আনহেল দি মারিয়া যখন মাঠ ছাড়ছিলেন, চোখে জল। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ডরক স্টেডিয়ামের দর্শকেরা করতালি দিয়ে বিদায়ী মহানায়কের অভিবাদন জানাতে ভুল করেনি। যে নায়ক না থাকলে হয়তো ম্যারাডোনা পরবর্তী আর্জেন্টিনার শো কেস আজও খালিই থাকতো। যে নায়ক না থাকলে লিওনেল মেসি হয়তো বিশ্বকাপ না জিতে সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা নিয়েই ক্যারিয়ার শেষ করতেন।
নিজের বিদায়ী ম্যাচটা আর কিভাবেই বা রাঙিয়ে নিতে পারতেন আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার! দি মারিয়া চেয়েছিলেন কোপা আমেরিকার এবারের টুর্নামেন্ট খেলেই জুতো জোড়া তুলে রাখতে। ক্যারিয়ারের দুঃসাহসিক অভিযাত্রার ইতি টানা ম্যাচে কোপার ফাইনালে সতীর্থরা তাকে উপহার দিলেন স্মরণীয় চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। পাশাপাশি নিজেও জিতেছেন টুর্নামেন্টের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার।
সোমবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে কলম্বিয়াকে ১-০ গোলে হারিয়েছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ১১২ মিনিটে একমাত্র গোলটি করেন বদলি নামা লাওতারো মার্তিনেজ। টুর্নামেন্টে ৫ গোল করে গোল্ডেন বুটও জিতলেন ইন্টার মিলান ফরোয়ার্ড।
স্কালোনির তুরুপের তাস মার্তিনেজ
পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই যেন আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনির তুরুপের তাস হয়ে রইলেন মার্তিনেজ। সর্বশেষ কাতার বিশ্বকাপে গোল না পাওয়ার দুঃখটা কি দারুণভাবেই না ঘুচিয়ে দিয়েছেন এবার। গ্রুপ পর্বে কানাডার বিপক্ষে জয়সূচক দ্বিতীয় গোলটি করেন মার্তিনেজ। চিলির বিপক্ষেও যখন গোল পাচ্ছিল না আর্জেন্টিনা, তখন ৮৮ মিনিটে দলকে এনে দেন কাঙ্খিত জয়। এরপর পেরুর সঙ্গে তো জোড়া গোলের জয়ে দুটোই ছিল মার্তিনেজের। কোয়ার্টার ফাইনালে ১-১ গোলে ড্রয়ের ম্যাচেও একমাত্র গোলটি ছিল তারই। পরে টাইব্রেকারে সেমিফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। শুধু সেমিফাইনালেই গোলের দেখা পাননি। কিন্তু ফাইনালে ৯০ মিনিট যখন গোলের জন্য হন্যে হয়ে পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছে হুয়ান আলভারেজ, মেসি, দি মারিয়া, ম্যাক অ্যালিস্টাররা, মার্তিনেজ তখন বেঞ্চে বসে ছটফট করেছেন।
নির্ধারিত ৯০ মিনিট গোলশূন্য। হুয়ান আলভারেজের বদলি হিসেবে ৯৭ মিনিটে স্কালোনি মাঠে নামান তার তুরুপের তাস মার্তিনেজকে। নেমেই কোচের আস্থার প্রতিদান দিলেন। প্রতি আক্রমণ থেকে ১১২ মিনিটে পেলেন কাঙ্খিত গোল। মাঝ মাঠ থেকে একটা বল বাড়িয়ে দেন সতীর্থ জিওভান্নি লে সেলসো। বলটি নিয়েই ত্বরিত বক্সে ঢুকে দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে জড়ালেন জালে (১-০)।
মেসির কান্না এবং বিশ্বকাপের মতো উদযাপন
ম্যাচের ৬৫ মিনিটে চোট পেয়ে মাঠ থেকে উঠে গেলেন মেসি। হতাশায় কেডস জোড়া ছুঁড়ে ফেলে দেন ইন্টার মায়ামি তারকা। এরপর ডাগ আউটে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখনও গোলের দেখা পায়নি আর্জেন্টিনা। সেই হতাশাও হয়তো চেপে বসে মেসির মনে। তার বদলি হিসেবে নামা নিকোলাস গঞ্জালেস যদিও বেশ কয়েকটি সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু কাজে লাগাতে পারেননি।
কিন্তু সেই মেসিকেই ম্যাচ শেষে আনন্দে ভাসিয়েছেন মার্তিনেজ। গোল করেই ছুটে যান মেসির কাছে। এরপর হাসিমুখে জড়িয়ে ধরেন মেসিকে। আর ম্যাচ শেষে বিশাল আকারের কোপার ট্রফিটা নিয়ে ঠিক যেন কাতার বিশ্বকাপের মতো সতীর্থদের সঙ্গে উদযাপন করেন মেসি।
আর্জেন্টিনার রেকর্ড ১৬
কোপায় এর আগে সবচেয়ে বেশি ১৫ বার ট্রফি জয়ের রেকর্ড ছিল উরুগুয়ে ও আর্জেন্টিনার। কলম্বিয়াকে হারিয়ে সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল আলবিসিলেস্তেরা। শুধু তাই নয় কলম্বিয়ার টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ডও থামিয়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনা এই জয়ে।
দর্শকের বিশৃঙ্খলা ও শরীরি ফুটবল
ম্যাচটি আর্জেন্টিনা শুরু করে মানসিকভাবে পিছিয়ে থেকে। অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারের মা, আলেহান্দ্রো গার্নাচোর ভাইসহ একাধিক ফুটবলারের স্বজন আটকে ছিলেন উগ্রপন্থী কলম্বিয়ান সমর্থকদের মাঝে। ম্যাচ শুরুর আগে নিজের মাকে নিরাপদে স্টেডিয়ামের ভেতরে আনতে এক পর্যায়ে লকাররুম ছেড়ে বেরিয়ে আসেন ম্যাক অ্যালিস্টার। ম্যাচটি কলম্বিয়ার দর্শকদের উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে শুরু করতে দেরি হয় প্রায় সোয়া এক ঘন্টা। বিনা টিকিটে দর্শক ঢুকতে চেয়েছিল স্টেডিয়ামে। গেট ভেঙে অনেকে ঢুকেও পড়ে স্টেডিয়ামে। ওই সময় ফুটবলারদের স্বজনেরাও আটকে পড়ে। এমন বিপর্যস্ত আর্জেন্টিনার ওপর চড়াও হতেও সময় নেয়নি কলম্বিয়া।
ফাইনালের প্রথমার্ধে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আর্জেন্টিনাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি সেভাবে। পুরোটা সময় ব্যস্ত থাকতে হয়েছে রক্ষণে। যদিও রোমেরো-লিসান্দ্রো জুটি আর গোলবারের নিচে এমিলিয়ানো মার্তিনেজ বাঁচিয়েছেন আর্জেন্টিনার স্বপ্ন। গোলশূন্য অবস্থায় প্রথমার্ধ শেষ হলেও আলবিসেলেস্তেদের পার করতে হয়েছে কঠিন সময়। এর সঙ্গে পুরো ম্যাচেই যুক্ত হয় কলম্বিয়ার শারীরিক ফুটবল। অতিরিক্ত শরীর নির্ভর ফুটবল খেলার চেষ্টা করে কলম্বিয়া। যে কারণে ম্যাচের স্বাভাবিক ছন্দটাও হারিয়েছে।
পজিশনে এগিয়ে থেকেও পারেনি কলম্বিয়া
পুরো ম্যাচে বল দখলে ৫৬ ভাগ এগিয়ে ছিল কলম্বিয়া। ৪৪ ভাগ আর্জেন্টিনার। গোলে যদিও আর্জেন্টিনা বেশি শট নিয়েছে। ৫বার গোল পোস্টে শট নেয় আর্জেন্টিনা, ৪ বার কলম্বিয়া। পুরো ম্যাচে ২৬টি ফাউল হয়েছে যার ১৮টিই করেছে কলম্বিয়ার ফুটবলাররা।
লড়াইটা ছিল মেসি ও রদ্রিগেজের
দুই দলের ১০ নম্বর জার্সির লড়াইয়ে মেসিকে খুব বেশি এগিয়ে রাখা যাবে না। শুরু থেকেই মেসিকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করতে দেখা গেছে কলম্বিয়ানদের। এক পর্যায়ে তো চোট পেয়ে মাঠই ছাড়লেন। তবে হামেস রাদ্রিগেজ চেষ্টা করেও দলকে জেতাতে পারেননি।
সেরা গোলরক্ষক এমি মার্তিনেজ
গত কোপা দিয়ে যাকে পুরো বিশ্ব চিনেছিল সেই এমি মার্তিনেজ এরপর কাতার বিশ্বকাপে দেখিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার গোলপোস্টের নিচে তিনি কতটা আস্থার প্রতীক। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবারও পুরো কোপা জুড়ে অসাধারণ কিছু সেভ করেছেন। ইকুয়েডরের বিপক্ষে টাইব্রেকারে দুটি দুর্দান্ত সেভ না করলে তো আর্জেন্টিনার সেমিফাইনালে ওঠায় হতো না। এরপর ফাইনালেও দারুণ কিছু সেভ করে জিতে নিলেন সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার।