Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪
Beta
সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

চীনের সঙ্গে চুক্তি করে কি ভারতকে বার্তা দিতে চাইছে মালদ্বীপ

চীনের আন্তর্জাতিক সামরিক সহযোগিতা দপ্তরের উপ পরিচালক মেজর জেনারেল ঝাং বাওকুন ও মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোহাম্মদ ঘাসান মাউমুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। ছবি: মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক্স পোস্ট থেকে।
চীনের আন্তর্জাতিক সামরিক সহযোগিতা দপ্তরের উপ পরিচালক মেজর জেনারেল ঝাং বাওকুন ও মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোহাম্মদ ঘাসান মাউমুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। ছবি: মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক্স পোস্ট থেকে।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ভারত মালদ্বীপের কাছে নৌঘাঁটি করতে যাচ্ছে, এমন কথা চাউর হওয়ার পরপরই চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির খবর দিল মালে।

এর মধ্য দিয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের চলমান টানাপড়েন আরও বাড়ার ইঙ্গিতই মিলছে। মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মালদ্বীপ যে ভারতকে ছেড়ে চীনের দিকে ঘেঁষছে, তা উদ্বেগ নিয়েই দেখছেন ভারতের বিশ্লেষকরা।

ভারতীয় সেনাদের সরিয়ে নিতে মালের চাপের মধ্যে শনিবার নয়া দিল্লি জানিয়েছিল, তারা মালদ্বীপের কাছাকাছি লক্ষদ্বীপপুঞ্জের মিনিকয় দ্বীপে আরেকটি নৌঁঘাটি স্থাপন করবে।

পরদিন রবিবারই চীন মালদ্বীপের সঙ্গে শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তুলতে বিনামূল্যে সামরিক সহায়তা দেওয়ার একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিতে সই করে।

চীনের আন্তর্জাতিক সামরিক সহযোগিতা দপ্তরের উপ পরিচালক মেজর জেনারেল ঝাং বাওকুন এখন মালদ্বীপ সফরে রয়েছেন। তিনিই মালদ্বীপের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ ঘাসান মাউমুনের সঙ্গে চুক্তিতে সই করেন।

চুক্তির খবর দিয়ে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের এক্স হ্যান্ডেলে এক পোস্টে বলেছে, “এতে দুদেশের শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও মজবুত হলো।”

চীন মালদ্বীপকে ১২টি পরিবেশবান্ধব অ্যাম্বুলেন্সও উপহার দিয়েছে বলে জানা গেছে।

ফেব্রুয়ারির শুরুতে সমুদ্র গবেষণার জন্য পরিচালিত চীনের জাহাজ শিয়াং ইয়াং হং ০৩কে নিজেদের বন্দরে ভেড়ার অনুমতি দেয় মালদ্বীপ। তার এক মাসের মধ্যেই চীনের সামরিক প্রতিনিধিদলের এই মালদ্বীপ সফর।

ভারতের অভিযোগ, চীনের এই জাহাজ মূলত ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ডুবোজাহাজ পরিচালনার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মতো সামরিক উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহের জন্য এসেছে।

এর আগে শ্রীলঙ্কার বন্দরে চীনের এ ধরনের গবেষণা জাহাজের উপস্থিতি নিয়েও আপত্তি জানিয়েছিল ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। তাতে শ্রীলঙ্কার জলসীমায় সব ধরনের গবেষণা জাহাজ প্রবেশ এক বছরের জন্য স্থগিত করে কলম্বো।

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের লক্ষদ্বীপের মিনিকয় থেকে মালদ্বীপের দূরত্ব মাত্র ৭০ নটিক্যাল মাইল এবং মূল ভূখণ্ডের পশ্চিম উপকূল থেকে ৩০০ নটিক্যাল মাইল। ভারত মহাসাগর অঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলমান বাণিজ্যিক সমুদ্রপথের কেন্দ্রস্থলে এর অবস্থান দেশটিকে কৌশলগতভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।

তাই ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে নজর রাখতে মালদ্বীপকে প্রয়োজন দিল্লির। চীনও ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের জন্য মালদ্বীপকে হাতে রাখতে চায়।

ভারত মহাসাগরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভারত ও চীনের এই প্রতিযোগিতার প্রভাব পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেই পড়বে।

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু।

মুইজ্জু আসার পর থেকেই উত্তেজনা

পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস নেতা মোহাম্মদ মুইজ্জু গত বছরের নভেম্বরে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। চিনপন্থি এই নেতা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই ভারতের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে অবনতি ঘটতে থাকে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে থেকেই মুইজ্জু মালদ্বীপের আগের সরকারের ভারতকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি মালদ্বীপে ভারতের সামরিক উপস্থিতির অবসান ঘটানোরও প্রতিশ্রুতি দেন।

ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যেই গত ডিসেম্বরে মুইজ্জু সরকার জানায়, তারা ভারতের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে। ওই চুক্তিতে ভারতকে মালদ্বীপের আঞ্চলিক জলসীমায় সমুদ্রতলের মানচিত্র তৈরিতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

মুইজ্জু সরকারের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানান, ২০২৪ সালের জুনে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। এরপর আর চুক্তিটি নবায়ন করা হবে না।

এছাড়া আগের সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে করা আরও ১০০টি চুক্তিও নতুন করে পর্যালোচনা করে দেখার ঘোষণা দেয় মুইজ্জু সরকার।

মালদ্বীপের সব প্রেসিডেন্ট যখন নিজ নিজ প্রথম বিদেশ সফরে ভারতে যেতেন। সেখানে মুইজ্জু তার প্রথম সফরে জানুয়ারিতে চীন গেলে দিল্লি-মালে টানাপড়েন দেখা দেয়।

চীন থেকে ফিরে মুইজ্জু তার দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারের জন্যও ভারতকে চুড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দেন। তিনি বলে দেন, আগামী ১০ মার্চ থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে ভারতীয় সেনাদের মালদ্বীপ ছাড়া শুরু করতে হবে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মোহাম্মদ মুইজ্জু।

১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকে উৎখাতের একটি অভ্যুত্থান ঠেকাতে মালদ্বীপে সেনা পাঠিয়েছিল ভারত। সেই অভিযান শেষ হওয়ার পরপরই ওই সেনাদের ফেরত নিয়ে আসে ভারত।

এরপর গত সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ে। এখন যে ভারতীয় সেনারা মালদ্বীপে রয়েছে, তারা গেছেন ২০১০ সালে মোহাম্মদ নাশিদ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট থাকার সময়।

ভারতের ৭৭ সেনার এই কন্টিনজেন্ট দেশটির বিমানবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে। তারা দুটি হেলিকপ্টার ও একটি বিমান পরিচালনা করার কাজে নিয়োজিত আছে, যেগুলো চিকিৎসা পরিবহন এবং মানবিক সহায়তা মিশন পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।

তাদের জায়গায় এবার ভারত থেকে বেসামরিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হবে।

চীনা সামরিক প্রতিনিধিদলের সফরের কয়েকদিন আগেই ভারত থেকে বেসামরিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের প্রথম দলটি মালদ্বীপে পৌঁছায়। একটি উন্নত হালকা হেলিকপ্টারের দেখভালে নিয়োজিত থাকা ভারতীয় সামরিক কর্মীদের জায়গায় তাদের নিয়োগ করা হবে।

ঐতিহ্যগতভাবেই ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক। দেশটির ৫ লাখ নাগরিক চাল, ডাল, শাকসবজি, ওষুধ ও মানবিক সহায়তাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসের জন্যও নয়া দিল্লির ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু ভারতের ওপর অতি নির্ভরশীলতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নয়া দিল্লির হস্তক্ষেপ মালদ্বীপের জনগণের মাঝে উদ্বেগও সৃষ্টি করেছে। আর সেই উদ্বেগকে কাজে লাগিয়েই মোহাম্মদ মুইজ্জু ক্ষমতায় আসেন।

তকে ক্ষমতায় আসতে চীন সহায়তা করেছে বলেও ধারণা করা হয়। তিনি ভারতের একচেটিয়া আধিপত্যকে মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করেন।

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর সঙ্গে গত বছরের ডিসেম্বরে দুবাইয়ে বৈঠক হয়েছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর।

লক্ষদ্বীপে দ্বিতীয় সামরিক নৌঘাঁটি ভারতের

মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে ভারত তাদের লক্ষদ্বীপপুঞ্জে নতুন সামরিক নৌঘাঁটি স্থাপন করতে চলেছে। এটি লক্ষদ্বীপপুঞ্জে ভারতের দ্বিতীয় সামরিক নৌঘাঁটি।

লক্ষদ্বীপপুঞ্জের কাভারাত্তি দ্বীপে একটি নৌঘাঁটি এখন রয়েছে ভারতের। এর নাম আইএনএস দ্বীপরক্ষক। মিনিকয় দ্বীপের নতুন ঘাঁটিটির নাম হবে ‘আইএনএস জটায়ু’। রামায়ন থেকে এসেছে এই নাম।

ভারতের নৌবাহিনী এক বিবৃতিতে তাদের নতুন নৌঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বলেছে, সরকারের তরফে আগামী ৬ মার্চ (বুধবার) আনুষ্ঠানিকভাবে আইএনএস জটায়ুর বিষয়ে ঘোষণা করা হবে।

সোমবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত মহাসাগরে নজরদারি ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে লক্ষদ্বীপে নতুন নৌঘাঁটি তৈরি করতে চলেছে ভারতীয় নৌবাহিনী।

ধারণা করা হচ্ছে, ভারত মহাসাগরে নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জলপথে অবাধে চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশপাশি উপকূলে শক্তি বাড়াতেই ওই নৌঘাঁটি তৈরি করছে ভারত।

মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা সদস্যদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরুর আগে ভারতীয় নৌবাহিনীর তরফে এই পদক্ষেপ বেশ ইঙ্গিতবহ মনে করছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো।

ভারতের সাবেক উইং কমান্ডার এবং প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রফুল্ল বক্সি বিবিসিকে বলেন, “আইএনএস জটায়ু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চলে নজরদারি করবে। মালাক্কা প্রণালীর সঙ্গে সম্পর্কিত এই জলপথ ব্যবহার করেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ হয়।

“চীন তাদের জ্বালানি ও বাণিজ্যের জন্য এই পথ ব্যবহার করে। কৌশলগতভাবেও এই অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম, বিশেষত চীনের আগ্রাসনের কথা ভাবলে। তাই এই নতুন নৌঘাঁটি কিন্তু খুব জরুরি।”

মালদ্বীপে চীনের সামরিক প্রতিনিধি দল।

চীনের সঙ্গে চুক্তির পর ভারতকে আল্টিমেটাম

সোমবার চীনের সঙ্গে নিরাপত্তা সহায়তা চুক্তির পর মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু তার ভারতবিরোধী বক্তব্য আর জোরালো করেছেন। সোমবার তিনি এক জনসভায় বলেছেন, আগামী ১০ মের পর কোনও ভারতীয় সেনা এমনকি বেসামরিক পোশাকেও কোনও ভারতীয় সামরিক কর্মী তার দেশে অবস্থান করবে না।

মালদ্বীপের স্থানীয় নিউজ পোর্টাল এডিশন ডট এমভির বরাতে ভারতের সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভি এই খবর দিয়েছে। এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সোমবার বা’আ দ্বীপের আইধাফুশিতে সেখানকার বাসিন্দাদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে মুইজ্জু বলেন, দেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের বিতাড়িত করার ক্ষেত্রে তার সরকারের সাফল্যের কারণে যারা মিথ্যা গুজব ছড়ায়, তারা পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলছি, আগামী ১০ মের পর দেশে কোনও ভারতীয় সেনা থাকবে না। ইউনিফর্মেও নয়, বেসামরিক পোশাকেও নয়। ভারতীয় সামরিক বাহিনী কোনও পোশাকেই এই দেশে থাকবে না।”

এনডিটিভি বলছে, মালদ্বীপে অবস্থানরত ভারতীয় সামরিক কর্মীদের জায়গায় বেসামরিক বিশেষজ্ঞদের নিয়োগের শর্তেই ভারত দেশটি থেকে সেনা সরিয়ে আনতে সম্মত হয়েছিলো।

কিন্তু মুইজ্জুর বিরোধীরা বলছে, সামরিক কর্মীদের ফিরিয়ে নিয়ে ভারত যে বেসামরিক কর্মীদের মালদ্বীপে পাঠিয়েছে তারা বেসামরিক পোশাকের সামরিক কর্মী।

এদিকে মালদ্বীপের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, গত সপ্তাহে শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও মালদ্বীপ আকাশ পথে চিকিৎসা পরিবহনের জন্য চুক্তি করেছে।

এ থেকেও ইঙ্গিত মেলে যে, দেশটি যে কোনওভাবেই হোক না কেন সমস্ত ভারতীয় সৈন্যদের সরাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

তথ্যসূত্র: এনডিটিভি, বিবিসি, রয়টার্স

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত