Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

মণিপুরে নিয়ন্ত্রিতভাবে ফিরেছে ইন্টারনেট সেবা

Manipur
[publishpress_authors_box]

সহিংতায় উত্তাল ভারতের মণিপুর রাজ্যে আংশিকভাবে ফিরেছে ইন্টারনেট সেবা। রাজ্য সরকার ইন্টারনেট সেবার ওপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছে।

ইম্ফলের পাঁচটি জেলায় ইন্টারনেট সেবার ওপর ওই স্থগিতাদেশ আরোপ করা হয়েছিল।

তবে সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভুল তথ্য ও গুজব ছড়ানো ঠেকাতে মোবাইল ইন্টারনেট ডেটার উপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে।

গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেদের সঙ্গে নাগা ও কুকি জাতিগোষ্ঠীর বন্দুকযুদ্ধ, ড্রোন ও রকেট হামলায় অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে মঙ্গলবার থেকে রাজ্যের তিন জেলায় কারফিউ জারি করা হয়। পাশাপাশি ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গোটা রাজ্যের ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

শুক্রবার কারফিউ চতুর্থ দিনে প্রবেশ করলেও ইম্ফল উপত্যকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। সেখানকার মেইতেদের অভিযোগ, নিরাপত্তা বাহিনী তাদেরকে নাগা ও কুকিদের হামলা থেকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না।

বুধবার গভীর রাতে জিরিবাম জেলার বোরোবেকরায় একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পুলিশও জেলায় দুই গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের খবর দিয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার ইম্ফলে সহিংস বিক্ষোভের ঘটনায় সাত কিশোরসহ ৩৩ জনকে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজ্য সরকার অতিরিক্ত সিআরপিএফ ব্যাটালিয়ন দিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করেছে।

কথিত প্রশাসনিক ত্রুটি এবং নতুন করে নাগা ও কুকিদের হামলার অভিযোগে রাজধানী ইম্ফলে বিক্ষোভ শুরু হলে কর্তৃপক্ষ অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে কঠোর হয়।

নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারের বেশি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য রাজ্য সরকার বেসরকারি এবং কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানসহ সব স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে।

ইম্ফলে বুধবার কারফিউয়ের মধ্যে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা গভর্নরের বাসভবন অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে ৫০ শিক্ষার্থী আহত হয়।

শিক্ষার্থী ও নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের পর মণিপুরের গভর্নর লক্ষ্মণ প্রসাদ আচার্য বুধবার ইম্ফল থেকে গুয়াহাটি চলে যান। লক্ষ্মণ প্রসাদ আসামের গভর্নর হলেও অতিরিক্ত হিসেবে মণিপুরের দায়িত্বও পালন করেন।

অন্যদিকে, বুধবার আসাম রাইফেলসের একাধিক ঘাঁটিতে বিক্ষোভ করেন স্থানীয় কুকিরা। মণিপুর থেকে সেনাদের সরে যাওয়ার দাবি তাদের। কয়েক অঞ্চল থেকে বিক্ষোভে সহিংসতার খবরও মিলেছে।

গত বছরের মে মাসে মণিপুর রাজ্যের বড় জাতিগোষ্ঠী মেইতেদেরও ‘শিডিউল ট্রাইব’ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। তার প্রতিবাদ জানাতে গেলেই মেইতেদের সঙ্গে নাগা ও কুকি সংঘাতের শুরু হয়।

ওই ঘোষণার পর মণিপুর রাজ্য সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতে ও রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ইম্ফল উপত্যকার চারদিকে পাহাড়ি এলাকায় বাস করা নাগা ও কুকিদের মধ্যে জাতিগত সংঘাতের সৃষ্টি হয়।

নাগা ও কুকিদের অভিযোগ, অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের মাধ্যমে মূলত তাদের ভূমি থেকে সরানো হচ্ছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে থেমে থেমে চলা এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৩৫ জনের বেশি প্রাণ গেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৫০ হাজার।

মণিপুরের কেন্দ্রে অবস্থিত ইম্ফল উপত্যকা রাজ্যটির প্রায় ১০ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত। মূলত মেইতেরা এই ১০ শতাংশ ভূমিতে বাস করে। তাদের বড় অংশই হিন্দু। তবে মুসলমান ও বৌদ্ধও আছে। মেইতেরা মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ। রাজ্যের বিধানসভায় মেইতেদের ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি।

অন্যদিকে ইম্ফল উপত্যকার আশপাশের পাহাড়ে বাস করে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। পাহাড়ি এলাকার দক্ষিণে বাস করে কুকি ও উত্তর-পূর্বে বাস করে নাগারা।

খ্রিস্টধর্মের অনুসারী কুকি ও নাগারা মণিপুরের ৩৫ লাখ মানুষের প্রায় ৪০ শতাংশ। তারা পাহাড়ে সংরক্ষিত এলাকায় বাস করে। এই পাহাড়ি অঞ্চল মণিপুর ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ।

মণিপুরের ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী, স্থানীয় জেলা পরিষদের অনুমতি ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় বসবাসের অনুমতি ছিল না মেইতেইদের। অন্যদিকে কুকি ও নাগা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উপত্যকা এলাকায় বসবাসের ক্ষেত্রে কোনও বিধি-নিষেধ ছিল না।

কিন্তু বিজেপি সরকার মেইতেদের শিডিউল ট্রাইব বা তফসিলি গোত্র ঘোষণা দেওয়ায় তাদেরও এখন পাহাড়ি বনাঞ্চলে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হতে পারে। আর এ নিয়েই শুরু হয়ে এই জাতিগত সংঘাত।

নতুন করে সহিংসতার নেপথ্যে কী

প্রায় চার মাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার পর গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও সহিংস সংঘর্ষের কারণে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে মণিপুরে।

মণিপুরের প্রথম বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মাইরেমবাম কইরেং সিংয়ের বাড়িতে রকেট হামলার মধ্য দিয়ে এই সহিংসতা শুরু হয়। বলা হচ্ছে, এ সহিংসতা এ বছরে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ।

সেপ্টেম্বরের গোড়া থেকে নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ার আগে গত মাসে দুই দফায় একটা অডিও টেপ ফাঁস হয়। সেখানে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের কথিত এক কথোপকথন ফাঁস হয় বলে দাবি করা হয়। প্রথম দফায় কুকিদের একটি সংগঠন এবং তারপরে একটি জাতীয়-স্তরের ইংরেজি সংবাদ পোর্টাল ওই অডিওটি ফাঁস করে।

ফাঁস হয়ে যাওয়া অডিও কথোপকথনের সূত্র ধরে কুকিরা অভিযোগ করে যে গত বছর থেকে মেইতে ও কুকিদের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলছে, তা আসলে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়েরই মস্তিষ্ক-প্রসূত। তিনিই কুকিদের ওপরে হামলা চালিয়ে ‘এথনিক ক্লিনসিং’ চালাতে শুরু করেন বলে ওই ফাঁস হওয়া অডিও টেপে শোনা গেছে, যা মুখ্যমন্ত্রীর গলা বলেই মনে করছে কুকিরা।

তবে রাজ্য সরকার লিক হয়ে যাওয়া ওই কথেপাকথনের বিষয়ে অত্যন্ত কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল।

তারা বলেছিল, ওই ‘জাল’ অডিও টেপের মাধ্যমে কোনও একটি অংশ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। এই ‘ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে এবং তাতে জড়িত সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে ওই কথোপকথনের পুরোটাই বিচারপতি লাম্বা তদন্ত কমিশনের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত করে দেখার জন্য জমা দেওয়া হয়েছে বলে কুকি সংগঠনগুলি জানিয়েছে। গত বছর মে মাস থেকে মনিপুরে সহিংসতার কারণ খুঁজে দেখছে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ওই তদন্ত কমিশন।

সেপ্টেম্বর মাসের গোড়া থেকে যেসব সহিংসতা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ড্রোন থেকে বোমা হামলার ঘটনা। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে, দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি একধরনের রকেটও ব্যবহার করা হয়েছে।

ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো বলছে, শুধু মনিপুরে নয়, পুরো ভারতেই এই প্রথমবার ড্রোন থেকে বোমা ফেলা হলো।

ধার‌ণা করা হচ্ছে, মিয়ানমারের চিন প্রদেশের কুকি-চিন বিদ্রোহীদের কাছ থেকে এই ড্রোন পেয়েছে মণিপুরের কুকিরা। মিয়ানমারে কুকিরা জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে স্বায়ত্বশাসনের জন্য লড়ছে।

মণিপুরের কুকিরাও রাজ্যের ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার নিয়ে তাদের জন্য আলাদা রাজ্য চাইছেন। এই দাবিতে যুক্ত হয়েছেন রাজ্য মন্ত্রিসভার দুই কুকি সদস্যও।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত