এক দশক আগে ২০১৪ সালে উড়োজাহাজ চলাচলের ইতিহাসে রহস্যজনক এক ঘটনা ঘটে। কোনও চিহ্ন না রেখে সে বছর শত শত যাত্রী নিয়ে উধাও হয়ে যায় মালয়েশিয়ার একটি উড়োজাহাজ।
অনুসন্ধানকারীরা আজ পর্যন্ত জানেন না, উড়োজাহাজটির ঠিক কী হয়েছিল। এর ২৩৯ যাত্রীর ভাগ্যেও বা কী জুটেছিল, তা আজও অজানা।
হঠাৎ ১০ বছর পর সেই হারিয়ে যাওয়া উড়োজাহাজের অনুসন্ধান নতুন করে শুরু করতে যাচ্ছে মালয়েশিয়া সরকার। এর কারণও আছে।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামুদ্রিক রোবোটিক্স কোম্পানি এমএইচ৩৭০ নামের ওই উড়োজাহাজের হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তারা ব্যর্থ হয়।
সম্প্রতি ওই রোবোটিক্স কোম্পানি নতুন করে উড়োজাহাজটি অনুসন্ধানের প্রস্তাব মালয়েশিয়া সরকারকে দিয়েছে।
এরই জেরে মালয়েশিয়া সরকার রবিবার জানিয়েছে, এমএইচ৩৭০ উড়োজাহাজের অনুসন্ধান কার্যক্রম ফের শুরু হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সবার ধারণা, ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে মালয়েশিয়ার উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। এটিকে ওই অঞ্চলে তন্নতন্ন করে খুঁজেছিল কয়েকটি দেশ। কোনও লাভ হয়নি। দেহ বা ধ্বংসাবশেষ কিছুই পাওয়া যায়নি।
নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন পর উড়োজাহাজটির ছোট ছোট টুকরো তীরে ভেসে এসেছিল। পাওয়া বলতে গেলে ওইটুকুই।
হারালো যেভাবে
২০১৪ সালের ৮ মার্চ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর ছেড়ে বেইজিংয়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল এমএইচ৩৭০। উড়োজাহাজের পাইলট কুয়ালালামপুর ছাড়ার আগে শেষ বেতার বার্তায় বলেছিলেন, “শুভরাত্রি মালয়েশিয়ান থ্রি সেভেন জিরো।”
আকাশে ওড়ার ৩৯ মিনিট পর হঠাৎ উড়োজাহাজটি রাডার থেকে উধাও হয়ে যায়। ভিয়েতনামের আকাশসীমা অতিক্রম করার পর দেশটির হো চি মিন সিটির উড়োজাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেনি এটি।
কয়েক মিনিট পর উড়োজাহাজটির ট্রান্সপন্ডার (যোগাযোগের একটি ব্যবস্থা যা উড়োজাহাজের অবস্থান এটির চলাচল নিয়ন্ত্রণকারীদের পাঠায়) বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর সেনাবাহিনীর রাডারে দেখা যায়, নিখোঁজ হওয়ার আগে উড়োজাহাজটি ঘুরে আন্দামান সাগরের দিকে যাচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত এটি যে সেদিকে উড়েছিল, তা স্যাটেলাইট ডেটার মাধ্যমে জানা যায়। সম্ভবত জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলীয় ভারত মহাসাগরের দূরবর্তী অংশে উড়োজাহাজটি আছড়ে পড়ে।
উড়ন্ত উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ সম্পর্কে নানা ধরনের ধারণা প্রচলিত ছিল। কেউ মনে করে, এটি ছিনতাই করা হয়েছিল। কারোর ধারণা, অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছিল। কেউ বা মনে করেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে এটি বিধ্বস্ত হয়।
তবে এসব ধারণা কেবল ধারণাই থেকে যায়। কারণ যেহেতু কেউ মুক্তিপণ দাবি করেনি, তাই এটি ছিনতাই হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সেদিন আবহাওয়া ছিল অনুকূল, উড়োজাহাজ থেকে বিপদ সংকেত পাঠানোরও কোনও কারণ নেই। এছাড়া যান্ত্রিক ত্রুটিরও প্রমাণ মেলেনি।
মালয়েশিয়ার নিরাপত্তা তদন্তকারীরা ২০১৮ সালে এক প্রতিবেদনে উড়োজাহাজটিতে অবস্থান করা সবাইকে নির্দোষ বলেছিলেন। তবে ‘অবৈধ হস্তক্ষেপের’ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি তদন্তকারীরা।
মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় বলা হয়েছিল, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ভূমির সঙ্গে উড়োজাহাজটির সংযোগ বন্ধ করে দেয় এবং এটির গতিপথ পরিবর্তন করে।
উড়োজাহাজটিতে যারা ছিলেন
বেইজিংয়ের উদ্দেশে রওনা দেওয়া উড়োজাহাজটিতে ২২৭ জন যাত্রী ছিলেন। এদের মধ্যে পাঁচ শিশুও ছিল। ক্রুয়ের সংখ্যা ছিল ১২। যাত্রীদের বেশিরভাগই চীনের নাগরিক। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকও এমএইচ৩৭০-এ ছিলেন।
উড়োজাহাজটির যাত্রীরা কোন উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করছিলেন, তা প্রকাশ করা হয়েছিল। যেমন দুজন ইরানি তরুণ চুরি করা পাসপোর্টের সাহায্যে ইউরোপে নতুন জীবনের সন্ধানে উড়োজাহাজটিতে চেপে বসেছিলেন। প্রদর্শনী শেষে একদল চীনা ক্যালিগ্রাফি শিল্পী বেইজিং ফিরছিলেন। এছাড়া উড়োজাহাজে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানি ফ্রিস্কেল সেমিকন্ডাক্টরের ২০ জন কর্মী, চীনা বংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরের অভিনেতা জেট লির স্টান্ট পারফরমার, হানিমুনে বের হওয়া মালয়েশিয়ার এক দম্পতিসহ অনেকে।
একের পর এক অনুসন্ধান
দক্ষিণ চীন সাগরে মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মধ্যবর্তী অঞ্চলে শুরুতে অনুসন্ধান চালায় কয়েকটি দেশের কয়েক ডজন জাহাজ ও উড়োজাহাজ। পরে যুক্ত হয় আন্দামান সাগর ও ভারত মহাসাগর।
মালয়েশিয়া ও চীনের পাশাপাশি একপর্যায়ে অনুসন্ধানে নামে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির নেতৃত্বে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় ও ব্যয়বহুল আন্ডারওয়াটার অনুসন্ধান শুরু হয়। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার উপকূল থেকে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ জুড়ে চলে এই অনুসন্ধান।
অনুসন্ধানকারী জাহাজগুলো আলট্রাসনিক সংকেত শনাক্ত করেছিল, যা হারিয়ে যাওয়া উড়োজাহাজটির ব্ল্যাক বক্স থেকে এসেছিল বলে ধারণা করা হয়।
এছাড়া ডুবে যাওয়া একটি বাণিজ্যিক জাহাজেরও ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, জাহাজটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল।
তবে দুর্ভাগ্যক্রমে নিখোঁজ হওয়া উড়োজাহাজটির সন্ধান মেলেনি।
২০১৫ সালের জুলাইয়ে ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে উড়োজাহাজটির একটি টুকরো পাওয়া যায়। সেটি যে এমএইচ৩৭০-এর ফ্লাপেরন (উড়োজাহাজের ডানার একটি অংশ যা উড্ডয়ন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে), তা পরে নিশ্চিত হয় সংশ্লিষ্টরা।
ওই ফ্লাপেরন ছিল নিখোঁজ উড়োজাহাজটির ভারত মহাসাগরে বিধ্বস্ত হওয়ার প্রথম স্পষ্ট প্রমাণ। পরে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে সমুদ্রের তীরে আরও কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ভারত মহাসাগরে অনুসন্ধান স্থগিত করা হয়।
এক বছর পর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে উড়োজাহাজটি অনুসন্ধানে মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক রোবোটিক্স কোম্পানি ওশান ইনফিনিটি। ওই কোম্পানি যদি উড়োজাহাজের হদিশ না পায়, তাহলে তারা মালয়েশিয়া সরকারের কাছ থেকে কোনও অর্থ নেবে না, এমনটা উল্লেখ ছিল চুক্তিতে।
ভারত মহাসাগরের যে অঞ্চলে আগে অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল, তার ঠিক উত্তরে খোঁজাখুঁজি শুরু করে ওশান ইনফিনিটি। কয়েক মাস পর্যন্ত চলে তাদের অনুসন্ধান। কিছুই পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানের পথে বাধা
ভারত মহাসাগরের ঠিক কোথায় উড়োজাহাজটিকে খুঁজতে হবে, তা না জানার কারণে ব্যাপক আকারে অনুসন্ধান চালানো হলেও প্রতিবার ব্যর্থ হয়।
ভারত মহাসাগর বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ মহাসাগর। এটির যে অঞ্চলে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, তা বেশ দুর্গম। ওই অঞ্চলের গড় গভীরতা প্রায় চার কিলোমিটার। এছাড়া অনুসন্ধানকারীদের প্রতিকূল পরিবেশের মুখেও পড়তে হয়।
সাধারণত গভীর সাগরে উড়োজাহাজ হারায় না। তবে হারালে ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।
এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্ক জানায়, গত ৫০ বছরে কয়েক ডজন উড়োজাহাজ উধাও হয়ে গেছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ
মালয়েশিয়া সরকার বারবার বলে আসছে, বিশ্বাসযোগ্য নতুন প্রমাণ পাওয়া গেলেই কেবল উড়োজাহাজটির খোঁজ ফের শুরু হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ওশান ইনফিনিটি যেহেতু সম্প্রতি নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ফের অনুসন্ধান কর্মকাণ্ড শুরুর প্রস্তাব দিয়েছে, তাই নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে দেশটি।
উড়োজাহাজটির অবস্থান সম্পর্কে নতুন কোনও প্রমাণ ওশান ইনফিনিটির হাতে এসেছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি।
এমএইচ৩৭০-এ ভ্রমণ করা নিখোঁজ যাত্রীদের পরিবার আজও তাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে নাছোড়বান্দা। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও তারা রহস্যের কিনারা দেখতে চাইছেন। তাদের এই চাওয়া কেবল ব্যক্তিগত জায়গা থেকে নয়।
ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগ দেখা দিলে তা যেন ঠেকানো যায়, তার জন্যও নিখোঁজদের স্বজনরা প্রশ্নের উত্তর পেতে মরিয়া।
তথ্যসূত্র : এপি