২০২২ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটি ক্রিকেটপ্রেমীদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ওই সিরিজে দুই টেস্টে তিন ইনিংসে ২৮১ রান করেছিলেন লিটন দাস। প্রায় দুই বছর পর একই প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিবর্ণ লিটন। এক টেস্টের দুই ইনিংসে সংগ্রহ মাত্র ২৫ রান।
পারফরম্যান্সের উথান-পতন থাকতেই পারে। সিলেটে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে যেভাবে আউট হয়েছেন, তার কোনো ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা হয় না। ৩৭ রানে দলের ৪ উইকেট নেই, নিজের প্রথম বলেই ডাউন দ্যা উইকেটে গিয়েছিলেন এই ব্যাটার !
তার আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ওয়ানডেতেই ডাক মেরেছেন এই ওপেনার। এর আগে টি-টোয়েন্টিতে এক ম্যাচে করেছেন ৩৬ রান, বাকি দুটোতে ০ ও ৭। এমন ছন্নছাড়া পারফরম্যান্সের পর স্বাভাবিকভাবে তিনি আলোচনায় এবং তার দিকেই নানা অভিযোগের আঙ্গুল তুলছে টিম ম্যানেজমেন্ট।
লিটনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
লিটন দাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, টিম ম্যানেজমেন্টের বার্তা অনুযায়ী চলতে না পারা। খেলতে না পারা। উইকেটে গিয়ে দলের প্রয়োজন মেনে খেলতে পারছেন না এই ব্যাটার। তার নমুনা হলো, ৩৭ রানে দলের ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও তিনি সিলেট টেস্টে ডাউন দ্যা উইকেটে শট খেলতে যান যা কিনা সবাইকে বিস্মিত করেছে।
লিটনের ওই শট খেলা ভালো ভাবে নেয়নি বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। কারণ দলের নাজুক অবস্থায় কোনও দায়িত্বশীল ব্যাটার প্রথম বলে ডাউন দ্য উইকেটে খেলতে পারেন না। তাছাড়া টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে ওভাবে খেলার কোনও বার্তাও ছিল না বলে জানা গেছে। লিটনের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং নিয়ে সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
শুধু তাই নয়, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ থেকে বাদ পড়ার পর লিটন অনুশীলনেও অমনোযোগী থাকেন বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়েছে। তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব নিয়েও তিনি উদাসীন থাকেন বলে অভিযোগ। এজন্য কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বিরক্ত এই ওপেনারের ওপর। তবে দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চান না। একজন বলেছেন, “আমার পক্ষে কিছু বলা কঠিন। সব ঠিক আছে।”
অভিযোগের জবাব
এসব অভিযোগ নিয়ে লিটন দাসের মুখোমুখি হয়েছিল সকাল সন্ধ্যা। তবে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো নিয়ে এই ব্যাটার কোনও কথা বলতে রাজি হননি, “এই বিষয়ে আমি কোনও কথা বলতে পারব না। এসব অভিযোগ কোথা থেকে উঠছে আমি জানি না। এই বিষয়ে কথা বলতে চাইলে আসলে আমার বলার কিছু নেই। তার কথায় মনে হয়েছে, তার দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং ও অমনযোগীতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে না!”
লিটনের বিশ্রাম চান নাজমুল হাসান
অথচ খোদ বিসিবি সভাপতিই নাখোশ এই ব্যাটারের ওপর। লিটন দাসের খেলায় নাজমুল হাসান কোনও ভরসা খুঁজে পাচ্ছেন না সেটা তার কথায় স্পষ্ট। তিনি রাখঢাক না করেই বলেছেন, “তার বিশ্রাম দরকার। এজন্যই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম (ওয়ানডে থেকে বাদ দেয়া প্রসঙ্গে)। তাকে (শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ) টেস্ট ম্যাচেও না খেলালে আমার মনে হয় ভালো হতো। কিন্তু সমস্যা হলো, আপনারা বলতেন টেস্টে তার রেকর্ড ভালো, কেন তাকে বসানো হলো। আরো কিছুদিন তাকে বিশ্রাম দেওয়া হলে সে হয়তো ভালভাবেই কামব্যাক করতে পারবে।”
২০২৩ বিশ্বকাপের আগে থেকে জাতীয় দলের ভবিষ্যত অধিনায়ক হিসাবে দেখা হচ্ছিল লিটন দাশকে। ততদিনে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে খণ্ডকালীন অধিনায়কত্ব করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার বিশ্বকাপ সেই সম্ভাবনা উড়ে যায়।
এটাই কী তার হতাশার কারণ? বোর্ড সভাপতি তা মনে করেন না, “কোচ বা অধিনায়ক কে হবে, এটা সম্পূর্ণ বোর্ডের সিদ্ধান্ত। আমার মনে হয় না, এ নিয়ে সে মনক্ষুন্ন। গত বিশ্বকাপ থেকেই ওর পারফরম্যান্স দেখছি, কিছু একটা সমস্যা আছে।”
সমস্যাটা কী, সে নিয়ে তার কোনও ধারনা নেই। তবে বিশ্রামে পাঠিয়ে লিটনকে কড়া বার্তা দেওয়ার কথা বলেছেন ক্রীড়ামন্ত্রী, “তার ওপর আমরা এত বছর ভরসা করেছি, সে তো পারফরমও করেছে। কিন্তু কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে বলেই তাকে ওয়ানডে থেকে ড্রপ (বাদ) করা হয়েছে। এর থেকে বড় বার্তা (সিগনাল) কিছু হতে পারে না।”
চাপ বাড়ছে এই ব্যাটারের ওপর
লিটনের ব্যাটে রান নেই। তার ব্যাটিংয়ে বিরক্ত টিম ম্যানেজমেন্ট। তার অন্য সমস্যা দেখছেন বোর্ড সভাপতি। সব মিলিয়ে এখন বেশ চাপে এই ব্যাটার।
চাপের শুরু বিশ্বকাপ থেকে। পুরো টুর্নামেন্টে ৯ ম্যাচে তিনি করেছেন ২৮৪ রান। প্রত্যাশা অনুযায়ী রান করতে পারেননি। এরপর বাংলাদেশ দলের হোটেল থেকে সাংবাদিকদের বের করে দিতে নিরাপত্তারক্ষীদের দ্বারস্থ হয়ে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। পরে অবশ্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। বিশ্বকাপ শেষে দেশে নিউজিল্যান্ড সিরিজে লিটনকে সাকিব আল হাসানের পরিবর্তে অধিনায়কত্ব করার প্রস্তাব দিয়েছিল বিসিবি। কিন্তু পরিবারের পাশে থাকার জন্য ছুটি নিয়েছিলেন সিরিজ থেকে।
সেটি যে বিসিবি ভালভাবে নেয়নি তা বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স প্রধান জালাল ইউনুসের ওই সময়ের কথাতেই স্পষ্ট ছিল, “আমরা তাকে ছুটি দিয়েছি। কারণ কাউকে জোর করে খেলানো যায় না। জাতীয় দলে খেলার জন্য ওই পেশাদারিত্বটা হৃদয় থেকে আসতে হবে। যদি কেউ বলে যে আমি খেলব না, তখন আপনি তাকে জোর করে খেলাতে পারবেন না।”
একসময় তার ব্যাটে রান ছিল। সামর্থ্য ও সম্ভাবনা মিলিয়ে বোর্ডের কাছে তিনি ছিলেন আদরনীয়। ছিলেন সম্ভাব্য অধিনায়কের তালিকায়ও। ফর্মের অধোগতিতে সেই ক্রিকেটারকে এখন বিশ্রামে পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে। তার চারদিকে এখন ছন্নছাড়া বাতাবরণ। মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতে শুরু করেছেন এই তারকা।