Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

র‌্যাবের বিলুপ্তি চেয়ে ট্রাইব্যুনালে লিমনের অভিযোগ

ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন লিমন হোসেন। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন লিমন হোসেন। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

জুলাইতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়ার অভিযোগ উঠেছিল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) বিরুদ্ধে। যদিও সরকার পতনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, গুলি নয় টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল।

র‌্যাব অস্বীকার করলেও সকাল সন্ধ্যাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কাছেই ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন যে র‌্যাব গুলি ছুড়েছিল।

বিশেষায়িত এই বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্বিচারে গুলি ছোড়ার অভিযোগ নতুন নয়। ২০১১ সালে ঝালকাঠির রাজাপুরে ১৬ বছরের কিশোর লিমন হোসেনের পায়ে খুব কাছ থেকে গুলির অভিযোগ ওঠে র‌্যাবের বিরুদ্ধে।

সেদিনের সেই কিশোর লিমন এখন গণবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর এবার র‌্যাব বিলুপ্ত চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে এটাও অভিযোগ করেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের অসহযোগিতায় র‌্যাবের গুলিতে পা হারানোর ঘটনায় বিচার পাননি তিনি।

গত ১৩ বছর ধরে সরকার তদন্তের নামে প্রহসন করেছে বলেও অভিযোগ তার।

মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনালে লিখিত অভিযোগে তাকে হত্যাচেষ্টায় র‌্যাবের তৎকালীন আরও তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত ছিল অভিযোগ করে তাদেরসহ বাহিনীটির নয় সদস্যের নাম উল্লেখ করেছেন।

ঘটনাক্রম

২০১১ সালের ২৩ মার্চ। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে কিশোর লিমন হোসেনের পায়ে গুলি করেন বরিশাল র‌্যাব-৮ এর সদস্যরা। এ ঘটনায় লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠির আদালতে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন।

মামলাটির তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।

ওই মামলায় আসামি করা হয়েছিল তৎকালীন বরিশাল র‌্যাব-৮ এর উপ-সহকারী পরিচালক লুৎফর রহমান, করপোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. আব্দুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক প্রহ্লাদ চন্দ এবং কার্তিক কুমার বিশ্বাসসহ অজ্ঞাত কয়েকজন র‌্যাব সদস্যকে।

সেসময় র‌্যাব বলেছিল, একটি অভিযান চালানোর সময় গুলিবিদ্ধ হয় কিশোর লিমন।

তবে শুরু থেকেই লিমন বলে আসছেন, “েসেদিন র‌্যাবের সদস্যরা তার শার্টের কলারে ধরে বাম পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। একই সঙ্গে তাকে সন্ত্রাসী বানাতে দুইটি মিথ্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছিল।”

ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সেইদিনের কথা স্মরণ করে লিমন হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “২০১১ সালে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকারের সন্ত্রাসী র‌্যাব বাহিনী দ্বারা আমি নির্যাতিত হয়েছিলাম, নির্যাতনের এক পর্যায়ে আমার শার্টের কলারে ধরে পায়ে গুলি করে। এর ফলে আমার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করি।

“এই ১৩ বছর বহু চেষ্টা করেছি, অনেক আকুতি-মিনতি করেছিলাম একটি ন্যায় বিচারের জন্য। গত ১৩ বছর তদন্তের নামে একটা প্রহসন করে গেছে সরকার।”

লিমনের পা হারানোর ঘটনা সেই সময় বিপুল আলোচনার জন্ম দেয়।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর আগস্ট মাসে সাভারে সেন্টার পর ডিজ্যাবিলিটি ইন ডেভলপমেন্ট নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান লিমনের কৃত্রিম পায়ের সফল সংযোজন করে। তাকে শেখানো হয় কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে হাঁটাচলার কৌশলও।

সেই পায়ে ভর দিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করেন লিমন, প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে।

তদন্তে সাধারণত কত সময় লাগে

লিমনকে হত্যাচেষ্টার মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে পুলিশ। পরে ডিবির হাত ঘুরে তা পিবিআইয়েও যায়। সবশেষ মামলাটির তদন্তের ভার রয়েছে সিআইডির কাছে।

লিমন হোসেন বলেন, “সিআইডি এখন পর্যন্ত তদন্ত শুরুই করতে পারেনি। রাষ্ট্রের কাছে আমি জানতে চাই, একটা মামলার তদন্ত করতে আসলে কতবছর সময় লাগার কথা? বার বার একটা কথাই বলে, লিমনকে র‌্যাব গুলি করেনি। তাহলে কে গুলি করেছে? তোমরা এটা খুঁজে বের করো ভাই।”

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ন্যায় বিচার পাননি জানিয়ে লিমন বলেন, “বরং বিচার চেয়ে আমাদের পরিবার অনেক হয়রানির শিকার হয়েছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করায় আমি এবং আমার পরিবার ৮/১০ বছর গ্রামের বাড়ি থাকতে পারিনি। পিরোজপুরে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হয়েছে।”

অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে লিমনের বিরুদ্ধে পাল্টা দুটি মামলা করেছিল র‌্যাব। সে প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমার পা কাটার পরও এক পা নিয়ে কোর্টের বারান্দায় বারান্দায় হাজিরা দিতে হয়েছে। আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজনদের হয়রানি করেছে র‌্যাব।”

২০১৩ সালে দুটি মামলা থেকেই খালাস পান জানিয়ে তিনি বলেন, “এখান থেকেই প্রমাণ হয় আমি নির্দোষ ছিলাম। কারণ এই খালাসের বিরুদ্ধে র‌্যাব আপিলও করেনি।”

লিমন মনে করেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতার আসার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মানুষের মধ্যে একটা আস্থার জায়গায় পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমি এই ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হয়েছি ন্যায় বিচারের জন্য। দ্রুত বিচার পাওয়ার আশায় ট্রাইব্যুনাল ও রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাচ্ছি। আমার মামলার বিচার করতে পারলে দেশে ন্যায় বিচারের দৃষ্টান্ত হবে।”

র‌্যাবের আরও তিন কর্মকর্তা জড়িত

শেখ হাসিনা সরকারের সময়কে ‘ফ্যাসিবাদের শাসনামল’ উল্লেখ করে ওই সময় র‌্যাবের ‘অপরাধী’ সবাইকে মামলায় আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন লিমন।

তিনি বলেন, “জড়িত সবাইকে আমরা আসামি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু নানা বাধাবিপত্তি ছিল, অনেক রকমের হুমকি-ধামকি ছিল, তাই কয়েকজনকে আসামি করতে পারিনি।”

তৎকালীন র‍্যাব-৮ এর প্রধান মেজর রাশেদ, র‍্যাবের সহকারী মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান ও শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকের নাম কোনোভাবেই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি বলে জানান তিনি।

লিমন বলেন, “আজকে ট্রাইব্যুনালে এই তিনজনের নামও অন্তর্ভুক্ত করে মোট নয় জনের নামে অভিযোগ দিয়েছি। তারা সবাই র‌্যাবের সদস্য।”

মায়ের করা মামলা তুলে দেওয়ার জন্য জিয়াউল আহসান কয়েকবার তার অফিসে লিমনকে ডেকে নিয়ে হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ লিমনের।

র‌্যাব বিলুপ্তি ও ক্ষতিপূরণের দাবি

নিজের ঘটনা ছাড়াও আলোচিত নারায়ণগঞ্জে সাত খুন, চট্টগ্রামের মাজার ডাকাতিসহ র‌্যাবের বিরুদ্ধে, চাঁদাবাজি, গুম, খুনের অভিযোগ রয়েছে জানিয়ে লিমন হোসেন বলেন, “র‌্যাব সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে পরিচিতি পাচ্ছে। র‌্যাবকে আমার কাছে সন্ত্রাসী সংস্থা মনে হচ্ছে, এ জন্য র‌্যাবের বিলুপ্তির আবেদন জানিয়েছি।”

র‌্যাব মামলা করায় পঙ্গু হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশ সব সময় পাহারা দিয়ে রাখত জানিয়ে লিমন বলেন, “মনে হতো আমি কত বড় সন্ত্রাসী। শুধু র‌্যাব না, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, উনি হাসপাতালে ফোন করে বলেন, আমাকে যেন সেখানে চিকিৎসা দেওয়া না হয়। এরপর অসুস্থ অবস্থায় আমাকে জেলে নিয়ে যায়। পরে আমি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলে আমার চিকিৎসা করাবে না বলে দেয়।”

ওই সময় লিমনের চিকিৎসার দায়ভার রাষ্ট্রকে নিতে হাই কোর্টের নির্দেশনা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “হাই কোর্টের আদেশও রাষ্ট্র তখন মানেনি। রাষ্ট্র নিজেকে মনে করত সবকিছুর ঊর্ধ্বে।”

পা হারানো এবং পরবর্তীতে মিথ্যা মামলাসহ হয়রানির ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে দেওয়া অভিযোগে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন লিমন। তিনি বলেন, “যে সময়টা আমার আনন্দ করার কথা, খেলাধুলা করার কথা, সে সময় আমার পা হারাতে হয়েছে। আমি আমার ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত