অনেক স্বপ্ন নিয়ে বক্সিং জগতে এসেছিলেন তামান্না হক। সেটা প্রায় এক দশক আগের কথা। তখন দেশে নারী বক্সার ছিল না বললেই চলে। একে তো প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে নারী বক্সার নেই, এর ওপর অনুশীলনের জন্য প্রতিপক্ষ কোনও মেয়েকেও খুঁজে পাওয়া যেত না। বাধ্য হয়েই বক্সার হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দেন তামান্না।
তাই বলে তামান্না হাল ছেড়ে দেননি। ঠিকই মারামারির খেলায় ক্যারিয়ার বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে তামান্না কমব্যাট স্পোর্টসের সঙ্গে জড়িত আছেন। শিখেছেন কারভ মাগার মতো মিলিটারি প্রশিক্ষণ। একাধারে তিনি কিক বক্সিংয়ের ইনস্ট্রাক্টর। ইন্টারন্যাশনাল শাওলিন অ্যান্ড উটাং কুংফু একাডেমি থেকে পেয়েছেন গ্রিন বেল্ট।
তামান্নার এত অর্জন এক দিনে আসেনি। দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম। খেলার পেছনে লেগে থাকা। নির্দয় মারামারির খেলায় নির্মোহ ভালোবাসা। সব মিলিয়েই আজকের অবস্থানে আসা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা সব জায়গাতে অনিরাপদ। স্কুল, কলেজ, অফিস বা রাস্তা ঘাট- প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীদের আত্মরক্ষার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হতে পারে মার্শাল আর্টের খেলাগুলো।
যদিও দেশে কারাতে, তায়কোয়ান্দো, উশু, জুডোসহ নানা রকম মার্শাল আর্টভিত্তিক খেলা রয়েছে। কিন্তু এসব ছেড়ে ইন্টারন্যাশনাল শাওলিন অ্যান্ড উটাং গেমস বেছে নিয়েছেন তামান্না। এছাড়া ব্রিটিশ বাঙালি কারাতে প্রশিক্ষক আলী আকবরের কাছে করেছেন রেপ প্রিভেনশন কোর্স। বর্তমানে রাজধানীর দুটি জিমনেশিয়াম-মেজবান ও টেপআউটের কিক বক্সিং ইনস্ট্রাক্টর তামান্না।
এত খেলা থাকতে কেন মার্শাল আর্টের মতো মারামারি পছন্দ? প্রশ্নটা করতেই হেসে উত্তর দিলেন তামান্না, “মার্শাল আর্ট ছোটবেলা থেকেই ভালো লাগতো। তাছাড়া এই দেশে নারীদের আত্মরক্ষার জায়গা অনেক কম। ভাবলাম নারীদের আত্মরক্ষার জন্য হলেও এসব শেখা দরকার। সেখান থেকেই মারামারির খেলায় আসা।”
ভবিষ্যতে হোয়াইট বেল্ট খেতাব পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তামান্না। আশা আছে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে দেশের জন্য পদক জেতা, “এই বছর আমি গ্রিন বেল্ট পেয়েছি। একদিন হোয়াইট বেল্ট জিততে চাই। নভেম্বর মাসে গ্রিসে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ হবে। সেখান থেকেও বাংলাদেশের জন্য পদক আনতে চাই।”
যদিও এক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন তামান্নার, “এসব টুর্নামেন্টে খেলতে গেলে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। এই দেশে ক্রিকেট আর ফুটবলে বেশি নজর সবার। অজনপ্রিয় খেলাগুলোতে যদি আমাদের মতো খেলোয়াড়দের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় তাহলে আমরাও ভালো কিছু করতে পারবো।”
নিজে মার্শাল আর্ট খেলছেন। আবার পাশাপাশি ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু এখনও দেশে এই পেশায় সেভাবে মেয়েরা আসছে না বলে আক্ষেপ তামান্নার, “বাংলাদেশের মেয়েরা এই পেশায় সেভাবে আসছে না। আমার চোখে এখনও পড়েনি। কিন্তু আরও অনেক মেয়ের এসব পেশায় আসা প্রয়োজন।”
কাজটা বেশ চ্যালেঞ্জিং বলেই জানালেন তিনি, “এটা চ্যালেঞ্জিং জব। আমি একটা খেলা নিয়ে থাকিনি। তাহলে আমার টিকে থাকতে কষ্ট হতো। আমার ক্যারিয়ারও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেত। এজন্য এক সঙ্গে ফিটনেস ইনস্ট্রাক্টর ও সেলফ ডিফেন্স নিয়ে কাজ করছি।”
ব্যক্তিজীবনে কর্মজীবি নারীদের আত্মরক্ষা কত প্রয়োজন তা একদিন টের পেয়েছিলেন তামান্না। সেই গল্পটা তামান্নার মুখেই শুনুন, “একবার রাতে দেরি করে অফিস থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎ রমনা পার্কের সামনে কিছু ছেলে এসে আমার রাস্তা আটকে দেয়। তখন শুধু বক্সিংটাই জানতাম। কিন্তু অনেক ছেলে দেখে লড়াই না করে ফিরে আসি। ভাগ্য ভালো ছিল একটা সিএনজি পেয়ে বাসায় আসতে পেরেছিলাম। না হলে সেদিন বিপদ হতে পারতো।”
নারীদের নিজের প্রয়োজনে আত্মরক্ষামূলক এসব মার্শাল আর্টের খেলা শেখা জরুরী বলে মনে করেন তামান্না, “বাংলাদেশে মেয়েরা সর্বত্র অনিরাপদ। তাদের আত্মরক্ষার কৌশলটা জানা বেশি জরুরী।”
সঙ্গে যোগ করেন, “কোনও দুর্ঘটনা হলেই তখন শুধু এসব নিয়ে আলোচনা হয়। প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু কিভাবে এসবের প্রতিরোধ করতে হয়, কিভাবে মানসিক ও শারীরিক দুর্ঘটনা ঘটলে নিজেকে বের করে আনতে পারি, সেটা নিয়ে কাজ খুব কমই হচ্ছে দেশে। আমি তো আত্মরক্ষা শেখানোর কৌশলের ক্লাসে ছাত্রী পাই না। ওরা শুধু কিক বক্সিং ও বক্সিং শেখে। কিন্তু সচেতনতা বাড়াতে স্কুল, কলেজে এসব নিয়ে সেমিনার, ওয়ার্কশপ করা উচিত।”
সেদিন হয়তো দূরে নয়, যেদিন এ দেশের মেয়েরা প্রতিটি ক্ষেত্রে হবে সচেতন। নিজেরা আত্মরক্ষার কৌশল শিখবে। শুধু খেলার মাঠে নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জয়ী হবে মেয়েরা। সেই স্বপ্নই দেখেন মার্শাল আর্টের অলরাউন্ডার তামান্না।