Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ধর্ষণের সাজায় মমতার নতুন আইন ‘অপরাজিতা’য় কী আছে

আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার পর ফুঁসে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ।
আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার পর ফুঁসে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ।
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইনের প্রস্তাব করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। ভারতের আর কোনও রাজ্যে কিংবা কেন্দ্রেও ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই।

কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এক নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে এই পদক্ষেপ নিল মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখাও এতে সমর্থন দিয়েছে।

গত ৯ আগস্ট কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় মৌমিতা দেবনাথ নামের এক শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে।

ওই ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতার পদত্যাগের দাবিও ওঠে বিক্ষোভ থেকে।

এই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় উত্থাপিত ‘দ্য অপরাজিতা উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড বিল ২০২৪’ পাস করা হয়। এর মধ্য দিয়ে কার্যত ভারতের বিদ্যমান ফৌজদারি অপরাধ আইনে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গই ভারতের প্রথম কোনও রাজ্য, যেখান থেকে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও শিশুদের যৌন নিপীড়নবিরোধী কেন্দ্রীয় আইনে সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া হলো। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের শাস্তি আরও কঠোর করা হয়েছে।

বিলটি অনুমোদনের জন্য রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছে পাঠানো হবে। রাজ্যপালের অনুমোদনের পর বিলটি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলে এটি আইনে পরিণত হবে।

আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক ধর্ষণ-হত্যা চাপ ফেলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর।

বিধানসভায় বিলের ওপর উত্থাপিত আলোচনায় মমতা বলেন, “এই বিল একটি ইতিহাস! প্রধানমন্ত্রী পারেননি। আমরা পারলাম। করে দেখালাম। প্রধানমন্ত্রী দেশের লজ্জা! উনি মেয়েদের রক্ষা করতে পারেননি। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি।”

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “এ বিলের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় আইনে থাকা ফাঁক-ফোকরগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করেছি আমরা। ধর্ষণ হলো মানবতাবিরোধী এক অভিশাপ। এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে সামাজিক সংস্কার প্রয়োজন। দ্রুত তদন্ত, দ্রুত ন্যায়বিচার প্রদান এবং দোষীদের শাস্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে এই বিল আনা হয়েছে।”

বিল পাস করার পর ৩ সেপ্টেম্বর দিনটিকে রাজ্যের নারীদের জন্য ‘ঐতিহাসিক দিন’ বলে উল্লেখ করে মমতা বলেন, “মেয়েদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ৩ সেপ্টেম্বর একটা ঐতিহাসিক দিন। ১৯৮১ সালে এই দিনে মেয়েদের অধিকার সুরক্ষার জন্য জাতিসংঘ চালু করেছিল নারী বৈষম্যবিরোধী কমিটি। এই দিনের সঙ্গে মিলে যাওয়ার জন্য আমি জাতিসংঘকে ধন্যবাদ জানাই।”

কী আছে অপরাজিতা বিলে

বিলটিতে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ২০২৩, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ২০২৩ এর কয়েকটি ধারা এবং যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা আইন ২০১২ সংশোধন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে।

মমতা বলেন, “এই বিল আনার মূল উদ্দেশ্য তিনটি। বর্ধিত শাস্তি, দ্রুত শাস্তি, দ্রুত তদন্ত। নারীদের প্রতি সহিংসতায় কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা আইনে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তা এই আইনে আরও বেশি কঠোর করা হয়েছে।”

ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪ ধারায় ১০ থেকে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। ক্ষেত্র বিশেষে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডও দেওয়া যেতে পারে।

অপরাজিতা বিলে তা সংশোধন করে ধর্ষণের শাস্তি জরিমানাসহ আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড আর অপরাধ গুরুতর হলে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কথা বলা হয়। জরিমানাও ভুক্তভোগীর চিকিৎসা ব্যয় এবং পুনর্বাসনের খরচ মেটাতে ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত হতে হবে।

নির্যাতিতার মৃত্যু হলে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৬ ধারায় শাস্তির কথা বলা আছে ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ক্ষেত্র বিশেষে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড।

অপরাজিতায় সেই শাস্তি আরও কঠোর করা হয়েছে। এতে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যু কিংবা কোমায় চলে যাওয়ার ঘটনায় ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

আরজি করে সহকর্মী ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে চিকিৎসকরা নামে বিক্ষোভে, তাতে যোগ দেয় বিভিন্ন সংগঠন।

দলবদ্ধ ধর্ষণের দায়ে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৭০ ধারায় ২০ বছরের কারাদণ্ডের শাস্তির কথা বলা আছে।

তা সংশোধন করে অপরাজিতায় দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

অপরাজিতায় যৌন সহিংসতার শিকার ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশের শাস্তিও কঠোর করা হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় এ ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত জেলের বিধান থাকলেও অপরাজিতা বিলে তা তিন থেকে পাঁচ বছর করা হয়েছে।

অর্থাৎ, যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তার নাম প্রকাশ, ধর্ষণ মামলায় অনুমতি ছাড়া বিচারপ্রক্রিয়ার বিবরণ প্রকাশ হলে তিন থেকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান করা হয়েছে।

অপরাজিতায় শিশুদের যৌন অপরাধ থেকে সুরক্ষা (পকসো) আইনে নির্ধারিত শিশু নির্যাতনের শাস্তিকেও কঠোর করা হয়েছে।

১৬ বছরের কম বয়সী মেয়েকে ধর্ষণ করলে ন্যূনতম সাজা ২০ বছর কারাদণ্ড কিংবা আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান করা হয়েছে।

১২ বছরের কম বয়সী কাউকে ধর্ষণ করলে ন্যূনতম ২০ বছর কিংবা আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা কিংবা মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে।

আর ১৮ বছরের কম বয়সী নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের সাজা হবে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও জরিমানা অথবা মৃত্যুদণ্ড।

অ্যাসিড হামলার শাস্তিও কঠোর করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় শাস্তি হিসেবে বলা আছে, ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, ক্ষেত্র বিশেষে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা।

অপরাজিতায় বলা হয়েছে, অ্যাসিড হামলায় অপরাধীর আমৃত্যু কারাদণ্ড, ক্ষেত্র বিশেষে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হবে।

শাস্তি কঠোর করার পাশাপাশি যৌন সহিংসতার মামলার শুনানির জন্য বিশেষ আদালত এবং তাদের তদন্তের জন্য টাস্ক ফোর্স গঠনের বিধানও করা হয়েছে।

তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনায় ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় তদন্তের সময় দেওয়া হয়েছে দুই মাস। সেখানে অপরাজিতা বিলে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে ২১ দিন।

ন্যায় সংহিতায় এক বছরের মধ্যে শাস্তি দেওয়ার কথা রয়েছে। অপরাজিতায় তা এক মাসে নামিয়ে আনা হয়েছে।

মমতা বলেন, “এই ধরনের ঘটনায় আমরা অপরাজিতা টাস্কফোর্স গঠন করব। বিশেষ এই দল ২১ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করবে। শিশুদের ওপর ধর্ষণের ঘটনায় তদন্ত শেষ করতে হবে সাত দিনে।”

মামলায় দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য জেলায় জেলায় বিশেষ আদালত গঠনের কথাও উল্লেখ রয়েছে প্রস্তাবিত বিলে।

এরপর কী

বিলটি পশ্চিমবঙ্গের রাজসভায় শাসক দল এবং বিরোধী দল উভয়ের সমর্থনে পাস হলেও এটি কার্যকর হওয়ার জন্য রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতি প্রয়োজন হবে।

রাজ্য বিধানসভা কর্তৃক গৃহীত একটি আইন সংসদ কর্তৃক গৃহীত একটি আইনের বিপরীতে হলেও তা কার্যকর করা যেতে পারে, তবে এতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাগে।

কিন্তু রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের পরামর্শে কাজ করেন এবং এই বিলটি আইনে পরিণত হবে কি না, তা কেন্দ্রই সিদ্ধান্ত নেবে। মমতার তৃণমূল কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর একটি। এ কারণে অপরাজিতা বিলেটির কেন্দ্র থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবির আন্দোলন থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগের দাবিও ওঠে।

এর আগে অন্ধ্র প্রদেশের রাজ্য বিধানসভা এবং মহারাষ্ট্র বিধানসভাও ধর্ষণ ও দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে বিল পাস করেছিল। কিন্তু সেই দুটি বিলও এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির সম্মতি পায়নি।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ভােলাভাবেই জানেন, অপরাজিতা বিল রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা কম এবং এর কঠোর বিধানগুলো দিনের আলো নাও দেখতে পারে।

তাহলে কেন তার দল তৃণমূল কংগ্রেস বিলটিকে বিধানসভায় তুলল?

এর উত্তর ৯ আগস্টের ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় তার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভের মধ্যে রয়েছে।

মমতা রাষ্ট্র পরিচালিত হাসপাতালে জঘন্য অপরাধের জন্য বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সেই অভিযোগের তীর বিজেপির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই তৃণমূল নেতৃত্ব ধর্ষণের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের জন্য কেন্দ্রীয় আইনের দাবি করেছে।

রাজ্য সভায় বিলটি পাসের পর এখন যদি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সেটার অনুমোদন না দেয়, তখন মমতা বিজেপির ওপরও দায় চাপাতে পারবেন।

আরজি কর ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় বিজেপি তার বিরুদ্ধে দোষিদের রক্ষার অভিযোগ তুলেছিল; এখন সেই অভিযোগে বিজেপিকে বিদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করতে পারছেন মমতা।

তথ্যসূত্র : এনডিটিভি

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত