Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫

রথসচাইল্ডদের এত সম্পদ কী করে হলো

রথসচাইল্ড পরিবার
রথসচাইল্ড পরিবার
[publishpress_authors_box]

জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রভাবশালী ব্যাংকিং ব্যবসায়ী পরিবারের নাম রথসচাইল্ড। এটি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। এককালে এই পরিবারটিই ছিল বিশ্বের শীর্ষ ধনী।

বিশাল এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন আঠারো শতাব্দীতে মায়ার আমশেল রথসচাইল্ড। তার পাঁচ সন্তান- নাথান মায়ার, জেমস মায়ার, সলোমন মায়ার, কার্ল মায়ার ও অ্যামশেল মায়ারের হাত ধরে এই পরিবারের খ্যাতি সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। আমশেল বিশ্বাস করতেন, ব্যবসাটি পরিবারের মধ্যে থাকলে ভবিষ্যতে সফলতা আসবে। তার এই ভাবনা যে ঠিক ছিল, তা পরবর্তী সময়ে টের পাওয়া যায়।

রথসচাইল্ড পরিবার গোটা ইউরোপে লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় খ্যাতি পেয়েছিল। লন্ডন, প্যারিস, ভিয়েনা ও নেপলসে শাখা খুলে আন্তর্জাতিক অর্থায়নের বিকাশের সূচনা তাদেরই হাত ধরে।

পণ্য কেনা-বেচা ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ছোট ব্যবসা থেকে শুরু করে পরিবারটি তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বহু ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত করে। এসবের মধ্যে – মার্চেন্ট ব্যাংকিং, প্রাইভেট ব্যাংকিং, সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বিমা, পেনশন ও বিনিয়োগসহ আরও অনেক ক্ষেত্র।

রথসচাইল্ড পরিবার আজও অর্থনীতিতে তাদের প্রভাব বজায় রেখেছে। তাদের বিনিয়োগ সেতু, টানেল ও রেলওয়ের মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্পেও আছে। সম্ভবত তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি সুয়েজ খাল। এছাড়া হোটেল, গণমাধ্যম, পরিবহন ও ওয়াইন শিল্পেও তাদের বিনিয়োগ আছে।

প্রতিষ্ঠাতা মায়ার আমশেল রথসচাইল্ড

মায়ের আমশেল রথসচাইল্ড (১৭৪৪-১৮১২) ফ্রাঙ্কফুর্টের জুডেনগাসে নামের সরু গলিতে বেড়ে ওঠেন। এই গলিটি ছিল শহরের ৩ হাজার ইহুদি বাসিন্দাদের বসবাসের জন্য নির্ধারিত স্থান। সেখানকার ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে ইহুদিদের রাতে, রবিবারে ও খ্রিস্টানদের ছুটির দিনে বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ ছিল। উদ্যান ও কফি শপে যাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল তাদের। জনসমাবেশে দুই জনের বেশি ইহুদি একসঙ্গে হাঁটতে পারত না।

ব্যারন এডমন্ড ডি রথচাইল্ড

মায়ার রথসচাইল্ড ছোটবেলা থেকেই ব্যবসার খুঁটিনাটি শিখেছিলেন। তার বাবা আমশেল মোজেস রথসচাইল্ড রেশমি কাপড়ের ব্যবসা ও মুদ্রা বিনিময়ের কাজ করতেন। মায়ারের প্রথম দিকের কাজগুলোর একটি ছিল ফ্রাঙ্কফুর্টে প্রতি ছয় মাসে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য মেলায় পাওয়া মুদ্রাগুলোকে বাছাই করা। এই মেলায় গোটা অঞ্চলের ক্রেতা ও বিক্রেতা আসতো।

মায়ারের ১২ বছর বয়সে বসন্ত রোগে তার বাবা-মা মারা যান। তিনি তার আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। তারা তাকে শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রখ্যাত ইহুদি ব্যাংকিং পরিবার সাইমন ওলফ অপেনহাইমারের কাছে হ্যানোফারে পাঠান। সেখানে তিনি বৈদেশিক বাণিজ্য ও অর্থ ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়া প্রাচীন রোম, পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের মতো স্থানগুলোর বিরল মুদ্রা সম্পর্কে শেখেন।

এই বিরল মুদ্রার সংগ্রাহকরা ছিলেন রাজকুমার ও ধনী ব্যক্তিরা। যারা তাদের সঙ্গে লেনদেন করতেন সেই ইহুদি ব্যবসায়ীদের ‘কোর্ট জিউস‘ বা ‘কোর্ট ফ্যাক্টর‘ বলা হতো। অর্থাৎ তারা অভিজাতদের সঙ্গে ব্যবসা করতেন।

ব্যাংকিং সাম্রাজ্যের সূচনা

১৯ বছর বয়সে ১৭৬৩ সালে মায়ার ফ্রাঙ্কফুর্টে ফেরেন। তার বাবার শুরু করা ব্যবসায় ভাইদের সঙ্গে যোগ দেন। তিনি বিরল মুদ্রার ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন এবং হেসের রাজকুমার ভিলহেল্মের পৃষ্ঠপোষকতা পান। এই রাজকুমারের সঙ্গে তার বাবারও ব্যবসা ছিল।

মায়েরের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। কারণ এটি অন্য আর্থিক সেবা খাতে যুক্ত হতে এবং সম্ভ্রান্তদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে মায়ারকে সাহায্য করে। রাজকুমার ভিলহেল্ম ছিলেন বিপুল সম্পদের উত্তরাধিকারী। পরে তিনি হেসে রাজপ্রাসাদের ভিলহেল্ম নবম উপাধি গ্রহণ করেন।

১৭৬৯ সালে তিনি ভিলহেল্মের কাছে ‘কোর্ট ফ্যাক্টর‘ উপাধি চান। এই সম্মানসূচক উপাধির মানে হলো, এই উপাধিধারী ব্যক্তি রাজ পরিবারের হয়ে কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, নিজের বাড়িতে হেসে ও হানাউয়ের কোর্ট অব আর্মসসহ একটি ঢাল ঝোলানোর অনুমতি মেলে। অর্থাৎ এটি অনেকটা বিজ্ঞাপনের মতো যে এই ব্যক্তি সততার সঙ্গেই ব্যবসা করেন।

মায়ার ১৭৭০ সালে এক কোর্ট ফ্যাক্টরের মেয়ে গুটলে শ্নাপারকে বিয়ে করেন। এরপর তাদের ১০ সন্তানের জন্ম হয়। এর মধ্যে পাঁচটি ছেলে ও পাঁচটি মেয়ে।

রথসচাইল্ডদের প্রভাব বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ

ফরাসি বিপ্লবের সময় রথসচাইল্ড ব্যাংকিং সাম্রাজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পায়। রথসচাইল্ডরা তখন ব্রিটিশ সরকারকে হেসিয়ান ভাড়াটে সৈন্য নিয়োগের জন্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল।

রথসচাইল্ড পরিবার

১৮০০ সালের প্রথম দিকে মায়ার রথসচাইল্ড তার ছেলেদের ফ্রাঙ্কফুর্টের পাশাপাশি নেপলস, ভিয়েনা, প্যারিস ও লন্ডনে পাঠান। এইভাবে তার পাঁচ ছেলে ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন শহরে অবস্থান করে তাদের পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনা করতে শুরু করেন। ফলে এই পাঁচ শাখা একত্রে কার্যকরভাবে প্রথম সীমান্ত অতিক্রমকারী ব্যাংক হিসেবে গড়ে ওঠে। কয়েক শতাব্দী ধরে যুদ্ধের জন্য সরকারগুলোকে ঋণ দেওয়ায় রথসচাইল্ড পরিবার বিভিন্ন শিল্পে বন্ড জমা করে। পাশাপাশি অতিরিক্ত সম্পদ গড়ে তোলার সুযোগ পায়।

মৃত্যুর আগে মায়ার রথসচাইল্ড তার উত্তরাধিকারীদের পরিবারের আর্থিক বিষয়াদি পরিচালনায় কঠোর নির্দেশাবলী দিয়ে যান। তিনি সম্পদ পরিবারের মধ্যেই রাখতে চেয়েছিলেন। এজন্য তার উইলে পিতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকার ব্যবস্থা চালু করে যান। এতে শুধু পুরুষ বংশধরদেরই সম্পদের অংশ করা হয়েছিল। মেয়েদের জন্য সরাসরি কোনো উত্তরাধিকার রাখা হয়নি। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিয়ের প্রবণতা বেড়ে যায়।

১৮২৪ থেকে ১৮৭৭ সালের মধ্যে মায়ের রথসচাইল্ডের পুরুষ বংশধরদের মধ্যে ৩৬টি বিয়ে হয়। এর মধ্যে ৩০টি বিয়ে হয় পরিবারের মধ্যে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম বা দ্বিতীয় চাচাতো ভাই-বোনদের মধ্যে বিয়ে হয়। এই সময়ের মধ্যে মাত্র চারজন রথসচাইল্ড নারী এবং দুজন পুরুষ বিয়ে করেন আত্মীয়ের বাইরে।

নাথান মায়ার রথসচাইল্ড: আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারী

চার রথসচাইল্ড ভাই যারা ব্যবসায় ভাগ্যের সন্ধানে বেড়িয়েছিলেন, তাদের মধ্যে তৃতীয় ভাই নাথান (১৭৭৭-১৮৩৬) সবচেয়ে বেশি সফলতা পেয়েছিলেন। নাথান ১৭৯৮ সালে টেক্সটাইল ব্যবসা শুরু করতে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে যান। পরে তিনি একজন ব্যাংকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে লন্ডনে যান এবং ১৮১০ সালে এন এম রথসচাইল্ড প্রতিষ্ঠা করেন।

এন এম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সন্স আজও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন পাউন্ড রাজস্ব ও ৬০৬ মিলিয়ন পাউন্ড নিট আয়ের রিপোর্ট দিয়েছে। আর এর অধীনে আছে ১০১ দশমিক ৬ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ।

অন্য রথসচাইল্ড ব্যাংকগুলোর মতো এন এম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সন্সও সংকটের সময়ে ব্রিটিশ সরকারকে ঋণ দিত। নেপোলিয়নের যুদ্ধের সময় ব্যাংকটি সরকারকে তার মিত্রদের দেওয়া অনুদান পরিচালনা ও অর্থায়ন করেছিল। পাশাপাশি ব্রিটিশ সৈন্যদের বেতন দিতে ঋণ দিয়েছিল। এভাবে প্রায় এককভাবেই তারা যুদ্ধের জন্য অর্থ সরবরাহ করেছিল।

নাথান মায়ার রথসচাইল্ড

নাথান রথসচাইল্ড ও মোজেস মন্টেফিওর যৌথভাবে ১৮২৪ সালে ‘অ্যালায়েন্স অ্যাসুরেন্স কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বর্তমানে আরএসএ গ্রুপের অধীন। ১৮৩৫ সালে নাথান স্পেনের পারদ খনির মালিক হন। এর মধ্য দিয়ে এই রাসায়নিক উপাদানের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য পান তিনি। সোনা ও রুপার পরিশোধনে এই উপাদানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৫২ সালে যখন এনএম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সন্স ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ও রয়্যাল মিন্টের জন্য সোনা ও রুপা পরিশোধন শুরু করে, তখন এই সরবরাহ অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে ওঠে।

ক্রমবর্ধমান দাতব্য কার্যক্রম

নাথান রথসচাইল্ড ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য অনেক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তার পরিবার পরে প্যারিস ও লন্ডনে দাতব্য কার্যক্রম চালায়। লন্ডনে একটি সিনাগগও তৈরি হয়েছিল তার পরিবারের হাতেই। পরে এই পরিবার ইসরায়েলের উন্নয়নে সহায়তা করে এবং বেসরকারি আবাসন ও সরকারি ভবন নির্মাণে সহায়তা করে।

নাথানের ছোট মেয়ে লুইস এবং তার সাত মেয়ে ফ্রাঙ্কফুর্টে ৩০টি রথসচাইল্ড দাতব্য প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছিল জনসাধারণের জন্য লাইব্রেরি, অনাহারীদের জন্য আশ্রয়, হাসপাতাল, বয়স্কদের জন্য আশ্রয়, শিক্ষার জন্য বিশেষ তহবিল।

লন্ডনের দ্য জিউস ফ্রি স্কুলে রথসচাইল্ড পরিবার অনেক অর্থ সহায়তা দিয়েছিল। এছাড়া অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও ইসরায়েলে শিক্ষা বিস্তারে এই পরিবারের ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষার অর্থ সহায়তার পাশাপাশি পরিবারটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ৬০ হাজারের বেশি শিল্পকলা সম্পদ দান করেছে।

বিংশ শতাব্দীতে রথসচাইল্ড পরিবার

পরবর্তী ১০০ বছরে যুদ্ধ, রাজনীতি ও পারিবারিক কলহে রথসচাইল্ড পরিবারের সম্পদ কমে যায়। ১৮৬৩ সালে নেপলস শাখার ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়। ১৯০১ সালে পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকায় ফ্রাঙ্কফুর্ট শাখাটিও বন্ধ হয়। ১৯৩৮ সালে নাৎসিদের অস্ট্রিয়া আক্রমণ এবং ইহুদিদের উপর বিপদের কারণে ভিয়েনা শাখাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

যুদ্ধের সময় ফ্রান্সের ভিশি সরকার রথসচাইল্ড পরিবারের বোর্দো এলাকার সম্পত্তি জব্দ করে। এছাড়া নাৎসিরা অস্ট্রিয়ার রথসচাইল্ড শাখা থেকে কোটি কোটি ডলার মূল্যের শিল্পকলা ও অন্য মূল্যবান জিনিসপত্র জব্দ করে। বছরের পর বছর ধরে পরিবারটির প্রাসাদগুলো ব্রিটিশ ও ফরাসি সরকার, অন্যান্য সংগঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দান করা হয়।

১৯৭০ সালের দিকে মাত্র তিনটি রথসচাইল্ড ব্যাংক অবশিষ্ট ছিল। লন্ডন ও প্যারিস শাখা ও এডমন্ড অ্যাডলফ ডি রথসচাইল্ডের (১৯২৬-১৯৯৭) প্রতিষ্ঠিত একটি সুইস ব্যাংক। ১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতেরঁর বাম সরকার প্যারিস ব্যাংককে জাতীয়করণ করে। এর নাম পরিবর্তন করে `কোম্পানি ইউরোপিয়েন দি ব্যাংক‘ রাখা হয়। এই ঘটনার ফলে রথসচাইল্ড পরিবারের আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এডমন্ড তার চাচাত ভাই ব্যারন ডেভিড রেনে জেমস ডি রথসচাইল্ডকে সাহায্য করেন। ডেভিড থাকতেন প্যারিসে। ১৯৮৭ সালে রথসচাইল্ড অ্যান্ড সি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৩ সালের মধ্যে পরিবারটির ব্রিটিশ ও ফরাসি ব্যাংকগুলোতে ডেভিডকে চেয়ারম্যান বানিয়ে সেগুলোকে একত্রিত করা হয়।

পাঁচ ভাই ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার প্রায় দুই শতাব্দী পর ২০০৮ সালে প্যারিস অরলিয়ান্স নামে একটি ফ্রান্সভিত্তিক শেয়ারহোল্ডিং কোম্পানির অধীনে রথসচাইল্ড পরিবারের সব সম্পদ একত্রিত করা হয়। এই ঘটনা পরিবারটির ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

একবিংশ শতাব্দীতে রথসচাইল্ড

ঐতিহ্যগতভাবে রথসচাইল্ডরা তাদের সম্পদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে। আজও তাই তাদের কোম্পানিগুলো সফলতা ধরে রেখেছে। পরিবারের সদস্যরা এই কোম্পানিগুলোতে সরাসরি চাকরি অথবা পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখা বিভিন্ন কার্যক্রমে বিনিয়োগ করেন।

রথসচাইল্ড পরিবারের উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মূলে রয়েছে – পরিবারের সদস্যদের সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকা, ঝুঁকি নিতে ভয় না পাওয়া, নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ অন্বেষণে আগ্রহী ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি। এসব কারণেই পরিবারটি শতাব্দী ধরে ধন-সম্পদ ও প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখতে পেরেছে।

নাথান রথসচাইল্ডের সম্পত্তি পরিবারের অন্য সম্পদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিল। প্রত্যেক প্রজন্মের রথসচাইল্ডরা পরবর্তী প্রজন্মকে এই সম্মিলিত সম্পদ ছেড়ে যান। পরিবারটির বংশধররা আজও বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অর্থায়ন এবং শিক্ষামূলক, মানবিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক উদ্যোগে অবদান রাখেন।

৪র্থ ব্যারন রথসচাইল্ড

লর্ড জ্যাকব রথসচাইল্ড

পরিবারটির সর্বশেষ প্রধান ছিলেন জ্যাকব রথসচাইল্ড। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তাকে ঘিরে ব্রিটিশ মিডিয়ায় গল্পের শেষ নেই। ব্যাংক খাতে তার নেওয়া ঝুঁকি ও সিদ্ধান্তের জন্য একবার এক ব্রিটিশ সাংবাদিক রথসচাইল্ড পরিবারকে লন্ডনের ইতিহাসের ‘সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাংকিং পরিবার’ বলেছিলেন।

বিখ্যাত ব্যাংকিং পরিবারে জন্ম নেওয়া জ্যাকব রথসচাইল্ড আর্থিক জগতে নিজের স্বতন্ত্র চিহ্ন রেখেছেন। ইটন কলেজ ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার পর পারিবারিক ব্যাংক এন এম রথসচাইল্ড অ্যান্ড সন্সে কয়েক বছর কাজ করেন তিনি। ১৯৮০ সালে তিনি পরিবারের ঐতিহ্য থেকে সরে এসে জে রথসচাইল্ড ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠা ও আরআইটি ক্যাপিটাল পার্টনার্স পিএলসির মতো কোম্পানিগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

জ্যাকব রথসচাইল্ড ইউরোপের ইহুদিদের সমর্থন করে গেছেন সবসময়। তিনি ‘দ্য রথসচাইল্ড ফাউন্ডেশন (হানাদিভ) ইউরোপ‘ এর নেতৃত্বের মাধ্যমে এই সম্প্রদায়ের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এছাড়া তিনি `ইনস্টিটিউট ফর জুইস পলিসি রিসার্চ’ এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতি পেলেও তার জীবনের মূল ভিত্তি ছিল ইহুদি ধর্ম, ইসরায়েল ও জায়নবাদের প্রতি নিষ্ঠা।

জ্যাকব রথসচাইল্ড কি ইসরায়েলের সমর্থক ছিলেন

রথসচাইল্ড পরিবারের দাতব্য সংস্থা ইয়াদ হানাদিবের চেয়ারম্যান হিসেবে ইসরায়েলের প্রতি জ্যাকবের দৃঢ় সমর্থন ছিল। তার নেতৃত্বে এই সংস্থা ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ সহায়তা করেছে। ইসরায়েলের পার্লামেন্ট ভবন নেসেট, সুপ্রিম কোর্ট, জাতীয় গ্রন্থাগার তৈরি করে দিয়েছে রথসচাইল্ড পরিবার। গ্রন্থাগারটি উদ্বোধন করার কথা ছিল জ্যাকবের। কিন্তু তার আগেই তিনি মারা গেলেন।

জীবদ্দশায় জ্যাকব প্রায়ই ছুটে গেছেন ইসরায়েল। বিভিন্নভাবে তিনি দেশটির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা প্রকাশও করেছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব নিয়ে তাকে তেমন একটা কথা বলতে দেখা যায়নি। তার পরিবারের পূর্বসূরিরা ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠায় সরাসরি ভূমিকা রেখেছিলেন। ফিলিস্তিনি জনগণের কথা না শুনে রথসচাইল্ডদের সমর্থনেই ব্রিটেন বেলফোর ঘোষণা দিয়েছিল।

২০১৪ সালে জ্যাকব দাবি করেন, “আমরা ইসরায়েলকে সমর্থন করি। তবে সেটা রাজনৈতিকভাবে নয়। আরব-ফিলিস্তিনি জনগণকে একত্রিত করতে আমরা অনেক কাজ করেছি।”

রথসচাইল্ড পরিবার ও বেলফোর চুক্তি

এডমন্ড ডি রথসচাইল্ড জায়নবাদের সমর্থক ছিলেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে, তিনি অটোমান ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসনকে সমর্থন করে উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে ওই অঞ্চলটি ‘ম্যান্ডেট প্যালেস্টাইন’ নামে পরিচিতি পায়।

এডমন্ডের ছেলে জেমস ডি রথসচাইল্ড ও তার স্ত্রী ডরোথি এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছিলেন। তারা জায়নিস্ট নেতা চাইম ওয়েজম্যানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। ব্রিটিশ রাজনীতিতে তাদের সংযোগগুলো ১৯১৭ সালের কুখ্যাত বেলফোর ঘোষণাপত্রকে সহজ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তারা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি জাতীয় আবাস গড়ে তোলার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল।

১৯৫৪ সালে ইসরায়েলে এডমন্ডকে সমাধিস্থ করার পর জেমস তার পিতার পদচিহ্ন অনুসরণ করে ইয়াদ হানাদিব প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার শতবর্ষ উপলক্ষে দেওয়া এক বিরল সাক্ষাৎকারে সদ্য প্রয়াত লর্ড জ্যাকব রথসচাইল্ড ওই ঘোষণাটিকে ‘একটি অলৌকিক ঘটনা’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। একই সঙ্গে ঘোষণার সঙ্গে তার চাচাত বোন ডরোথির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে অজানা তথ্য নিয়েও আলোচনা করেন।

জ্যাকব রথসচাইল্ড সে সময় পরিবারের জটিল সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেন। তার আত্মীয় ওয়াল্টার রথসচাইল্ড পরবর্তী জীবনে জায়নবাদের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। তবে পরিবারের কেউ কেউ ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। জ্যাকব নিজেই ১৯৬০ এর দশক থেকে প্রতি বছর ইসরায়েল সফরের মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে তার দৃঢ় সম্পর্ক প্রকাশ করেছেন। তবে বেলফোর ঘোষণাপত্রটি দেওয়া হয়েছিল জ্যাকবের চাচা লর্ড ওয়াল্টারকে।

জ্যাকবের মৃত্যুর পর এখন তার মেয়ে হান্না হবেন ইয়াদ হানাদিবের চেয়ারম্যান। তিনিও তার বাবার মতোই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন বলেই অনুমেয়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত