পছন্দের প্রার্থীকে ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে ভোট দেওয়ার দৃশ্য বেশ পরিচিত। পৃথিবীর বহু দেশে এই পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হয়। কিছু দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়। ই মেইলে ভোট দেওয়া যায় স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোয়। তবে অদ্ভুত শোনালেও পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ায় এর কোনো পদ্ধতিতেই ভোট হয় না। দেশটির ভোটিং ব্যবস্থা অন্য প্রায় সব দেশের চেয়ে আলাদা।
গাম্বিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা ২৬ লাখের কিছু বেশি। ১৯৬৫ সালে দেশটি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা পায়। স্বাধীনতার পর স্বাভাবিক নিয়মেই সেখানে নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু সমস্যা দেখা যায়, নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে। কারণ, দেশটির অধিকাংশ বাসিন্দা নিরক্ষর হওয়ায় ব্যালটের মতো আধুনিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করা যাচ্ছে না। এই সমস্যা সমাধানেই মূলত একটি ইউনিক ভোটিং ব্যবস্থার সূত্রপাত হয় গাম্বিয়ায়।
নতুন এই পদ্ধতির নাম মারবেল ভোটিং। গাম্বিয়ার ভোটারদের এই পদ্ধতিতে পছন্দের প্রার্থীর নাম বা প্রতীক দেখে ভোট দিতে হয় না। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আদামা ব্যারো ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হন। নির্বাচনে দেশটির নিবন্ধিত ১৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়।
মারবেল পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা
শুরুর দিকে ভোট দেওয়ার জন্য গাম্বিয়ার নির্বাচন কমিশন কাঠ ও মাটির তৈরী মারবেল ব্যবহার করত। এখনে সেখানে ব্যবহার করা হয় স্বচ্ছ কাচের মারবেল।
ভোটের দিন প্রত্যেক ভোটারকে একটি করে মারবেল দেওয়া হয়। চাইলে ভোটাররাও মারবেল নিয়ে যেতে পারেন। ভোটকক্ষে ঢোকার আগে নির্বাচনী কর্মকর্তারা ভোটারের আঙুলে অমোচনীয় কালো কালি লাগিয়ে দেন। এরপর ভোটার ভোটকক্ষে ঢুকে তার পছন্দের প্রার্থীকে ওই মারবেল দিয়ে ভোট দেন।
কিন্তু কীভাবে? কক্ষের ভেতরে প্রার্থীর সংখ্যা অনুসারে বড় লোহার ড্রাম থাকে। সেই ড্রামের মাথায় থাকে সরু একটি নল। প্রার্থীর রাজনৈতিক দলের রং অনুসারে ড্রামটি রাঙানো থাকে। আর ড্রামের গায়ে থাকে প্রার্থীর একটি ছবি।
ভোটাররা তাদের পছন্দের ড্রামের সরু নলের মধ্যে মারবেলটি ফেলে ভোট দেন। তবে, মারবেল ফেললেই কিন্তু ভোট হবে না। সেই মারবেল পড়ার শব্দ নির্বাচনী কর্মকর্তা শুনতে পেলেই ভোটদান সম্পূর্ণ হবে।
কোনও ভোটার যদি ড্রামের মধ্যে একাধিক মারবেল ফেলেন, তাও শুব্দ শুনে ধরে ফেলতে পারেন নির্বাচনী কর্মকর্তা। ফলে এই ভোটিং ব্যবস্থায় জালিয়াতি করার সুযোগ অনেক কম। জাতিসংঘও এই পদ্ধতিকে ইউনিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
মারবেল ড্রামে ফেললে যেন অন্য কোনও শব্দ না হয়, সেজন্য ড্রামটি বন্ধ করার আগে এর তলায় বালু দেওয়া হয়। এছাড়া অন্য শব্দ থেকে ড্রামের শব্দকে আলাদা করতে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রের চারপাশে সবধরনের পরিবহন (বিশেষ করে সাইকেল) নিষিদ্ধ থাকে।
ভোট গণনা
বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণ শেষ হলে কেন্দ্রেই নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সামনে গণনা শুরু হয়। প্রতিটি ড্রাম থেকে মারবেলগুলো বিশেষ ট্রেতে ঢালা হয়। ওই ট্রের মধ্যে মারবেল সাইজ গর্ত করা থাকে। প্রতিটি গর্তে মারবেল পড়ায় গণনা সহজ হয়। গত ৫৮ বছরে এই পদ্ধতিতে ভোট গণনা নিয়ে কখনও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠেনি।
ভোটের পর ড্রাম, ট্রে যত্ন করে সংরক্ষণ করা হয় পরবর্তী নির্বাচনের জন্য। কাগজের ব্যালট পদ্ধতির তুলনায় এটি অনেক সাশ্রয়ী এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য। এমনকি পরিবেশবান্ধবও।
এই পদ্ধতির অসুবিধা
মারবেল ভোটিংয়ে ‘না ভোট’ দেওয়ার কোনও উপায় নেই। যারা না ভোট দিতে চান, তাদের জন্য অতিরিক্ত একটি ড্রাম রাখার প্রস্তাব একাধিকার গাম্বিয়ার নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা।
এর বাইরে আরেকটি অসুবিধা দেখা যায় এই পদ্ধতিতে। অনেক ভোটার ড্রামের মধ্যে মারবেলের বদলে ছোট পাথর খণ্ড ফেলেন। এতে অনেক ভোট বাতিল হয়।
ভোট বাতিল হওয়া রুখতে কাজ করছে গাম্বিয়া পারটিসিপেটস নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। তারা সঠিকভাবে ভোট দেওয়ার নিয়ম নিয়ে একটি ভিডিও করেছে। স্থানীয় উলুফ ভাষায় তৈরী ভিডিওটি ভোটারদের সচেতনতা বাড়াতে প্রচার করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমে।
পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক
২০২০ সালে গাম্বিয়ার নির্বাচন কমিশন মারবেল ভোটিং থেকে সরে আসার চিন্তা করেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, প্রার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ভোটকক্ষে ড্রামের সংখ্যা বাড়াতে হয়। এতে ব্যয় বাড়ে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলে তাদের জন্যও আলাদা ড্রাম ও রং বরাদ্দ করতে হয়। তাই তারা অন্য অনেক দেশের মতো কাগজের ব্যালট ব্যবহার করতে চেয়েছিল।
কিন্তু গাম্বিয়ার ভোটারদের প্রতিবাদের কারণে কাগজের ব্যালট চালু করা যায়নি। তারা মনে করেন, কাগজের ব্যালটে জালিয়াতির সুযোগ বেশি।
মারবেল ভোটিংয়ের ইতিহাস
গাম্বিয়ায় মারবেল ভোটিং পদ্ধতি ৫৮ বছরের পুরনো। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে প্রাচীন গ্রিসে এর প্রচলন ছিল। এই মারবেল ভোটিং ব্যবস্থাকে ‘পেলিন’ বলা হতো। এই ব্যবস্থায় প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য একটি আলাদা পাত্র থাকত। ভোটাররা মারবেল নিয়ে কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে পছন্দের প্রার্থীর পাত্রে মারবেল ফেলতেন।
গ্রিসে তখন ভোট হতো উন্মুক্ত স্থানে। প্রার্থীর পাশে থাকা পাত্রে ভোটাররা মারবেল ফেলতেন। আবার এমনও হয়েছে যে, পাথর, হাড় বা মাটির তৈরি মারবেলগুলো বিভিন্ন রংয়ে রাঙানো হতো। রংগুলো প্রার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করত।
মারবেল ভোটিং পদ্ধতি মধ্যযুগেও ছিল। ইংল্যান্ডে ১৩শ শতাব্দীতে এর ব্যবহার ছিল। আধুনিক যুগে এই পদ্ধতি প্রথমবারের মতো ১৯শ শতাব্দীতে ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে ১৮২১ সালে এই পদ্ধতিতে ভোট হয়েছিল।
গাম্বিয়ার পাশাপাশি আফ্রিকার আরও তিন দেশ- নাইজেরিয়া, ঘানা ও সেনেগালও মারবেল ভোটিং ব্যবস্থা চালু আছে। এসব দেশেও নিরক্ষরতার হার বেশি।
তথ্যসূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস, জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ