মালদ্বীপে প্রভাব বিস্তার নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনেকদিনের। গত সেপ্টেম্বরে মোহাম্মদ মুইজ্জু দেশটির রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মালদ্বীপ অনেকটাই চীনঘেঁষা হয়ে যায়। দূরে সরে যায় দীর্ঘদিনের মিত্র ভারত।
মালদ্বীপ শুধু তার সমুদ্র সৈকত ও বিলাসবহুল রিসোর্টের জন্যই পরিচিত নয়। দেশটির কৌশলগত অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই পথ দিয়েই পূর্ব থেকে পশ্চিমে জাহাজ চলাচল করে।
এমন বাস্তবতার মধ্যেই রবিবার মালদ্বীপে জাতীয় নির্বাচন হয়। ১২০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশটির ৫ লাখ ২০ হাজার জনগণের মধ্যে ২ লাখ ৮৪ হাজারেরই ভোটাধিকার আছে।
দেশটির নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, রবিবার বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ১ লাখ ৮১ হাজার ৪০৬ জন ভোট দিয়েছেন। এটি মোট ভোটারের ৬৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৯৩ হাজার ১৭৬ ও নারী ভোটার ৮৮ হাজার ২৩০ জন।
সংসদের ৯৩টি আসনের জন্য দেশটির ছয়টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্ররা মিলে মোট ৩৬৮ প্রার্থী নির্বাচনে দাড়িয়েছেন।
দেশটির প্রধান সব রাজনৈতিক দলেই বিভাজন বিদ্যমান। এর মধ্যে রয়েছে মুইজ্জুর পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন শাসক জোট ও বিরোধী মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এমডিপি)। ফলে কোনও একক দলের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা কঠিন হবে।
পার্থের ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক ও গবেষণা সহযোগী আজিম জাহির বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন বেশি থাকায়, এটি হয়তো ভবিষ্যদ্বাণী করা সবচেয়ে কঠিন নির্বাচন।”
তিনি আরও বলেন, “বিরোধী দল এমডিপি ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক জয় পেয়েছিল। কারণ তারা বেশ ঐক্যবদ্ধ ছিল। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতাও লাভ করেছিল। তবুও আমি মনে করি, শাসক জোট ও এমডিপি অধিকাংশ আসন পাবে।”
মুইজ্জু গত বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণার মাধ্যমে দেশে ভারতের প্রভাব কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে জয়ী হন। তাকে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের প্রক্সি প্রার্থী হিসেবে দেখা হতো। ইয়ামিন ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ক্ষমতায় ছিলেন। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে তার ১১ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। তবে গত সপ্তাহে আদালত ওই সাজা মওকুফ করেছে।
মুইজ্জু ও ইয়ামিন আগে একই দলে ছিলেন। কিন্তু মুইজ্জু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। ইয়ামিন এখন একটি নতুন দল গঠন করে এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
নির্বাচনের আগে মুইজ্জু ভোটারদের কাছে আবেদন করেছেন যাতে তার জোটকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেওয়া হয়। তিনি অভিযোগ করেছেন, তার পূর্বসূরি মোহাম্মদ ইব্রাহিম সলিহ ভারতকে অনেক বেশি ক্ষমতা দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের ঝুঁকি তৈরি করেছেন। মুইজ্জু বিশ্বাস করেন, তার জোটই দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারে।
গতকাল শনিবার মুইজ্জু বলেন, “যারা দেশকে ভালোবাসেন তারা নিশ্চিত করবেন যে, আগামীকাল তারা যে সিদ্ধান্ত নেবেন তা দেশের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করবে। আগামীকাল আপনি যে ভোট দেবেন তা হতে হবে জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য। দেশকে রক্ষার জন্য।”
মুইজ্জু তার সরকারের ৭৫ জন ভারতীয় সেনা সদস্যকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, এই প্রতিশ্রুতি পূরণে তার দলকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হবে।
মালদ্বীপে থাকা ভারতীয় সেনারা ভারতের উপহার দেওয়া দুইটি বিমান পরিচালনা করে। এছাড়া সমুদ্রে আটকে থাকা বা দুর্যোগের সম্মুখীন মানুষদের উদ্ধারে সহায়তা করে। মুইজ্জু চান এই কাজগুলো স্থানীয়রা করুক।
বিরোধীরা বলছে, নির্বাচনে ভোট দিয়ে জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কি স্বৈরাচারী নাকি গণতান্ত্রিক শাসন চায়।
শনিবার এমডিপির শেষ নির্বাচনী প্রচার সমাবেশে সাবেক রাষ্ট্রপতি সলিহ ভোটারদের সরকারকে জবাবদিহি করতে বিরোধী দলের পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান।
সমর্থকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আগামীকালের ভোট আমাদের কঠোর পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য।”
সলিহের এমডিপি নিয়ন্ত্রিত বর্তমান সংসদ মুইজ্জুর পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে।
ভারতীয় সোশাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিষ্টরা মালদ্বীপে পর্যটন বর্জনের প্রচার শুরুর পর থেকে ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মালদ্বীপের মতো দ্বীপপুঞ্জ লক্ষদ্বীপে পর্যটন বাড়াতে চান। এর বিরোধিতা করে মালদ্বীপের তিন মন্ত্রী মোদীর সমালোচনা করেন। এরপরই প্রতিশোধ হিসেবে ভারত মালদ্বীপে পর্যটন বর্জনের প্রচার চালায়।
মালদ্বীপ সরকারের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, সেখানে ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যা কমেছে।
মুইজ্জু এ বছরের শুরুতে চীন সফর করেন। চীনা পর্যটক ও ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াতে আলোচনা করেন তিনি। সেসময় তিনি চীনের কোম্পানিগুলিকে মালদ্বীপে রাস্তা, ব্রিজ ও অন্য অবকাঠামো নির্মানের কাজ দিয়েছেন চুক্তির মাধ্যমে।
২০১৩ সালে মালদ্বীপ ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগে যোগ দেয়। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো- এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ জুড়ে বাণিজ্য এবং চীনের প্রভাব বাড়াতে বন্দর ও মহাসড়ক নির্মাণ করা।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা।