উড়োজাহাজ খুব টানতো তাকে। হতে চেয়েছিলেন পাইলট। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় চোখ। দূরের দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতায় কুঁড়িতেই উড়োজাহাজ চালানোর স্বপ্ন ভেস্তে যায়।
তবে পড়ালেখাতেই বড় কিছু হওয়ার দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় এগোতে থাকেন। বাবার চাওয়ায় হিসাববিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার ইচ্ছা তখন। কিন্তু ব্রাজিলের স্ট্রিট ফুটবলের এমন প্রেমে মজলেন যে, পুরো হিসাবই পাল্টে যায়। পায়ের খেলায় নিজেকে এমন উঁচুতে নিয়ে যান, যে জায়গায় উঠতে পারেননি কেউ। স্বপ্ন বদলে ফুটবলের মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া সেই মারিও হোর্হে লোবো জাগালো এখন অন্যলোকে।
মারিও জাগালো। ফুটবলের এক বিস্ময়কর চরিত্র। দৃঢ় মানসিকতা ও জয়ের প্রচণ্ড ক্ষুধায় যিনি ফুটবল ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন। চাওয়া অনুযায়ী জীবন এগোয়নি বলে তিনি নিজেকে দাবি করেন ‘এক্সিডেন্টাল ফুটবলার’ হিসেবে। ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (সিবিএফ) প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জাগালো বলেছিলেন, “আমরা বাবা কখনও চাননি আমি ফুটবলার হই। ওই সময় পেশা হিসেবে এটা সম্মানজনক ছিল না। সামাজিক স্বীকৃতি খুব একটা ছিল না। যে কারণে আমি বলে থাকি, ফুটবল আমার জীবনে এসেছিল দুর্ঘটনাক্রমে।”
ভাগ্যিস ‘দুর্ঘটনা’টা ঘটেছিল। না হলে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে সাফল্যের বৃষ্টিধারা ঝরতো কী করে? কীভাবেই-বা ফুটবল দুনিয়ায় বিস্ময়কর এক খেলোয়াড়-কোচের সাক্ষাৎ মিলতো?
সোনালী সময়ের সোনার মানুষ
ব্রাজিল ফুটবলে হাহাকার হয়ে আছে ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ। ঘরের মাঠের প্রথম বিশ্বকাপে প্রথম শিরোপা জয়ের উৎসব করার অপেক্ষায় ছিলেন লাতিন আমেরিকার দেশটির জনগণ। উরুগুয়ের বিপক্ষে মারাকানার ফাইনাল দেখতে জমায়েত হয় ২ লাখ দর্শক। কিন্তু উৎসবের বদলে কান্নায় ভারি রিও ডি জেনেইরোর স্টেডিয়াম। ওই সময় সেনাসদস্য হিসেবে মারাকানায় ছিলেন জাগালো। দেখেছিলেন, কষ্টের চোরাস্রোত কীভাবে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ব্রাজিলিয়ানদের।
ওই ঘটনার আট বছর পর আক্ষেপ দূর হয় ব্রাজিলের। ১৯৫৮ সালে সুইডেনের মাটিতে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতে ব্রাজিল। গারিঞ্চা-পেলের জাদুতে স্বাগতিকদের হারিয়েই বিশ্বজয়। সেই বিশ্বজয়ী দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন জাগালোও যার ওই বছরই অভিষেক হয় জাতীয় দলে।
সেবার খেলোয়াড় হিসেবে এই লেফট উইঙ্গার জেতেন প্রথম বিশ্বকাপ। চার বছর পর চিলির বিশ্বকাপ অভিযান। সেখানেও উড়ে সেলেসাওদের বিজয় কেতন। টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপজয়ী দলের একজন ছিলেন জাগালো।
ফুটবল বিশ্ব তখন ব্রাজিলময়। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে ‘হ্যাটট্রিক’ করবে সেলেসাওরা? যদিও ইংল্যান্ডের আসরে গ্রুপ পর্ব পেরোনো হয়নি তাদের। এবার ছিলেন না জাগালো, ততদিনে তিনি চলে গেছেন অবসরে।
ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের ব্যর্থতা কাটাতে চার বছর পর মেক্সিকোর টুর্নামেন্টে নামে ব্রাজিল। স্বপ্নের এক দল তাদের। পেলে, জাইরজিনহো, রিভেলিনো ও তোস্তার মতো সব খেলোয়াড়। অনেকের বিচারে ফুটবল ইতিহাসের ‘সেরা দল’। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে তৃতীয় বিশ্বকাপ জয় সেলেসাওদের। সেখানে ছিলেন জাগালো।
অবশ্য খেলোয়াড়ের ভূমিকায় নয়। বুট তুলে রেখেছেন ১৯৬৫ সালে। এরপর কোচিং ক্যারিয়ারে পা রেখে ব্রাজিলের ডাগ আউটেও পৌঁছে যান। টানা দুই বিশ্বকাপ জেতা জাগালোর কাঁধে চাপে ১৯৭০ বিশ্বকাপ দলের দায়িত্ব। তার অধীনেই জুলে রিমে ট্রফি চিরতরে নিজেদের করে নেয় সেলেসাওরা।
এখানেই গড়েন নতুন ইতিহাস। কোচ ও খেলোয়াড়- দুই ভূমিকাতেই বিশ্বকাপ জেতা প্রথম ব্যক্তি মারিও জাগালো।
১৯৭৪ বিশ্বকাপেও কোচের দায়িত্বে ছিলেন জাগালো। এবারই প্রথম ব্রাজিল দলে থেকে খালি হাতে ফেরেন। এরপর থেকে জাতীয় দলের সঙ্গে পাকাপাকি বিচ্ছেদ তার।
সময় পেরিয়ে যায়, বছরে পর বছর চলে যায়, বিশ্বকাপ আর জেতে না ব্রাজিল। অতঃপর ১৯৯৪ সালে, দীর্ঘ ২৪ বছর পর আবারও বিশ্বজয়ের উৎসব মাতে লাতিন আমেরিকার দেশটি। কার্লোস আলবার্তো পাহেইরার অধীনে চতুর্থ বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় সেলেসাওরা। সেখানেও ছিলেন জাগালো!
যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বকাপে আলবার্তো পাহেইরার দলের সমন্বয়ের ভূমিকায় ছিলেন জাগালো। একইসঙ্গে সহকারী কোচের দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। তার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক ও ট্যাকটিকসের ছোঁয়ায় হারানো গৌরব ফেরে ব্রাজিলে।
অর্থাৎ, ব্রাজিলের জেতা প্রথম চার বিশ্বকাপের গৌরবের অংশীদার জাগালো। প্রথম দুটি খেলোয়াড় হিসেবে, পরের দুটি কোচ-সমন্বয়কের ভূমিকায়। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে ফাইনাল হারা ব্রাজিল দলেরও কোচ ছিলেন এই জাগালো।
ফুটবলের শুরুটা কীভাবে
জাগালোর ডাক নাম লোবো। পর্তুগিজ এই শব্দের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় নেড়কে। যে কারণে ব্রাজিলে তাকে ডাকা হয় দ্য উলফ বা ‘বুড়ো নেকড়ে’ নামে। বৈচিত্রময় এই কিংবদন্তির জন্ম ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব উপকূলের মাসেইয়োতে। যদিও তার প্রথম জন্মদিনের আগেই তার পরিবার চলে যায় রিও ডি জেনেইরোতে। সেখানেই ফুটবলের শুরু।
রাস্তায় দেখতেন তার বয়সী অনেক ছেলে ফুটবল খেলছে। শুরুতে এই খেলাটি তার মনে ধরেনি। শুধু দেখতেন। একটা সময় নিজেরও ইচ্ছা হলো। সেই যে স্ট্রিট ফুটবলে মজলেন, আর বেরোতে পারেননি ফুটবল থেকে।
পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফুটবল শুরু। এক সাক্ষাৎকারে জাগালো বলেছিলেন, “আমি পড়লেখা ও ফুটবল একসঙ্গে চালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কারণ তখন স্বপ্ন বড় ছিল না। ধীরে ধীরে এটার প্রেমে পড়ে যাই।”
১০ নম্বরের আক্ষেপ
তার পছন্দে জার্সি নম্বর ছিল ‘১০’। স্ট্রিট ফুটবলে এই নম্বর পরেই খেলতেন। যদিও পেশাদারি ফুটবলে ‘১০’ নম্বর হতে পারেননি। এজন্য তার আক্ষেপও আছে, “ব্রাজিলে ১০ নম্বর পাওয়া খুব কঠিন। কারণ দুর্দান্ত সব খেলোয়াড় আছে এই পজিশনে। যে কারণে আমি লেফট মিডফিল্ডার থেকে লেফট উইঙ্গার হয়ে যাই।” ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় তাই ১১ নম্বর জার্সি পরেই খেলতে হয়েছে তাকে।
বিনয়ী কিন্তু ছাড় নয়
১৯৭৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কোচ ছিলেন তিনি। ইয়োহান ক্রুইফের নেদারল্যান্ডস সেবার বিস্ময়জাগানো দল। ডাচদের বিপক্ষে হেরে যাওয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন জাগালো। ক্লাব ফুটবলে কোচিংয়ের সময়েও মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখতে হয়েছে। তবে সমালোচকদের ব্যাপারে সবসময় তিনি ছিলেন বিনয়ী। এক্ষেত্রে তার একটা উক্তি ছিল, “আপনাকে আমার সহ্য করতেই হবে।”
বিনয়ী হতে পারেন, তবে কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি। পেলের ব্যাপারেই যেমন তার ছিল বজ্র কণ্ঠ। সাক্ষাৎকার দিতে প্রায়ই একটা প্রশ্নের মুখে পড়তেন- পেলের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? উত্তরটাও দিতন নিজের ঢংয়ে, “আমার বয়স যখন ২৭, পেলের তখন ১৭। এ কারণেই আমি সবসময় বলি, আমি কখনও তার সঙ্গে খেলেনি, বরং পেলে আমার সঙ্গে খেলেছে।”
‘১৩’ সংখ্যায় অন্ধবিশ্বাস
খেলার জগতে কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস যুগ যুগ ধরে চলমান। কেউ মাঠে নামেন ডা পা আগে দিয়ে, কেউ বুট বা জুতার লেজ বাঁধেন মাঠে গিয়ে। কেউ আবার চোখবন্ধ করে বের হন ড্রেসিং রুম থেকে। জাগালোর এমন কোনও কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তবে অন্ধবিশ্বাস তারও ছিল। সেটি ’১৩’ সংখ্যায়।
তিনি বিশ্বাস করতেন ‘১৩’ তার জন্য ‘লাকি’ সংখ্যা। বলা হয়ে থাকে, সেন্ত অ্যান্থনির বড় ভক্ত ছিলেন জাগালো। পর্তুগিজ ধর্মযাজক মারা যান ১৩ জুন। এ কারণেই এই সংখ্যায় অন্ধবিশ্বাস তার।
জাগালোর জন্মসাল ১৯৩১। এখানে আছে ‘১’ ও ‘৩’ সংখ্যা। বিয়ে করেছেন মাসের ১৩ তারিখে। একবার এমনকি ঠাট্টা করে বলেছিলেন, তিনি ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই, সময় ১৩:০০!
সংখ্যার এই খেলায় তার জীবনের শেষটাও চাইলে মেলানো যায়। বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী, ৬-১-২৪ তারিখে পৃথিবী ছেড়েছেন জাগালো। তারিখের এই সংখ্যা যোগ করলে (৬+১+২+৪) ‘১৩’-ই তো হয়!