বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৯৬ সালে হওয়া গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি নবায়ন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফর করেন। এসময় ওই চুক্তি নবায়নের আশ্বাস দেওয়া হয়। এরপরই মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতার অসন্তোষের খবর আসছে ভারতের সংবাদমাধ্যমে।
ইন্ডিয়া টুডে বলছে, গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়টি পার্লামেন্টে তোলার জন্য মমতা ইন্ডিয়া জোটের নেতাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে সম্প্রতি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এসময় তাদের মধ্যে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা এবং গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির নবায়ন নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকের পর নরেন্দ্র মোদী বলেন, “তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলোচনার জন্য অচিরেই ভারত থেকে একটি প্রযুক্তিগত দল বাংলাদেশে যাবে।”
প্রকল্পের অধীনে ভারত তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের জন্য বড় জলাধার এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে একটি চুক্তি করার জন্য দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত প্রস্তাবের মধ্যে এই প্রকল্পের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তিস্তু ও গঙ্গা পানিবণ্টন সংক্রান্ত আলোচনা মমতার জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কারণে যে তিনি দীর্ঘদিন ধরে পানিবণ্টন চুক্তির বিরোধিতা করে আসছেন। পশ্চিমবঙ্গের মাটির ক্ষয়, পলি ও বন্যার জন্য ফারাক্কা ব্যারাজকে দায়ী মনে করেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার তার দলের নেতাদের বলেন, “আমি বাংলাদেশের বিপক্ষে নই। ঢাকার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও ভালো। কিন্তু আমি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। আমাকে বাংলার স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। তিস্তা নদী একটি। আপনি বাংলাদেশে জলাধার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে না জানিয়ে। এটা কি ফেডারেল ঐক্য?”
ইন্ডিয়া টুডে একাধিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মোদীর কাছে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন মমতা।
চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “আমি জানতে পেরেছি, ভারত সরকার ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ ফারাক্কা চুক্তি নবায়নের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে, যার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালে। এটি একটি চুক্তি যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টনের রূপরেখা নির্ধারণ করে।
“আপনি জানেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ওপর এর প্রভাব অনেক। অতীতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কিছু বিষয়ে সহযোগিতা করেছে। তবে পানি অত্যন্ত মূল্যবান এবং মানুষের জীবনধারার প্রাণ। এত সংবেদনশীল বিষয়ে আমরা আপস করতে পারি না।
“মনে হয় বৈঠকে ভারত সরকার বাংলাদেশের তিস্তা নদী পুনরুদ্ধারে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। আমি অবাক হয়েছি যে, জল শক্তি মন্ত্রণালয় ভারতের দিকে নদীটির মূল রূপ ও স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
“এসব কারণের জন্য, বছরের পর বছর ধরে তিস্তায় পানিপ্রবাহ কমে গেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যদি কোনও পানি ভাগ করা হয়, তা উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ মানুষকে তীব্রভাবে প্রভাবিত করবে। তাই তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশের সঙ্গে ভাগ করা সম্ভব নয়।”
তৃণমূল কংগ্রেস বলছে, ফারাক্কা-গঙ্গা চুক্তিতে রাজ্য সরকারও পক্ষ। কিন্তু নবায়নের বিষয়ে রাজ্য সরকারকে কিছুই জানানো হয়নি, যা ঠিক হয়নি।
পাশাপাশি দলটি বলছে, এই চুক্তি বাবদ রাজ্য সরকারের যে পাওনা টাকা, তা বকেয়া রয়েছে। গঙ্গার ড্রেজিংয়ের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এটি বাংলায় বন্যা ও ভাঙনের প্রাথমিক কারণ।
মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ার একাংশে গঙ্গাভাঙন নিয়ে ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদীকে চিঠি দিয়েছিলেন মমতা। সেই চিঠির প্রসঙ্গ তুলে তৃণমূল বলেছে, দুই বছর আগে মমতাও বলেছিলেন, ফরাক্কা ব্যারেজের জন্যই বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকাকে ভাঙনের কবলে পড়তে হচ্ছে। এর ফলে মানুষ ভিটেমাটি হারাচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে চাষাবাদের।
তিস্তার পানি বণ্টন সম্পর্কে তৃণমূল বলছে, ভারতের সংবিধান অনুযায়ী অন্য দেশের সঙ্গে কোনও বিষয়ে চুক্তি করার অধিকার আছে কেন্দ্রের। কিন্তু কেন্দ্রকেও বুঝতে হবে, রাজ্য সরকার সহযোগিতা না করলে তিস্তার পানি বণ্টনের মতো চুক্তি থমকে যায়।
অনেকেই মনে করছেন, রাজ্যকে এড়িয়ে ফারাক্কা চুক্তির নবায়ন করা হলে তিস্তা চুক্তি আরও পিছিয়ে যেতে পারে।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই চুক্তিটি স্থগিত রেখে বলেছিলেন যে, এটি উত্তরবঙ্গে জলের ঘাটতি ঘটাবে।
গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ফারাক্কা চুক্তিটি ২০২৬ সালে শেষ হবে।