চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি নেই, নেই দামি গয়নার জৌলুস, তারপরেও বিয়েটি ছড়িয়েছে এক অন্যরকম দ্যুতি। যে দ্যুতি শুধু এই যুগল বা তাদের পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, স্পর্শ করেছে অন্য আরও অনেককে।
ইস্টিশন। না, সেখানে গেলে কোনও ট্রেনের দেখা মিলবে না, বরং দেখা হবে বই পড়ুয়াদের সঙ্গে। কক্সবাজারের লাবণী পয়েন্টের খুব কাছে ব্যতিক্রমী এই বইয়ের দোকান। এই ইস্টিশনে বসল বিয়ের আসর, ‘ইস্টিশন মাস্টারের’ বিয়ে বলে কথা!
গত ২৯ জুন সেখানে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারেন ‘ইস্টিশন মাস্টার’ অনুরণন সিফাত ও মোজাহিদুল ইসলাম রাকিব। দুজনেরই ভালোবাসা শিল্প-সাহিত্যের প্রতি, সৃজনশীল চর্চায় দুজনেরই রয়েছে প্রবল আগ্রহ। তাই বিয়ের আয়োজনেও ছিল ব্যতিক্রমী ছোঁয়া।
সমুদ্রের তীরঘেঁষে বসা এই বিয়ের আয়োজনে সবচেয়ে বড় চমক ছিল দেনমোহর। যে সময়ে বিয়েতে দেনমোহরের অঙ্ক কত সংখ্যার, তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা, সেই সময়ে সিফাত আর রাকিব প্রিয়জনদের সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছেন এক লাখ টাকার বই দেনমোহরে। বিয়ের পর এসব বই তারা দিয়ে দেবেন কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরই মধ্যে এসব বই বিতরণ শুরুও করেছেন তারা।
বর-কনে
এবার চিনে নেওয়া যাক, আলোচিত এই বিয়ের বর-কনেকে। সেদিন পুরো ফুলে ফুলে আর স্বল্প কিছু প্রিয়জনের কলরবে সেজেছিল ইস্টিশন প্রাঙ্গণ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুরণন সিফাত চাকরির সুবাদে কক্সবাজারে এসেছিলেন পাঁচ বছর আগে। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক জগতেই তার বেড়ে ওঠা। ছাত্রজীবনেও ছিলেন সৃজনশীল বিকাশ চর্চার মানুষ। তাই কর্মজীবনে এসে ব্যবসায়িক কোনও উদ্দেশ্যে নয়, সৃজনশীলতার বিকাশ, সৃষ্টিশীল মানুষের আনাগোনা বাড়ানো এবং মনের খোরাক মেটাতে গড়ে তোলেন ইস্টিশন।
অন্যদিকে মোজাহিদুল ইসলাম রাকিব একজন সংবাদকর্মী। সাহিত্যের প্রতি তারও প্রবল ভালোবাসা। লেখালেখিও করেন। পড়াশোনা করেছেন প্রকৌশলে, তবে পেশা গড়েছেন সাংবাদিকতায়। বর্তমানে কর্মরত আছেন ঢাকায় দৈনিক আজকের পত্রিকায়।
দেনমোহরে বই কেন
এই যুগলের দুজনেরই আবেগের জায়গা বই। দুজনেই লেখালেখি করেন। দুজনেই চান শিশু–কিশোর ও তরুণেরা বই পড়ুক। সেখান থেকেই এমন সিদ্ধান্ত বলে জানান দুজনে।
সিফাত বলেন, “আসলে বিয়েটা কোনও দেনমোহর ছাড়াই করব ভেবেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম প্রচলিত নিয়মে দেনমোহর একটা কিছু ধরতেই হবে, তখন ভাবলাম, ঠিক আছে আমি নিজের জন্য নিতে চাই না, বরং এই টাকা দিয়ে কিছু স্কুলে লাইব্রেরি হোক।”
সেই ভাবনার সঙ্গে মিলে যায় রাকিবের ভাবনাও। তিনি বলেন, “সিফাতের ভাবনা ছিল তিনটি বা চারটি স্কুলে লাইব্রেরি করার। পরে আমি সেটা বাড়িয়ে ১০টি স্কুলে লাইব্রেরি করার পরিকল্পনা করি। এ কারণেই এক লাখ টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করা।”
সাদামাটা আয়োজন
মেয়ের বিয়ে হয় বাবার বাড়ি থেকে। ইস্টিশনকেই নিজের বাড়ি মনে করেন সিফাত। তাই এখানেই সই হয়েছে বিয়ের কাবিননামা। আগের দিন সমুদ্রের তীরে গায়ে হলুদ হওয়ার পর ইস্টিশনেই দেওয়া হয় মেহেদী। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার পর এই যুগল ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে যান মোটেল শৈবালে। ওখানে বন্ধু মহলের গানের অনুষ্ঠান শেষে সেদিন সন্ধ্যায় ইস্টিশনে আবার বসে মুক্ত আড্ডা।
দুজনের ভাবনায় আরও অনেকক্ষেত্রেই রয়েছে মিল। দুজনেই ভাবেন, বিয়ে একটি সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি। তাই শুধু কাছের অল্প কিছু মানুষকে নিয়েই এই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পরিকল্পনা ছিল দুজনের। সেজন্য আয়োজনও ছিল সাদামাটা।
সিফাত বলেন, “ইদানীং আড়ম্বরের ভিড়ে দুটো মানুষ ভালোবেসে একাত্ম হচ্ছে সেই বিষয়টাই হারিয়ে যায়। আত্মার যোগ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা এই সুন্দর সময়টুকু হারাতে চাইনি। স্নিগ্ধতা থাকুক, সোঁদা মাটির গন্ধ থাকুক, মানুষের ভালোবাসা থাকুক, এটুকুই চাওয়া ছিল। আমরা বরং বিশ্বাস করতে চেয়েছি – ‘তোমার হৃদয় আমার হোক, আমার হৃদয় তোমার হোক’।”
যেখানে যাবে এসব বই
বিয়ের দিনই দুটি স্কুলে লাখ টাকার বইয়ের খানিকটা বই তুলে দিতে চেয়েছিলেন এই জুটি। দূরত্বের কারণে তা হয়ে উঠতে পারেনি। তবে সব বই এসে পৌঁছেছে ইস্টিশনে।
দুজনেই জানান, বই বিতরণে স্কুল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তারা প্রান্তিক এবং সুবিধাবঞ্চিত স্কুলগুলোর কথা ভেবেছেন।
বান্দরবানের লামা এবং আলীকদমের ৩টি পাহাড়ি স্কুল, রংপুরের একটি স্কুল, রাজশাহীর একটি স্কুল নির্বাচন করে হয়েছে। তাদের কাছে বই পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
তাছাড়া ঢাকার একটি পথশিশুদের স্কুল এবং আরও কিছু স্কুল খোঁজা হচ্ছে। প্রতিটি স্কুলে দেওয়া হবে ১০০টিরও বেশি বই আর বই রাখার জন্য একটি তাক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিছু মাধ্যমিক স্কুলেও বই দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সিফাত ও রাকিব।
ভবিষ্যতে চোখ
পরিবর্তনের পথে লড়াইয়ে সঙ্গী পাওয়াটা মুশকিল। সেই লড়াইয়ে দুজনই পেয়েছেন একে অন্যকে। তাছাড়া ভবিষ্যতের যাত্রা মানেই তো অনিশ্চিত। শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার আগে তাই যাত্রাটাকে একটু অর্থবহ করতে চায় এ যুগল।
রাকিব বলেন, “সামনে শুধু ইতিবাচক কাজ করে যেতে চাই। সেটা লেখালেখিও হতে পারে।”
সিফাত বলেন, “কেউ যদি এভাবে স্কুলে লাইব্রেরি করে দিতে চায়, ইস্টিশন তেমন কাজে সহযোগিতা করবে সানন্দে।”