খুবই প্রভাবশালী পরিবার। কিন্তু একেবারেই চুপ বিষয়টা নিয়ে। যেন না জানানোটাই এক ধরনের বক্তব্য। বন্ধুটাও সব কিছুতে আসক্ত হয়ে পড়ে। একবার ওকে দোকানদার ট্যাবলেট দিতে রিফিউস করে। ও আমাকে পাঠায়। দোকানদার আমাকে দিতে দিতে বলে, ‘‘বন্ধুকে বলবেন, এই নেশা ছাড়া যায় না। কী আর করা। বাবার লাশ না পাওয়ার ক্ষত ড্রাগস দিয়ে সারেনি কোনওদিন। ব্যবসা, চাকরি, শেষে থিঙ্ক ট্যাংক করে সফল। কিন্তু ওর মেধার মাপ ছিল অনেক বড়, ওর অর্জনের তুলনায়। শেষে বাবার রেখে যাওয়া বাড়িটা দেয় বিল্ডার্সকে, তাতেই চলে যায় আরামে। টিকে আছে। আর আছে মদের নেশা। সেটাই হয়ত ক্ষতের ওষুধ এখন।
৪.
ভাই হারানোর আঘাতও ভয়ানক। আমার আরেক বন্ধু ছিল, যার ভাইকে মেরে ফেলা হয় ‘বিহারী’ ভেবে, যখন সে ক্যাম্পে পৌঁছায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। ভালো করে বাংলা বলতে পারত না— অতএব মে মাসে এমন মানুষ নিরাপদ ছিল না ওই সব তল্লাটে। এরচেয়ে বিষণ্ন, অর্থহীন মৃত্যু আর হয়না।
কিন্তু এরকম ঘটনাও ঘটেছে। তিনি থিয়েটারের ভালো অভিনেতা ছিলেন। টিভি-তে তার গ্রুপের নাটকও দেখেছি আমরা। কিন্তু এইভাবে মৃত্যুর চেয়ে অ্যাবসার্ড আর কী হতে পারে! তার ভাইটা নেশা করত, প্রবল নেশা করত। ভালো ছাত্র ছিল। একসময় বিদেশে পৌঁছায় পড়তে। তারপর সেখানেই থেকে গেছে। বিয়েশাদী করে খামারী হয়েছে। একসময় পড়াতো। কোনও যোগাযোগ নেই। তবে মানুষটা ভালো ছিল। সে’ও লিটল থিয়েটার করত। দু’এক সময় ভাইয়ের কথা বলত। ড্রাগস না নিলে দারুণ রেজাল্ট করত।
যুদ্ধ আমার ওই তিন বন্ধুর জীবনে যে ধাক্কা দিল ১৮ বছর বয়সে— সেই আঘাত সামলাবার ক্ষমতা ওদের কারও ছিল না। তারা আমাদের যুদ্ধের অজানা, অশনাক্ত ভিকটিম।
৫.
যে বন্ধুদের কথা বললাম, ওরা শহুরে মধ্যবিত্ত, সুশীল সমাজের মানুষ। কিন্তু গ্রামে এরকম হাজারও কেইস আছে, যেখানে জীবন আর জীবিকার তাগিদে মানুষকে আবার নতুন লড়াই শুরু করতে হয়েছে— নেশা করে ক্ষত ভুলবার মতো সুযোগ বা সামর্থ্য হয়নি, পায়নি তারা। তাদের কষ্ট কম নয়। শ্রমে ফিরতে হয়েছে বলে একদিক থেকে তারা বেঁচে গেছে।
আমার আরও বন্ধু-যোদ্ধা আছে যাদের জীবন অন্যরকম। তবে ওই স্বজন হারানোর কষ্টটা প্রবল ধাক্কা দেয়। কেউ আবার এই সবকিছু উৎরে যায় নেশার সাহায্য ছাড়াই। কেউ কেউ আছে, যাদের বাবা যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। তাদের সন্তানেরা ড্রাগসমুক্ত জীবনযাপন করেছে। সবরকম মানুষই আছে। তবে ড্রাগস-নেশা যাদের ধরে তাদের গ্রাস করে। কিন্তু নেশা কেবল ড্রাগস থেকেই হয়না। যেমন আমার আরেক বন্ধু।
৬.
ওই বন্ধু নিজে মুক্তিযোদ্ধা। বগুড়ার প্রতিরোধে ছিল। এপ্রিল মাসে, চলে যায় ট্রেনিং ক্যাম্পে। ফিরে এসে নিজেই ছোট একটা দল করে। যুদ্ধের পর সে যোগ দেয় চরমপন্থী দলে। অথচ এর আগে তাদের ওই রাজনীতির সাথে তেমন কোনও যোগাযোগ ছিল না।
আমার সাথে শেষ দেখা হয় ঢাকায়, ১৯৭৭ সালে। আমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পে যোগ দিয়েছি শুনে খুব খুশি। ‘‘তুই পারবি, তুই তো কোনও দল করিস না, সবার কথা লিখিস।’’ বললাম, “তুই কী করবি এখন? তোর দল তো অস্ত্রের লাইন ত্যাগ করে মূলধারার রাজনীতি করবে বলছে।’ ও জানায় ও তাদের সাথে আর নেই। কথাটা বলে ও একটু হাসে— ‘‘দোস্ত, সবার জীবন কি একরকম হয়?’’ একসময় কথার সময় শেষ হয়, ও হাত মিলিয়ে চলে যায়। এলাকায় ফিরে গিয়ে নিজেই একটি গ্রূপ বানায়। ৮০’র দিকে সেনাবাহিনীর সাথে এক সংঘর্ষে ওই বন্ধু প্রাণ হারায়।
কিছু মানুষের যুদ্ধ দরকার হয় যেন— নেশাখোরের ড্রাগসের মতো। হয়ত নয়। কথাটা আমি এমনি ভাবছি আমার বন্ধু বলে। যুদ্ধের নেশা বড় ভয়াবহ। একবার এই নেশা হয়ে গেলে কাউকে ছাড়ে না।
যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু তার আঘাত চলতে থাকে। আজও চলছে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও শিক্ষক।
ইমেইল: [email protected]