আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী রাজ্যের সব হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতি ভেঙে দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শনিবার দুপুরে আর জি কর হাসপাতালে নারী চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় আন্দোলনকারী ডাক্তারদের কাছে গিয়ে এই ঘোষণা দেন তিনি।
আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে গত দিন দিন ধরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। শুক্রবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলতে নবান্নে (সচিবালয়) দুই ঘণ্টা অপেক্ষাও করেছিলেন মমতা।
কিন্তু বৈঠকটি সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে, আন্দোলনকারীদের এমন দাবি মমতা মেনে না নেওয়ায় বৈঠক আর হয়নি।
তবে এতে দমে না গিয়ে শনিবার দুপুরে কলকাতার সল্টলেকে অবস্থিত স্বাস্থ্য ভবনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা আন্দোলনকারীদের কাছেই চলে যান মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে গিয়ে পাঁচ দফার দাবিতে আন্দোলনরতদের সামনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন।
জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান মঞ্চে দাঁড়িয়ে আর জি কর মেডিকেল কলেজসহ রাজ্যের সব হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতি ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন। এসময় তার সঙ্গে ছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার।
আন্দোলনরতদের সামনে দাড়িয়ে হ্যান্ড মাইকে মমতা বলেন, “আমার নিরাপত্তাজনিত নানা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি নিজে ছুটে এসেছি। আপনাদের আন্দোলনকে কুর্নিশ জানাচ্ছি। আমি আপনাদের ব্যথা বুঝি। আমিও ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে এসেছি।”
কলকাতায় গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই বৃষ্টি চলছে। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, নিম্নচাপের কারণে শনিবার সারাদিন বৃষ্টি হবে।
বৃষ্টির কথা উল্লেখ করে মমতা বলেন, “শুক্রবার সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। আপনারা যেভাবে বসে আছেন, আমার কষ্ট হচ্ছে। গত ৩৪ দিন ধরে আমিও রাতের পর রাত ঘুমাইনি। কারণ আপনারা রাস্তায় থাকলে আমাকেও পাহারাদার হয়ে জেগে থাকতে হয়।”
আন্দোলনকারীদের পাঁচ দফা দাবি মেনে নেওয়া প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যদি আপনারা কাজে ফিরতে চান, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনাদের দাবিগুলো সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করব। আমি একা সরকার চালাই না। মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজি সকলের সঙ্গে আমি আপনাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করব।
“যদি কেউ দোষী হন, শাস্তি পাবেন। সিবিআইকে অনুরোধ করব, দ্রুত তদন্ত শেষ করুন। দোষীদের ফাঁসি হোক। কেউ দোষী থাকলে আমি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেব। এটুকু বলতেই আমি এসেছি।”
বক্তব্যে আর জি করের ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দেওয়ার কথাও বলেন মমতা।
তিনি বলেন, “যদি সত্যি কেউ দোষী হয়, তারা শাস্তি পাবে। কেউ আমার বন্ধু বা শত্রু নয়। যাদের আমার বন্ধু বলছেন, আমি তাদের চিনিই না। প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা এসেছেন। আমি সাধ্যমতো পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করব। আপনারা কাজে ফিরুন। আমি আপনাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেব না।
“সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। আপনাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। আমি এখানে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আসিনি। আন্দোলনের সমব্যথী ও আপনাদের বড় দিদি হয়ে এসেছি। আমাকে সময় দিন।”
রোগী কল্যাণ সমিতি কী
রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য ট্রাস্টিরা হাসপাতাল পরিচালনা করেন। এই সমিতিতে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য, স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা থাকেন।
হাসপাতাল পরিচালনায় তহবিলের টাকা কোথায়, কীভাবে খরচ হয়, এসব নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এই সমিতি। আন্দোলনকারীরা এই সমিতির কাজ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। তাদের দাবি, সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়নে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না সমিতি। হাসপাতালের তহবিলের অর্থ লুটপাটের অভিযোগও করেন তারা।
ঘটনার সূত্রপাত
গত ৯ আগস্ট শুক্রবার ভোরে কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মৌমিতা দেবনাথ নামে এক তরুণী শিক্ষানবীশ ডাক্তারের মরদেহ পাওয়া যায়। ওই তরুণী সেখান থেকেই এমবিবিএস পড়ার পর পোস্টগ্র্যাজুয়েট শেষ করে হাসপাতালে যোগ দেন।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে তিনি টানা ৩৬ ঘণ্টার ‘অন-কল’ ডিউটিতে ছিলেন। ডিউটি শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে অনলাইনে আনানো খাবার খেয়ে তিনি চারতলায় পালমোনোলজি বিভাগের সেমিনার হলে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে যান।
পরদিন সকালে সহকর্মীরা ওই হলের ভেতরেই তার অর্ধনগ্ন মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। নিহত তরুণীর গোপনাঙ্গের পাশেই পড়ে ছিল মেয়েদের মাথার চুলের একটি ক্লিপ।
কলকাতার শহরতলীতে সোদপুর এলাকার একটি অতি সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন তিনি।
পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ তাদের প্রথমে জানিয়েছিল তাদের মেয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছে। পরে ময়নাতদন্তে ধরা পড়ে তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।
এই খবর প্রকাশের পর সোমবার কলকাতার রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার চিকিৎসক। তারা এই হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। পাশাপাশি দুর্নীতি নিয়েও অভিযোগ তোলেন তারা।
এক পর্যায়ে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে আর জি কর হাসপাতালের দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। ওই ঘটনা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তথ্যসূত্র : এনডিটিভি।