Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

অভয় বাণীতে আতঙ্ক কাটছে না পুলিশ সদস্যদের

সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে ঢাকার মিরপুরে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা। ছবি : হারুন অর রশীদ
সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে ঢাকার মিরপুরে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা। ছবি : হারুন অর রশীদ
[publishpress_authors_box]

দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থানায় আগুন, হামলা, ভাঙচুর ও হত্যাসহ নানা সহিংসতার মধ্যে কর্মস্থল ছেড়ে চলে যান পুলিশ সদস্যরা। অভয় দিলেও এখনও অনেকে কর্মস্থলে ফেরেননি।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। এরপরই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়।

সেদিন বিকালের পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সারাদেশের প্রায় সাড়ে ৪০০ থানা; পুলিশের অস্ত্র, গুলিও লুটপাটেরও খবর পাওয়া যায়।  

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ৬ আগস্ট কর্মবিরতির ঘোষণা আসে পুলিশের সদস্যদের বিভিন্ন সংগঠন থেকে। এরপর থেকেই আর কোনও পুলিশি সেবা পাচ্ছেন না সাধারণ মানুষ।

পাড়া মহল্লায় ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটছে বলে অনেকে বলছেন, তবে অনেকে তা গুজব বলে অভিযোগ করছেন।

পুলিশ কর্মবিরতিতে থাকায় ছাত্র-জনতা মিলে বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে নেমেছে; অনেকে পাড়া মহল্লার নিরাপত্তা রক্ষায়ও পাহারা দিচ্ছেন।

পুলিশ সদস্যরা না থাকায় দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। এমতাবস্থায় কর্মস্থল ত্যাগ করা পুলিশ সদস্যদের কাজে ফিরতে বলা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে দেশের সব পুলিশ সদস্যকে নিজ নিজ পুলিশ লাইনস, দপ্তর, পিওএম ও ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম। বুধবার এই নির্দশনা দেওয়া হয়।

তবে বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে ফিরছেন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যেসব পুলিশ সদস্য কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন, তাদের আসার পথে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, শিক্ষার্থী এবং আপামর জনসাধারণ যাতে পুলিশ সদস্যরা নিরাপদে কর্মস্থলে আসতে পারেন সেজন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করছেন। পুলিশ সদস্যরা কর্মস্থলে আসার পথে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন মর্মে যে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে, সেগুলোর সত্যতা পাওয়া যায়নি। সুতরাং, গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ করা হলো।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আইজিপির এই নির্দেশনা মানা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন পুলিশের অনেক সদস্য। না ফেরার কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, অবকাঠামোগত সমস্যা, কেউবা বলছেন নিরাপত্তার অভাব। সাম্প্রতিক সহিংসতায় পুলিশের ওপর চলা বিভৎসতায় মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন কেউ। কেউ কেউ আবার নিজের বিভাগ থেকে কোনও নির্দেশনা না পাওয়ায় কর্মস্থলে আপাতত যোগ দেবেন না বলে জানিয়েছেন।

কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হামলা চালিয়ে আমার থানা ভবন পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। থানার ৭টি গাড়ি ছিল, সবই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। থানার নথিপত্র সব নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আমাদের কাছে কোনও অস্ত্র নেই, গুলি নেই। সব লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন তো আমি নিজেই নিরাপদ নয়, সেখানে আমি অন্যের নিরাপত্তা দেব কীভাবে?

“পুলিশ বাহিনীতে ২ লাখের বেশি সদস্য আছেন। তারা সবাই যদি গুলি চালাতেন তাহলে তো ৫০ লাখের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৫ শতাধিক মানুষের। এ থেকেই তো বোঝা যায় সব পুলিশ সদস্য দেশের মানুষের ওপর গুলি চালাননি, গুটি কয়েক মানুষ এর জন্য দায়ী। অথচ এখন পুরো বাহিনীই জনরোষের শিকার হচ্ছে। শতাধিক পুলিশ সদস্য বিভৎস বর্বরতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।”

তিনি বলেন, “পুলিশের অল্প সংখ্যক সদস্যই সিনিয়র অফিসারের নির্দেশে কিংবা অতি উৎসাহী হয়ে আন্দোলনকারীদের দিকে গুলি ছুড়েছেন। আর বেশিরভাগ সদস্য গুলি ছুড়েছেন আত্মরক্ষার্থে। যখন আমরা নিজেরা হামলার শিকার হলাম, তখন বাঁচার জন্য বাধ্য হয়ে কিছু গুলি চালাতে হয়েছে।”

কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, “পুলিশ বাহিনীর বর্তমান অবস্থার জন্য গুটিকয়েক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দায়ী। তাদের চিহ্নিত করে জনসম্মুখে হাজির করা হোক, তাদের বিচার করা হোক, তাহলেই আমি কর্মস্থলে যোগ দেব।

“পুলিশের সাধারণ সদস্যদের বিপর্যয়ের মুখে রেখে পালিয়ে গেছেন ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা। হারুন অর রশিদ কিংবা বিপ্লব কুমার সরকারের মতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোথায়, যারা সরকারি দলের  মদদপুষ্ট হয়ে নিজেরা লাভবান হয়েছেন। তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে পুলিশের চাকরিতে আর ফিরে যাব না, প্রয়োজনে অন্য কোনও পেশা বেছে নেব।”

কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, “পুলিশের বেশিরভাগ স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এছাড়া সাধারণ মানুষ এখনও খুব এগ্রেসিভ মুডে আছে। এসবের পরিবর্তন না হলে কর্মস্থলে যোগ দেওয়া সম্ভব নয়।”

আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “বিভাগীয় ভার্চুয়াল গ্রুপগুলোতে একের পর এক নিহত পুলিশ সদস্যের লাশের বিভৎস ছবি-ভিডিও আসছে প্রতিনিয়ত। তাদের মধ্যে কেউ আমার ব্যাচমেট ছিলেন, কারও সঙ্গে একই কর্মস্থলে চাকরি করেছি একসময়। তাদের এমন এসব ছবি দেখে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছি। রাতে ঘুমাতে পারি না এখন। দিন শেষে আমরা পুলিশ সদস্যরাও তো মানুষ। এমন অবস্থায় কর্মস্থলে যোগ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

“আমাদের হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে অনেকে জানাচ্ছেন এখনও পথে পথে পুলিশ সদস্যদের খোঁজা হচ্ছে। শুনেছি গতকালও জামালপুরে রেল পুলিশের এক সদস্যকে পথে আটকে মারধর করা হয়েছে। এমন অবস্থায় আমরা কর্মস্থলে যোগ দেব কীভাবে?’ এ প্রশ্ন আরেক পুলিশ সদস্যের।

তিনি বলেন, “আমাদের অনুপস্থিতিতে এখন অনেকেই পুলিশ সদস্যদের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। কিন্তু যে নির্মমভাবে পুলিশ সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে, সেটা নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। আমাদের ঊর্ধবতন কর্মকর্তারা চুপ, গণমাধ্যমও পুলিশের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে পুরো চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে না। আমার দাবি, পুলিশ সদস্যরা যেভাবে খুন হয়েছে, সেটা প্রকাশ করতে হবে। সব ঘটনায় জড়িতদের বিচার করতে হবে। তাহলে হয়তো পুলিশ সদস্যদের অত্মবিশ্বাস ফিরে আসাবে।”

পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, “এখনও পরিচিতরা সবাই ফোন করে সাবধানে থাকতে কিংবা চলাফেরা করতে বলছেন। তাদের এই সাবধানবাণীতে আমার আতঙ্ক আরও বাড়ছে। জনরোষের ভয়ে আমাদের চোরের মতো পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করছেন। শিশুরাও ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। তাই আমার কাছে এখন আর চাকরি মুখ্য না। এখন নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা আমার কাছে মুখ্য বিষয়। প্রাণে বাঁচলে অন্যকিছু করেও জীবন কাটাতে পারব।”

কর্মস্থলে ফেরার বিষয়ে নবনিযুক্ত আইজিপির নির্দেশের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, “সন্ধ্যায় টিভির পর্দায় হাজির হয়ে কেউ হুট করেই নির্দেশনা দিলেই তো আর সেটা পালন করা সম্ভব নয়। আগে আমাদের নিরাপত্তার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে হবে, তারপর অন্য কিছু।”  

অন্যদিকে নতুন আইজিপির নির্দেশনা মেনে নির্দিষ্ট সময়েই কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন পুলিশের অনেক সদস্য। তাদের মধ্যে এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি পুলিশের চাকরি করি। সেজন্য বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মানা আমার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই আইজিপি মহোদয়ের নির্দেশ মেনে আমি কর্মস্থলে যোগ দিয়েছি।

“আমার অনেক সহকর্মী কর্মস্থলে যোগ না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু আমি সেটা রাখতে পারিনি। তাই আমার নামটা প্রকাশ করবেন না। এতে সহকর্মীদের রোষানলে পড়তে পারি আমি।”

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কতজন সদস্য কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন সে বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনও তথ্য জানাতে পারেননি পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা পুলিশ সুপার ইনামুল হক সাগর।

যারা কর্মস্থলে যোগ দেননি তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে—সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গত জুলাইয়ের শুরুতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়, মাঝে সহিংসতা, সংঘর্ষ, মৃত্যু, কারফিউ, ইন্টারনেট বন্ধ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর হস্তে দমনের মতো ঘটনা ঘটে। এতে আগস্টে এসে সরকার পতনের দাবিতে নামেন ছাত্র-জনতা। এতে উত্তাল হয় দেশ।

এই অচলাবস্থা কাটে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্যে দিয়ে। এরপর সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়। সেদিন রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গেও রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনকারী ছাত্রদের সমন্বয়কদের সঙ্গেও বৈঠক হয়।

এরপর দ্বাদশ সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। অন্তবর্তী সরকার গঠনের প্রস্তুতি শুরু হয়। সিদ্ধান্ত হয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হবেন। সেই সরকার শপথ নেওয়ার কথা বৃহস্পতিবার রাতে।

এই পরিস্থিতে এদিন দুপুরে সেনাসদরে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানের উপস্থিতিতে নবনিযুক্ত পুলিশের আইজিপি, র‌্যাবের মহাপরিচালক ও ডিএমপি কমিশনার সাক্ষাৎ করেন। এসময় আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেনাবাহিনীর সহায়তায় দেশের সব থানার কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা কামনা করা হয়।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, চলমান অরাজকতা, অগ্নি সংযোগ ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বন্ধের মাধ্যমে দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্ত অবস্থান গ্রহণের বিষয়ে বাহিনী প্রধানরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত