জন্ম তাদের একই এলাকায়, ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ছিলেনও একসঙ্গে, ফলে দুজনের মধ্যে ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। তবে ভারত ভাগের পর দুজনের দেশ হয়ে যায় ভিন্ন; তখন আবার তারা দুই দেশের হয়ে যুদ্ধে লড়ছেন শত্রুজ্ঞানে।
এই দুজন হলেন ইয়াহিয়া খান ও স্যাম মানেকশ। একজন ছিলেন ভারতের সেনাপ্রধান, আরেকজন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হওয়ার পর প্রেসিডেন্টের পদও দখল করেছিলেন।
মানেকশর জীবনকে কেন্দ্র করে গত বছরই ভারতে একটি সিনেমা নির্মিত হয়, নাম তার ‘স্যাম বাহাদুর’। সেই সিনেমায় নতুন করে উঠে আসে তাদের বন্ধুত্বের গল্প।
সেই গল্পের মধ্যে একটি মোটরসাইকেল কীভাবে জড়িয়েছিল, তা তুলে এনেছে ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করার সময় মানেকশর একটি লাল মোটরসাইকেল ছিল। সেটার ওপর নজর ছিল তার বন্ধু ইয়াহিয়ার।
পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর করাচি ফিরে যাওয়ার আগে ইয়াহিয়া বন্ধু মানেকশর মোটরসাইকেলটি কিনতে চান। মানেকশ তখন একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আর ইয়াহিয়া খান ছিলেন মেজর।
২০০৮ সালে মানেকশর মৃত্যুর পর পাকিস্তানি কলামনিস্ট আরদাশির কাওয়াসজি এক কলামে লিখেছিলেন, দেশভাগের আগে ইয়াহিয়া খান মানেকশর লাল মোটরসাইকেলটি ১০০০ রুপিতে কেনার প্রস্তাব দেন। মানেকশও এতে রাজি হয়ে যান।
মানেকশ ও ইয়াহিয়া উভয়েরই জন্মস্থান ছিল পাঞ্জাব প্রদেশে। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর প্রদেশটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। দেশ দুটির সামরিক বাহিনীর বহু নামী-দামি জেনারেলের জন্ম পাঞ্জাবে, যারা পরে বিভিন্ন সময়ে উভয় দেশের সর্বোচ্চ পদেও আসীন হন।
মানেকশকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম ও শেষ ফিল্ড মার্শাল বলা চলে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে অর্জনযোগ্য সর্বোচ্চ পদমর্যাদা ফিল্ড মার্শাল। এটি পাঁচ-তারকা জেনারেলের পদ। ফিল্ড মার্শালের স্থান জেনারেলের উপরে, তবে নিয়মিত সেনা কাঠামোতে পদটি ব্যবহৃত হয় না। এটি মূলত একটি আনুষ্ঠানিক বা যুদ্ধকালীন পদমর্যাদা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাফল্যসহ আরও নানা কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি তাকে এই পদমর্যাদা দেওয়া হয়।
ভারতে কেবল দুজন সেনা কর্মকর্তাকে এই পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অন্যজন হলেন কোদানদেরা মদপ্পা কারিয়াপ্পা। তিনি মানেকশর অনেক আগে থেকেই সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সে হিসেবে তাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম ফিল্ড মার্শাল বলা যায়। কিন্তু কর্মরত অবস্থায় তিনি এই পদমর্যাদা পাননি। ১৯৫৩ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান। তাকে ফিল্ড মার্শাল পদমর্যাদা দেওয়া হয় ৩৩ বছর পরে, ১৯৮৬ সালে।
যাই হোক, ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত ভাগের পর ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে চলে যাওয়ার সময় বন্ধু মানেকশ’র লাল মোটরসাইকেলটিও নিয়ে যান। কিন্তু তিনি সেটির দাম পরিশোধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। মানেকশও আর বন্ধুকে পাওনার কথা মনে করিয়ে দেননি।
এর ২৪ বছর পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই দুই বন্ধুকে পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়। তখন মানেকশ ভারতের সেনাপ্রধান, আর ইয়াহিয়া সেনাপ্রধানের পদ পেরিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।
জেনারেল মানেকশ তার বুদ্ধিদীপ্ত, সেইসঙ্গে রসাত্মক মন্তব্যের জন্য খ্যাত ছিলেন। যুদ্ধজয়ের পর তিনি মজা করা বলেছিলেন, “২৪ বছর ধরে অপেক্ষা করেও আমি ইয়াহিয়ার কাছ থেকে ১০০০ রুপি আদায় করতে পারিনি। কিন্তু অবশেষে সে তার দেশের অর্ধেক দিয়ে আমার ঋণ পরিশোধ করল!”
এদিকে পাকিস্তানি কলামনিস্ট আরদাশির কাওয়াসজি বলেন, জেনারেল মানেকশর সঙ্গে দেখা করার সময় তিনি তাকে বলেছিলেন, ইয়াহিয়া খান তার ঋণের কথা কখনও ভোলেননি। এমনকি সেই ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধ করার কথাও বলেছিলেন ইয়াহিয়া। কিন্তু তা আর কখনও হয়ে উঠেনি।
বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর পদত্যাগ করতে হয়েছিল ইয়াহিয়া খানকে। পরে গৃহবন্দি করা হয় তাকে। ১৯৭৯ সালে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তির এক বছরের মধ্যে তার মৃত্যু হয়।