ক্ষমতার পালাবদলের পর ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া স্থানীয় সরকারের সব জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করা হলেও যত দ্রুত সম্ভব জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি উঠেছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়েছেন অপসারিত এসব জনপ্রতিনিধিরা।
তাদের দাবিতে সমর্থন দিয়েছেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তবে ভিন্নমতও রয়েছে কারও কারও। তারা বলছেন, জাতীয় সংসদের ভোট করেই স্থানীয় সরকারের এসব ভোট আয়োজন হবে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত।
এদিকে নির্বাচন কমিশন বলছে, স্থানীয় সরকারের ভোটে আয়োজন করা তাদের কাজ না। স্থানীয় সরকার অনুরোধ করলেই কেবল এ ভোটের আয়োজন করে তারা।
গত সোমবার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আইনগুলো সংশোধনের পর জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় নির্বাচিত সব চেয়ারম্যান ও মেয়রদের অপসারণ করেছে নতুন সরকার।
স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আলাদা আলাদা প্রজ্ঞাপনে জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও মেয়রদের অপসারণ করা হয়। পাশাপাশি আলাদাভাবে প্রশাসক নিয়োগের প্রজ্ঞাপনও হয়।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর এই পদগুলোর প্রায় সবকটিতে আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন। তারা ভোটে নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাপক রদবদল চলছে প্রশাসনে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় প্রশাসক নিয়োগের বিধান রেখে গত রবিবারই আইনগুলো সংশোধন করা হয়।
সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন হয়। আইন সংশোধনের একদিন পরই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের প্রজ্ঞাপন জারি হয় স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে।
এ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ এসোসিয়েশনের সভাপতি ড. হারুন- অর- রশীদ সকাল সন্ধ্যকে বলেন, “উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অপসারণ করেছে। ইচ্ছে করলেই সেটা পুনর্বহাল করার সুযোগ নেই। যত দ্রুত সম্ভব ভোট করে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা দিতে হবে।”
সংসদ নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকারের ভোট প্রয়োজন বলে মনে করেন হারুন। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব ভোট দিতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের বিকল্প তো জনপ্রতিনিধি; গণকর্মচারী না।”
জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের আলাপ হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এটি হয়েছে। যারা সরকারে এসেছে তারা আলাপ করে এটা করবে- তা আমি মনে করি না।”
বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ এসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন আরও বলেন, “আমরা সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে আইনি সংস্কার ও বাস্তবায়নের পক্ষে। সরকার ঘোষিত সংস্কারের পরে নির্বাচন দেওয়া উচিত।”
স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) আইন অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদের মেয়াদ পরিষদের প্রথম সভা থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর। ওই পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্তির আগের ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে।
তবে আইনে এও বলা আছে, আকস্মিক পদ শূন্য হলে পদটি শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বিধি অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে শূন্য পদ পূরণ করতে হবে।
দেশের ৬০টি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভাগীয় শহরের আটটি জেলা ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারদের জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বাকি জেলাগুলোতে ডিসিরা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন।
৪৯৩টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন হয়েছে। তাদের জায়গায় প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যানদেরও অপসারণ করা হয়েছে।
একইভাবে ৩২৩টি পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করা হয়েছে। অপসারণ করা হয়েছে ১২টি সিটি করপোরেশনের সব মেয়রকে।
গত ১৪ অগাস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের এক অফিস আদেশে সিটি করপোরেশনগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়। এখন বিভাগীয় কমিশনার ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় পর এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদে দায়িত্বরতরা অপসারিত হওয়ায় সেখানে দলীয় আর কেউ নেই।
জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় মেয়র ও চেয়ারম্যানরা অপসারিত হলেও সদস্য ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়নি।
ইউনিয়ন পরিষদের আইনে এই দফায় কোনও সংশোধন আনা হয়নি। তবে কর্মস্থলে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান অনুপস্থিত আছেন উল্লেখ করে একটি প্রজ্ঞাপনে ইউনিয়ন পরিষদে প্যানেল চেয়ারম্যানদের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দিতে বলা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ গতকাল সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ইউনিয়ন পরিষদগুলোর চেয়ারম্যানদের এখনই অপসারণ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জাতীয় সংসদের ভোটের আগে স্থানীয় সরকারের ভোট নিয়ে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ এসোসিয়েশনের সভাপতি ড. হারুন- অর- রশীদের সঙ্গে একমত নন সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম। তার মতে সংসদ নির্বাচনের পরই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করা উচিত।
সকাল সন্ধ্যার এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, “একটা রিভলিউশনারি গভর্মেন্ট ক্ষমতায় এসেছে। অনেকেই বলছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা। পুরোনো কোনও কিছুই থাকবে না। ওনারা মনে করছেন, এদের রেখে সংস্কার কাজ করা যাবে না। তাই বাদ দিয়েছেন।
“এটা তো ৭১ সালেও হয়েছে। তখন তো ইউনিয়ন পরিষদ ও বাতিল হয়েছিল। সবকিছুই বাতিল ছিল।”
রফিকুল ইসলাম বলেন, “যারা এই দায়িত্ব পেয়েছেন, তারাও তো সরকারের কর্মচারী। এই সরকারের কর্মকর্তা এদের আমলেই নিয়োগ হয়েছে। তাদরে ঘাড়েও তো দায় পড়ে।”
সংসদ ভোটের আগে স্থানীয় সরকার ভোট করা উচিত কি না- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “আইনটাকে পরিবর্তন করতে হবে। সংস্কার করতে হলে তো সংসদ লাগবে। তা না হলে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে পরিবর্তন করতে হবে। সেখানে রাষ্ট্রপতি নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরে করতে চাইবে। তারা আগে জাতীয় নির্বাচন করবে তারপর স্থানীয় নির্বাচন।”
বেসরকারি সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ৬ মাসের মধ্যে স্থানীয় সরকারের ভোট করা উচিত বলে মনে করেন।
এই স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তাহলে তাদের অভিজ্ঞতা হবে। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে আইন সংশোধন করতে হবে। সংসদ হলে তারা অনুমোদন করে দিবে।”
স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের অপসারণের বিষয়ে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “এটা ছাড়া তো তাদের (বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের) আর কোনও উপায় ছিল না। অনেকে উপজেলায় আসছে না। পলাতক রয়েছে। তাই অপসারণ করেছে।”
কোনও কথা বলবেন না আইভি
সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করা উচিত কি না জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সদ্যসাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, “আমি এ ব্যাপারে কোনও কথা বলব না। কারণ আমি স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি। তাই এই কথাটা বলছি।”
অপসারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “কী মন্তব্য দিব? বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ আইনে তারা এটা করছে।”
আইভী বলেন, “সারা বাংলাদেশ, পৃথিবীর মানুষ তো দেখছে- নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন কেমন হইছে? আমি তো যেনতেনভাবে বিজয়ী হয়ে আসি নাই। রংপুর, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ এই তিনটা নির্বাচন তো ভালো হইছে। আমার সঙ্গে ইনজাস্টিস হয়ে গেল না?”
‘স্থানীয় সরকারের চিঠি পেলে ভোট করবে কমিশন’
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই ভোট আয়োজন করা তো নির্বাচন কমিশনের কাজ না। এটা স্থানীয় সরকারের ভোট। স্থানীয় সরকার যখন আমাদের চিঠি দেয়, তখন তাদের অনুরোধে আমরা এই ভোট আয়োজন করি। আইনে এরকম বলা আছে।”