বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ বলা হয় ভারতকে, সেই দেশের নাগরিকরাই এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনকে শ্রেয় মনে করছেন! শুধু কি তাই, এর বড় একটি অংশ সেনাশাসনেরও পক্ষে।
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের নাজুক অবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।
কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি সমর্থন শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের আরও অনেক দেশে বাড়ছে বলে দেখা যাচ্ছে এই জরিপে। যে দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপের দেশও রয়েছে।
২০২৩ সালে ২৪টি দেশে এক জরিপ চালায় পিউ রিসার্চ সেন্টার।
জরিপে দুটি ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। একটি এমন ব্যবস্থা যেখানে একজন শক্তিশালী নেতা আইনসভা বা আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অন্য ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনী দেশ পরিচালনা করে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ভারতীয়দের মধ্যে ৮৫ শতাংশই মনে করেন তাদের দেশে জন্য সামরিক বা কর্তৃত্ববাদী নেতার শাসন ভালো হবে।
২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রকে ভালো শাসন ব্যবস্থা বলে মনে করা ভারতীয়র সংখ্যা অনেক কমেছে।
‘গ্লোবাল অ্যাটিটিউডস সার্ভে’ শীর্ষ এই জরিপ বলছে, অধিকাংশ ভারতীয় চান একজন নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে একজন দক্ষ শাসক দেশ শাসন করুক।
ভারতের ৮৫ শতাংশ মানুষ যেখানে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাকে সমর্থন করে, সেখানে ইউরোপের দেশ সুইডেনে এই হার মাত্র ৮ শতাংশ।
জরিপটি চালানো হয় ২০২৩ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১১ মের মধ্যে। প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
জরিপে বাদ দেওয়া হয় ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং লক্ষাদ্বীপ।
জরিপের নমুনা নির্বাচনে লিঙ্গ, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, অঞ্চল ও শহর-গ্রামীণ বৈশিষ্ট্যের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে বলে পিউ রিসার্চ সেন্টার জানায়।
বাড়ছে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার সমর্থন
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, স্পেন, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, সুইডেন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েল, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় জরিপটি চালানো হয়।
তাতে দেখা যায়, এই দেশগুলোর মধ্যে গড় ৩১ শতাংশ মানুষই কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থাকে সমর্থন করেন।
ধনী দেশগুলোর তুলনায় মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি সমর্থন বেশি। এশিয়া-প্যাসিফিক, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার তুলনায় এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন বেশি দেখা গেছে।
জরিপের প্রবণতা অনুসারে, নিম্ন আয়ের মানুষদের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন বেশি উচ্চ আয়ের মানুষের তুলনায়।
বয়সের তারতম্যের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি সমর্থনেও পার্থক্য দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ৩৮ শতাংশ তরুণ কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সমর্থন করেছে। একই ধরনের প্রবণতা ভারত ও অস্ট্রেলিয়াতেও দেখা গেছে।
অন্যদিকে গ্রিস, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি সমর্থন তরুণদের চেয়ে বেশি।
ভারতে বিরোধী দলের স্বাধীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এমন মানুষের সংখ্যা তৃতীয় সর্বনিম্ন।
গত কয়েক বছরে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০২২ সালের সঙ্গে ২০১৭ এর জরিপের তুলনা করলে দেখা যায়, ২২টি দেশের মধ্যে ১১টিতেই একে শাসনের একটি কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে মনে করা জনসংখ্যার হার কমেছে।
শুধু অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রেই এই পরিবর্তন তেমন হয়নি। প্রবণতার এই পরিবর্তনের কারণ হিসেবে আংশিকভাবে কোভিড-১৯ মহামারিকে দায়ী করা হচ্ছে।
এদিকে ইসরায়েলের জনগণ নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছে। তারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতানিয়াহুকে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কোনো সরকারি পদে নির্বাচিত হতে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েলি গণতন্ত্র উন্নত হবে বলে মনে করছেন।
ইউরোপে ডানপন্থি পপুলিস্ট দলগুলোর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন মানুষেরাই সাধারণত কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সমর্থন করে।
উদাহরণ হিসেবে জার্মানিতে যারা আল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) দলের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন, তাদের ৩৭ শতাংশই এই অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে সমর্থন করে। আর এএফডির প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এমন মানুষের মধ্যে এই সমর্থনের হার মাত্র ১৩ শতাংশ।
কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন ও গণতন্ত্রের ধারণার মধ্যে সম্পর্ক
২০১৯ সালের এক জরিপে অংশগ্রহণকারীদেরকে ন্যায্য বিচার ব্যবস্থা, লৈঙ্গিক সমতা, নিয়মিত নির্বাচন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটে স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার সংগঠন ও বিরোধী দলগুলোর স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতাসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্ব মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছিল।
সেখানে দেখা যায়, যেসব দেশে এসব মূল্যবোধকে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা মানুষের সংখ্যা যত বেশি, সেসব দেশে শক্তিশালী নেতা বা সামরিক বাহিনীর শাসন সমর্থনকারী মানুষের সংখ্যাও তত বেশি।
বিরোধী দলগুলোর স্বাধীনভাবে কাজ করার গুরুত্ব কম মনে করা দেশগুলোতে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন বেশি দেখা যায়।
ইন্দোনেশিয়া এক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ। ২০২৩ সালের জরিপে দেখা যায়, দেশটির ৪৭ শতাংশ মানুষই বিরোধী দলগুলোকে তাদের দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। ইন্দোনেশিয়ার ৭৭ শতাংশ মানুষ চান কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা।
কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার সমর্থকরা গণতন্ত্রকে উন্নত করতে যা ভাবেন
জরিপে গণতন্ত্রকে আরও কীভাবে কার্যকর করা যায় সে সম্পর্কেও প্রশ্নও করা হয়েছিল।
কিছু জায়গায় অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তুলনামূলক বেশি সমর্থন থাকা সত্ত্বেও, খুব কম লোকই তাদের বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দিয়েছেন। কেবল গ্রিস, ইসরায়েল ও স্পেনে ১ শতাংশ মানুষ স্বেচ্ছায় এটিকে সমাধান হিসেবে দেখছেন।
যারা গণতন্ত্রের পরিবর্তে অন্য ব্যবস্থার পক্ষে মতামত দিয়েছেন, তাদের পছন্দের ব্যবস্থাগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ। যেমন; সামরিক শাসন, দক্ষ শাসন, একনায়কতন্ত্র, ঈশ্বরতন্ত্র, অগণতন্ত্র ও বিপ্লব।
তথ্যসূত্র : পিউ রিসার্চ সেন্টার