Beta
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪

মার্কসবাদ ধর্ম ও ইসলাম নিয়ে আলী শরীয়তীর পর্যালোচনা

আলী শরীয়তী মাজিনানি (২৩ নভেম্বর ১৯৩৩ - ১৮ জুন ১৯৭৭)। ছবি:সংগৃহীত।

১.
অনেকেই আলী শরীয়তীকে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ভাবাদর্শিক স্থপতি হিসাবে দেখে থাকেন। একই সঙ্গে তাকে আমূল পরিবর্তনকামী বা বিপ্লবী ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মার্কসবাদ ও অন্যান্য আধুনিক পশ্চিমা মতবাদের তুখোড় পর্যালোচক বুদ্ধিজীবী এবং মার্কসীয় বিপ্লবী চিন্তা-ভাবনা দিয়ে প্রভাবিত একজন লেখক হিসাবেও গণ্য করা হয়।

ইরানের লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণের ভাবাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর সাধনেও শরীয়তীর ভূমিকা নিয়ে খুব কমই মতানৈক্য রয়েছে। বিশেষ করে দেশটির মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তা-ভাবনাকে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক মনোগঠন থেকে বের করে নিজেদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের এবং সর্বোপরি ধর্মের সঙ্গে বৈপ্লবিক লড়াইয়ের যোগসূত্র স্থাপনের তাত্ত্বিক কাঠামোটি তিনিই প্রস্তুত করেন।

শরীয়তী ইরানের জনগোষ্ঠীর মধ্যে পশ্চিমা আধুনিকতার আরোপিত ধ্যানধারণাজাত রাজনৈতিক বিভাজন এবং দূরত্ব নিরসনেও অনন্য ভূমিকা রাখেন। তার প্রচেষ্টার ফলেই মূলত বিপ্লবপূর্ব ইরানের বিভিন্ন ইসলামী ধারার সঙ্গে শহুরে বাম ও জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনৈতিক মৈত্রীর সূচনার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

শরীয়তী মতাদর্শিক বিতর্কের একটি সুস্থ এবং কার্যকর ধারাও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত বিভিন্ন ‘বৈজ্ঞানিক’ ধারণার মাধ্যমে ইসলামের পুনঃব্যাখ্যা করে তার অনুসারীদেরকে একটি সুদৃঢ় ও শক্তিশালী ভাবাদর্শিক অবলম্বন দান করেন, যা পুরনো গোঁড়া ধর্মতাত্ত্বিক মোল্লাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।

তবে ইসলামকে নতুন ব্যাখ্যার বুদ্ধিবৃত্তিক চমৎকারিত্বে শরীয়তীর উপস্থাপনের সঙ্গে তার আমূল পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক অবস্থানের মেলবন্ধন নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন এবং সংশয় রয়েছে। বলা হয়, ইরানের শাহ আমলের দমনপীড়নমূলক দিনগুলোতে তার চিন্তা-ভাবনা শ্রোতাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখতে সফল হলেও বস্তুত মৌলিক পার্থক্যের জায়গায় উপনীত হতে পারেনি। যে কারণে সম্ভবত ধর্মতাত্ত্বিক মোল্লারাই পরে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

আলী শরীয়তীর জন্ম ১৯৩৩ সালে ইরানের উত্তর খোরাসানের একটি গ্রামে এবং সেখানেই তিনি তার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তার মা ছিলেন এক জমিদারের মেয়ে এবং বাবা ছিলেন প্রসিদ্ধ স্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদ ও শিক্ষক, যিনি তার ছাত্রদেরকে বিশ্বের আধুনিক চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

শরীয়তীর বাবা আল্লা-খোদায় বিশ্বাসী ধার্মিক সমাজতন্ত্রীদের একটি ছোট্ট আন্দোলনও গড়ে তুলেছিলেন। শরীয়তী নিজেও যার সদস্য ছিলেন এবং এর মধ্য দিয়েই তিনি তার ইসলামি জ্ঞানের প্রথম সুক্ষ্ম পাঠটি অর্জন করেন।

এরপর মাশাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি ‘আবু জর গিফারি: খোদায়-বিশ্বাসী সমাজতন্ত্রী’ শিরোনামের একটি লেখা অনুবাদ করেন এবং আরবি ও ফরাসি ভাষায় পড়াশোনা চালিয়ে যান। সেসময় তিনি তার বাবার অনুসারীদের নিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ নামের একটি সংগঠনকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালান। সংগঠনটি মূলত ১৯৪০-এর দশকের শেষদিকে জাতীয়তাবাদী মন্ত্রী মোসাদ্দেক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য শরীয়তীকে ৮মাস জেল খাটতে হয়।

এরপর তিনি ফ্রান্সের প্যারিসে চলে যান, যা ছিল সে সময়ের প্রধান ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর একটির রাজধানী। সেখানে তিনি কয়েক বছর অতিবাহিত করেন। প্যারিস গমন তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্বচ্ছতা অর্জন প্রক্রিয়ায় একটি সন্ধিক্ষণ হিসাবে আবির্ভূত হয়। সে সময় বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী তীব্র আন্দোলন-সংগ্রাম চলছিল।

প্যারিসে গিয়ে শরীয়তী সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বের উপর পড়তে শুরু করেন। সেখানে তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্ররাজনীতিতে যোগ দেন এবং ইরানের স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ফার্সি ভাষায় দুটি সাময়িকী সম্পাদনা শুরু করেন। এর পাশাপাশি র‌্যাডিকাল মার্কসবাদী ও প্রাচ্যতাত্ত্বিতকদের লেখালেখি এবং অজগেন, চে গুয়েভারা, জাঁ পল সাঁর্ত্রে, ফ্রানৎজ ফানো ও লুঁই ম্যাসিনো (ইসলামি মরমীবাদের বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ) সহ প্রখ্যাত লেখকদের বিভিন্ন লেখারও অনুবাদ করেন।

একই সময়ে তিনি ‘পশ্চিমা প্রাচ্যবাদ’ ও ‘র‌্যাডিকাল ক্যাথলিকবাদের’ও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ফরাসি সমাজতন্ত্রী যেমন— রেমন্ড অ্যারন, রোজার গারুদি, জর্জ পলিৎজার এবং বিশেষ করে দ্বান্দ্বিকতার প্রখ্যাত ফরাসি পণ্ডিত জর্জ গুর্ভিচের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গেও পরিচিত হন।

শরীয়তী মতাদর্শিক বিতর্কের একটি সুস্থ এবং কার্যকর ধারাও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত বিভিন্ন ‘বৈজ্ঞানিক’ ধারণার মাধ্যমে ইসলামের পুনঃব্যাখ্যা করে তার অনুসারীদেরকে একটি সুদৃঢ় ও শক্তিশালী ভাবাদর্শিক অবলম্বন দান করেন, যা পুরনো গোঁড়া ধর্মতাত্ত্বিক মোল্লাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়।

১৯৬৫ সালে শরীয়তী ইরানে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিদেশে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে ৮ মাসের জন্য জেলে পোরা হয়। ছাড়া পাওয়ার পর পাঁচ বছর তিনি মাশাদের সাহিত্য কলেজে শিক্ষকতা করেন। ওই সময় থেকেই তিনি তেহরানে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, তার রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের সবচেয়ে উদ্ভাবনী ও ফলপ্রসূ সময়কালটি অতিবাহিত করা শুরু করেন।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি উত্তর তেহরানের হুসাইনিয়াহ ইরশাদ নামের একটি আধুনিক ইসলামি কেন্দ্রে ভাষণ দিয়ে যান। তার ভাষণগুলো টেপ-রেকর্ড করে এবং বই আকারে সংকলন করে প্রকাশ করা হতো। এসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ‘ইসলাম শিনাসী’ (ইসলামী তত্ত্ববিদ্যা)। এ সম্পর্কিত তার ভাষণগুলো কয়েকটি খণ্ডে সংকলিত হয় এবং মুসলিম তরুণদের মধ্যে ব্যাপকহারে পঠিত হয়।

১৯৭২ সালে হুসাইনিয়াহ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয় এই অভিযোগে যে, এটি ‘মুজাহিদিন-ই-খালক’ নামের একটি বিপ্লবী মুসলিম গোষ্ঠীর আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে, যারা ইতিমধ্যে শাহের রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছেন।

ইরানি ইতিহাসবিদ ইরভান্দ আব্রাহামিয়ান বলেন, সম্ভবত রক্ষণশীল মোল্লারাও শরীয়তীর ভাষণ বন্ধ করার ক্ষেত্রে প্ররোচনা দেন। কারণ তারা মনে করতেন, শরীয়তী ইসলামের নামে বরং পশ্চিমা দর্শন, বিশেষ করে কার্ল মার্কসের সমাজতত্ত্ব ও বিপ্লবী চিন্তাভাবনারই প্রচারণা চালাচ্ছেন।

হুসাইনিয়াহ কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়ার পর শরীয়তীকে ‘মুজাহিদিন-ই-খালক’ এর সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এবার তাকে ১৮ মাস জেল খাটতে হয়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রখ্যাত দৈনিক কায়হান পত্রিকায় ‘ইনসান, ইসলাম ওয়া মার্কসিজম’ (মানুষ, ইসলাম ও মার্কসবাদ) শিরোনামে তার অনেকগুলো লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯৭৭ সালে তিনি দেশত্যাগ করেন, এবং একমাস পর লন্ডনে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তিনি তার অনুসারীদের কাছে এক মহানায়ক দার্শনিক হয়ে উঠেন।

আলী শরীয়তী। ছবি: সংগৃহীত।

২.
আলী শরীয়তীর ভাবাদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে তেমন কোনও মতভেদ নেই। তবে তার ভাবাদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের প্রকৃতি এবং তার বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।

তার ‘ইসলামি মার্কসবাদ’ এবং কিছু মার্কসবাদী ধারণা যেমন ‘শ্রেণি শোষণ’, ‘শ্রেণিসংগ্রাম’, ‘শ্রেণিহীন সমাজ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ’ প্রভৃতিকে ইমাম আলী, ইমাম হোসাইন এবং আবুজর গিফারি প্রমূখ (যাদেরকে শরীয়তী প্রথম খোদায়-বিশ্বাসী সমাজতান্ত্রিক হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন) ইমামদের দীক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে ব্যবহারের প্রচেষ্টাকে ঘিরে অনেক বিতর্কও রয়েছে।

ইরানের বিপ্লবপূর্ব সংকটময় ও অস্থির দিনগুলোতে এবং বামপন্থী ও ইসলামি দলগুলোর মধ্যে বড় ধরনের বিভাজন থাকার প্রেক্ষিতে শরীয়তীর চিন্তাভাবনাগুলো একদিকে এই দুটি ধারার মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং অন্যদিকে এক গোলমালপাঁকানো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়।

এর মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত শরীয়তীর নতুন লেখা ‘মানুষ, ইসলাম ও মার্কসবাদ’, যেখানে তিনি মার্কসবাদী মূলনীতিগুলোর সঙ্গে ইসলামের জায়গা থেকে দার্শনিকভাবে মোকাবেলা করার চেষ্টা করেন। দশ বছর পর শরীয়তীর সেই লেখাটিই ইংরেজিতে ‘Marxism and Other Western Fallacies’ শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত হয়।

বইটিতে তিনি প্রধানত মার্কসবাদসহ বিদ্যমান মানবতাবাদী দর্শনগুলোর পর্যালোচনা করে ‘মানুষ’ সম্পর্কিত একটি আমূল পরিবর্তনকামী ইসলামী ধারণার প্রস্তাবনা পেশ করেন। পুরো বইটিতে আলী শরীয়তী চারটি প্রধান চিন্তাধারা নিয়ে পর্যালোচনা করেন।

প্রথমত, তিনি দেখান যে, পশ্চিমা দর্শনসমূহ— পশ্চিমা উদারনৈতিকতাবাদ, অস্তিত্ববাদ এবং মার্কসবাদ— একটি কমন বা সাধারণ মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করে। তবে তাদের এই মানবতাবাদের ধারণা বস্তুবাদী এবং এই পশ্চিমা মানবতাবাদ মূলত প্রাচীন গিসের পৌরাণিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছে।

সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ এবং দেবতাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত একটি সংগ্রাম চলতে থাকে, যারা মানুষকে সবসময় অন্ধকার ও মূর্খতার মধ্যে রাখতে চায়। এতে মানুষকে দেবতাদের বিপরীতে একটি উচ্চ আসনে বসানো হয়। ফলে এই মানবতাবাদ মানুষ এবং দেবতাদের মধ্যে বৈরিতার ফলস্বরূপ একটি দূরত্ব তৈরি করে।

আলী শরীয়তী বইটিতে তর্ক তোলেন যে, দিদেরো ও ভলতেয়ার থেকে শুরু করে ফয়েরবাখ ও মার্কস পর্যন্ত সকলেই মূলত প্রতিনিয়ত মানুষের বিরুদ্ধতায় উন্মুখ এই সমস্ত স্বৈরাচারী ও নিষ্ঠুর দেবতাদের ধারণার সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য পরমাত্মিক বা পরমার্থিক তথা রুহানী ইশ্বরের ধারণাকে গুলিয়ে ফেলেন। যেমন— আহুরামাজদা, রাম, তাও, মেসিয়াহ, আল্লাহ প্রভৃতি। এসব ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক মৌলিকভাবেই ভিন্ন— যার মূলে রয়েছে সাহায্য, সৌহার্দ্য, পথপ্রদর্শন এবং পরমার্থিক সত্তার তথা রুহানী গুণাবলি অর্জনে সহায়তা।

পশ্চিমা দার্শনিকরা যেহেতু মানুষ বনাম ইশ্বরের লড়াইয়ের এই গিক বৈপরীত্যমূলক ধারণার ভুলভাবে অতিসরলীকরণ করেন, তাই তাদের মানবতাবাদ হলো দুনিয়াবী, নশ্বর এবং এককথায় বস্তুবাদী। সুতরাং এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, কমিউনিস্টরাও তাদের মানুষ সম্পর্কিত ভাবনায় ইউরোপীয় বুর্জোয়া ধারণা থেকে আলাদা কিছু হাজির করে না বা করতে পারে না। উভয় ধারণার মধ্যেই সবকিছুই মানুষের শুধু জৈবিক সত্তার মধ্যেই গিয়ে শেষ হয়, উভয়েই মানুষের স্পিরিচুয়াল বা পরমার্থিক তথা রুহানী সম্ভাবনার দিগন্তকে বিবেচনার বাইরে রাখে।

অন্য অর্থে পশ্চিমা মানবতাবাদ হলো নাস্তিক্যবাদী, কেননা তা মনে করে, মানুষ স্বভাবগতভাবেই একটি মূল্যবোধগত চেতনা ধারণ করে যা তার মূল্যবোধগুলো নির্ধারণ করে দেয় এবং তা ইশ্বরের বিকল্প হিসাবেও ভূমিকা পালন করে। শরীয়তী বইটিতে আরও বলেন যে, পশ্চিমা দর্শন যা মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে বিভেদ দাঁড় করায় বা মানুষ ও ঈশ্বরকে আলাদা করে দেখে তা প্রাচ্য ধর্মগুলো, যেমন— হিন্দু, ইসলাম বা সুফিবাদ সম্পর্কে অজ্ঞ। এই ধর্মগুলো ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সম্মিলনের ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং এভাবেই তাদের মানবতাবাদ অপার্থিব বা পরমার্থিক বা রুহানী।

দ্বিতীয়ত, আলী শরীয়তী বইটিতে বলেন যে, যদিও আমরা এটা স্বীকার করে নিতে পারি যে, পশ্চিমা মনবতাবাদী এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার ধারাগুলো তাত্ত্বিকভাবে মানুষকে মুক্তকরণের একটি নীতি ধারণ করে, কিন্তু চর্চার ক্ষেত্রে তারা তাদের বাস্তবতার এই রূপটি হারিয়ে ফেলেছে। উদাহরণ হিসাবে মার্কসবাদের কথা বলা যায়, যা পুঁজিতন্ত্রের অমানবিকতা থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল। অথচ বাস্তব চর্চার ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রও মানুষের প্রতি পুঁজিতন্ত্রের মতো একই মনোভঙ্গি লালন করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় জাগতিক সমৃদ্ধির প্রতি আসক্তি, বস্তুবাদিতা, ভোগবাদিতা প্রভৃতি।

অন্যদিকে, ঠিক একইভাবে খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম এবং তাওবাদ প্রভৃতি ধর্মও মানুষকে মুক্তকরণের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে আমলাতান্ত্রিকতা, ক্ষমতা-পিপাসু এবং জাগতিক ভোগ-বিলাস বা যাজকতন্ত্র ও মোল্লাতন্ত্র এবং গণ-যজ্ঞ, লোকাচার ও কুসংস্কারে পর্যবসিত হয়েছে। তেমনিভাবে ইউরোপীয় রেনেসাঁর চৈতন্যও (যা চেতনা, বিজ্ঞান ও বুদ্ধির পুনর্জাগরণ বোঝাতো) পুঁজিতন্ত্র, বিজ্ঞানবাদিতা এবং উদারনৈতিকতাবাদে পর্যবসিত হয়, যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অহংবাদিতা, সুবিধাবাদ এবং ভোগবাদ। কিন্তু রেনেসাঁর চিন্তাধারায় ‘বিশ্বাস, ভাব, ভালোবাসা, জীবনের অর্থ এবং মানুষের প্রতি কোনও মনোযোগ দেওয়া হয়নি’।

তৃতীয়ত, মার্কসবাদ যেহেতু এমন একটি সমন্বিত ভাবাদর্শ যা অর্থনীতি, রাজনীতি, নীতিবিদ্যা, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি নিয়ে কায়কারবার করে, সেহেতু এটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার রূপকল্প বলে দাবিদার ইসলামেরও সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ এবং এটিকে অবশ্যই আগাগোড়া পর্যালোচনা ও চিন্তাগতভাবে মোকাবেলা করতে হবে। এরপর শরীয়তী মার্কসবাদের প্রধান প্রধান দার্শনিক তর্কগুলোকে ইসলামের জায়গা থেকে পর্যালোচনা এবং মোকাবেলার চেষ্টা করেন।

প্রথমেই তিনি বলেন, অন্যান্য পশ্চিমা মানবতাবাদী চিন্তাধারাগুলোর মতোই মার্কসের ধর্মের পর্যালোচনাও গ্রিক মানবতাবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করেই গঠিত, যা মানুষ ঈশ্বরের মধ্যে ঐক্যের চেয়ে বরং বিরোধ ও বিভাজনই দাঁড় করায়। অপরপক্ষে ইসলামে বান্দা ও খোদার সম্পর্ক তাওহীদ বা ঐক্যের ধারণার উপর ভিত্তি করে গঠিত।

শরীয়তী বলেন, মার্কসবাদে ধর্মকে মনে করা হয় যুক্তিবাদিতার ঊর্ধ্বের একটি বিষয়, যা মূলত মানুষের অসহায়ত্বকে নির্দেশ করে। আর মুসলিমরা বিশ্বাস করেন, ইসলামের ধর্মীয় ধারণাগুলো যৌক্তিক, যেমন ভালো কাজের বিনিময়ে বেহেশতে সুখ আর খারাপ কাজের বিনিময়ে দোযখে কঠোর শাস্তিসহ ইসলামের বিভিন্ন ধারণা মানুষকে একটি নৈতিক ও সাধু জীবন যাপনে উদ্ধুদ্ধ করার জন্যই দেওয়া হয়।

প্রথমেই তিনি বলেন, অন্যান্য পশ্চিমা মানবতাবাদী চিন্তাধারাগুলোর মতোই মার্কসের ধর্মের পর্যালোচনাও গ্রিক মানবতাবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করেই গঠিত, যা মানুষ ঈশ্বরের মধ্যে ঐক্যের চেয়ে বরং বিরোধ ও বিভাজনই দাঁড় করায়। অপরপক্ষে ইসলামে বান্দা ও খোদার সম্পর্ক তাওহীদ বা ঐক্যের ধারণার উপর ভিত্তি করে গঠিত।

শরীয়তীর মতে, মার্কস তার তর্ক হাজির করেন ভিত্তিকাঠামো ও উপরিকাঠামোর ধারণার উপর নির্ভর করে, যা মানুষকে উপরিকাঠামোর অংশ হিসাবে বিবেচনা করে এবং তাকে শুধু একটি হাতিয়ার হিসাবেই গণ্য করে এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করেই ধর্ম, নীতিবিদ্যা, নৈতিকতা, মানুষের সদগুণাবলী প্রভৃতির প্রকৃতি নির্ধারিত হয় বলে মনে করে। মার্কসীয় চিন্তায় মানুষের কোনও স্বাধীন কর্তাসত্তা এবং মর্যাদাকর বাস্তবতা নেই। কিন্তু ইসলাম এমন ভাবনা একদমই খারিজ করে দেয়।

একইভাবে বইটিতে শরীয়তী অভিযোগ করেন, মার্কস মানুষকে ইতিহাসের কোনও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা বা কর্তাসত্তার জায়গায় বসান না। তিনি বলেন, মার্কসীয় তত্ত্বে মানুষ যৌক্তিকভাবেই অক্ষম, যেহেতু সে তার চারপাশের পরিস্থিতির উৎপন্ন একটি সত্তা। ফলে ইতিহাসের পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় মানুষের স্বাধীন কোনও ভূমিকা নেই বরং তা উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদন শক্তির দ্বন্দ-সংঘাতের ফল। শরীয়তী বলেন, যদি তাই হয় তাহলে ইতিহাসের এতসব শহীদ, আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বিপ্লবগুলো কি সব নিরর্থক?

শরীয়তীর মতে, মার্কসবাদ নিজেকে পুঁজিতন্ত্রের নির্দয় পর্যালোচনা বলে গর্ব করলেও কার্যত তা পুঁজিতন্ত্রের মতো একই মনোভঙ্গি লালন করে। পুঁজিতন্ত্র এবং সাম্যবাদ দুটি ব্যাবস্থাই বাস্তব চর্চার ক্ষেত্রে ‘উৎপাদনবাদিতা’, ‘প্রয়োগবাদী আমলাতন্ত্র’, ‘অধিকতর অর্জনপ্রবণতা’, ‘অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা’, এবং ‘বস্তুবাদিতা’ প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।

ফলে এখন স্ট্যালিনবাদ বলে যা সমালোচিত হচ্ছে তা মূলত লেলিনবাদ বা খোদ মার্কসবাদেরই ধারাবাহিকতা। তবে সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিতন্ত্রের পার্থক্য শুধু একটা জায়গাতেই— উৎপাদনের উপকরণগুলো পুঁজিতন্ত্রে বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করে আর সমাজতান্ত্রিক সমাজে তা নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র।

চতুর্থত, শরীয়তীর মতে, শুধু ইসলামই প্রকৃত ‘মানবতা’ ধারণ করে। তার মতে, ইসলামে মানবতা হচ্ছে মানুষের মধ্যে পরমার্থিক বা রুহানী মূল্যবোধসমূহের একটি সমষ্টি যা তার নৈতিক এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তোলে। তাওহীদের ধারণার প্রতি নির্দেশ করে শরীয়তী বলেন, ইসলামে মানুষকে জাগতিক ও স্বর্গীয় চৈতন্য, হীন জীব ও খোদায়ী বৈশিষ্ট্য এবং একটির উপর আরেকটিকে বেছে নেওয়ার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন দ্বৈত প্রবণতার অধিকারী সত্তা হিসাবে দেখা হয়।

এরপর শরীয়তী বলেন, প্রথমত, ইসলামে মানুষের মর্যাদা সে মানুষ শুধু এজন্য নয় বরং খোদার সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতেই তার এই মর্যাদা। দ্বিতীয়ত, মানুষের একটি অভীষ্ট গন্তব্য রয়েছে। তৃতীয়ত, মানুষের বিকল্প পছন্দের একটি স্বাধীন ইচ্ছাও রয়েছে। বেছে নেওয়ার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি মানুষের উপর তার নিজেকে হীন জীব থেকে খোদার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একটি দায়িত্বও অর্পণ করে।

শরীয়তীর মতে, এই দায়িত্ববোধ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ধারণা এবং তিনি এর নিহিতার্থকে দর্শন ও ধর্মতাত্ত্বিক জগৎ থেকে রাজনীতির জগতেও সম্প্রসারিত করেন। এর উপর ভিত্তি করেই তিনি তৃতীয় বিশ্বের এবং বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তাদের দাসত্ব-দশা ঘুচিয়ে নিজেদের মুক্তি সাধন ও নিজেদেরকে খোদার প্রতিনিধি বা আল্লাহর খলিফা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার ডাক দেন।

তিনি বলেন, আমাদের নিজেদেরকে মুক্ত করার দায় একই সঙ্গে স্বনির্ভরতার প্রতিও ইঙ্গিত করে; আরও স্পষ্ট করে বললে, এর মানে হচ্ছে সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা। সোজাসাপ্টা রাজনৈতিক ভাষায়— ‘প্রাচ্যও নয় পাশ্চাত্যও নয়’, ‘পুজিতন্ত্রও নয় সমাজতন্ত্রও নয়’ বরং ‘নিজের দিকে ফিরে আসা’, এই বিষয়টিকেই নির্দেশ করে।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলী শরীয়তী। ছবিটি তাঁর কারামুক্তির পরদিন তোলা। ছবি: সংগৃহীত।

৩.
নিঃসন্দেহে আলী শরীয়তী তার লেখাগুলোতে ইসলামের দিক থেকে পশ্চিমা মানবতাবাদী দর্শনসমূহ বিশেষ করে মার্কসবাদের একটি শক্তিশালী পর্যালোচনা হাজির করেছেন। পর্যালোচনাটি পড়লে বোঝা যায় এটি এমন একজন চিন্তকই করেছেন, যিনি একইসঙ্গে তার স্বদেশী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত এবং পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দী ইউরোপীয় মতবাদগুলো সম্পর্কেও সম্যক ওয়াকিবহাল।

তবে শরীয়তীর ‘মার্কসবাদ ও অন্যান্য পশ্চিমা ভ্রান্ত মতবাদ’ পর্যলোচনাটিতে পদ্ধতিগতভাবে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি এবং মার্কসের চিন্তাভাবনার গুরুতর ভুল-বোঝাবুঝি রয়েছে। বইটিতে মার্কসের ব্যাপারে একটি প্রধান তর্ক ছিল মার্কসের ধর্ম ও মানুষ সম্পর্কিত ভাবনা নিয়ে, যা উপরে সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে।

এ ব্যাপারে শরীয়তীর পর্যালোচনায় পদ্ধতিগতভাবে বেশকিছু সমস্যা রয়েছে। যেমন, শরীয়তী বলেছেন, ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের ধারণা হলো বস্তুবাদী। মার্কসের মতে, কোনও সমাজের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বা উৎপাদন সম্পর্ক সেই সমাজের ধর্মীয় ভাবাদর্শ, তার কাঠামো এবং বিকাশ প্রক্রিয়াকেও শেইপ দেয় বা রূপদান করে থাকে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আমরাও দেখতে পাব যে মার্কসের একথা বহুলাংশেই সত্য, যদিও উৎপাদন সম্পর্ক ধর্মীয় ভাবাদর্শকে ডিটারমাইন বা পুরোপুরি নির্ধারণ করে দেয় না। তবে শরীয়তী মার্কসের এই তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা খণ্ডন করে নতুন কোনও দার্শনিক তর্ক ও প্রস্তাবনা হাজির করতে পারেননি।

দ্বিতীয়ত, মার্কস তার ধর্মের পর্যালোচনায় প্রধানত খ্রিস্টবাদের সামাজিক প্রয়োগ বা সামাজিক মূলনীতিগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যেখানে শরীয়তীও একমত হবেন যে, শোষিত-নিপীড়িত শ্রেণির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউরোপের গির্জার রক্ষণশীল ভূমিকা স্পষ্টই ছিল। এটা সত্য যে, ধর্ম বিষয়ে মার্কসের জ্ঞান খ্রিস্টবাদ ও ইহুদিবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং তিনি ইসলাম, হিন্দু ও তাওবাদের মতো প্রাচ্যের ধর্মগুলোর সঙ্গে অতটা পরিচিত ছিলেন না।

তাই বিশ্বের অপরাপর ধর্ম সম্পর্কে মার্কসের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে হয়ত তার একটি ন্যায্য সমালোচনা করা যায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মার্কসের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে অনেকেই ধর্ম সম্পর্কে তার ঐতিহাসিক ধারণাকে সধারণীকরণ করে ফেলেন অর্থাৎ সব ধর্মের ব্যাপারেই তার চিন্তা একই রকম হবে বলে মনে করেন। এ ধরনের সাধারণীকরণ স্পষ্টতই প্রয়োগবাদী বা মার্কসবাদীদের কাজ এবং কোনোভাবেই মার্কসের নিজের কাজ নয়।

ধর্ম ও মানুষ সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার সঙ্গে মোকাবেলা করতে গিয়ে বইটিতে পর্যালোচনাটি মূলত মার্কসের ভিত্তিকাঠামো ও উপরিকাঠামোর ধারণাকে কেন্দ্র করে হাজির করা হয়। কিন্তু দেখা যায় যে, বইটিতে এসব ধারণাকে খুব সরলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

বইটিতে প্রায় একচেটিয়াভাবে মার্কসের একটি ক্ষুদ্র বইকে উদ্ধৃত করা হয়, (Introduction to the Critique of Political Economy) যেটির ভুমিকায় মার্কস তার ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রাথমিক ধারণাগুলো প্রকাশ করেছিলেন মাত্র। তখনো মার্কস এসব বিষয়ে তার পরিণত বোঝাপড়ার বিশ্লেষণ সম্পন্ন করে হাজির করেননি। অথচ প্রাথমিক এই রচনার কয়েকটি লাইনের উপর ভিত্তি করেই মার্কসের পর্যালোচনা হাজির করেন শরীয়তী।

শরীয়তী সম্ভবত এই বিষয়টি বুঝতে ভুল করেছেন যে, ধর্ম, নীতিবিদ্যা, সংস্কৃতি, নৈতিকতাসহ উপরিকাঠামোর সকল উপাদানই উৎপাদনের ধরন ও উৎপাদনের উপায়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি বা ভিত্তিকাঠামো দিয়ে খুব বেশি নির্ধারিত হয় না বরং ভিত্তিকাঠামো উপরিকাঠামোর শর্ত তৈরি করে মাত্র। শরীয়তীর এই ভুল বোঝাবুঝির কারণেই তার কাছে মনে হয়েছে মার্কস ধর্ম, সংস্কৃতি ও মানবতাকে ভিত্তিকাঠামো থেকে উৎপন্ন বা যান্ত্রিকভাবে উদ্ভূত ফলাফল হিসাবে গণ্য করতেন।

ধর্ম ও মানুষ সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণার সঙ্গে মোকাবেলা করতে গিয়ে বইটিতে পর্যালোচনাটি মূলত মার্কসের ভিত্তিকাঠামো ও উপরিকাঠামোর ধারণাকে কেন্দ্র করে হাজির করা হয়। কিন্তু দেখা যায় যে, বইটিতে এসব ধারণাকে খুব সরলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

কিন্তু মার্কস কখনও এরকমটা বলেননি, যেটা তার ‘জার্মান আইডিওলজি’ বইটি মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করলেই বোঝা যায়। আর মার্কসকে সামগ্রিকভাবে পাঠ করলে বোঝা যায়, মার্কস বলেছেন, সমাজের ‘উপরিকাঠামো’ পুরোপুরি তার ‘ভিত্তিকাঠামো’ দিয়ে নির্ধারিত নয় বরং নির্ণীত হয় তথা ভিত্তিকাঠামোই উপরিকাঠামো কেমন হবে তার শর্ত তৈরি করে, তবে পুরোপুরি নির্ধারণ করে দেয় না।

এ ছাড়া এই সম্পর্ক মোটেও একতরফা নয় বরং পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে গঠিত। তার মানে, উপরিকাঠামো তথা ভাবাদর্শ, ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রভৃতিরও ভিত্তিকাঠামোর তথা উৎপাদন ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নানারকম পাল্টা পরিণতি রয়েছে। অর্থাৎ, উপরিকাঠামোও ভিত্তিকাঠামোকে প্রভাবিত করে ও নতুন রূপ দেয়। অবশ্য, এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভিত্তিকাঠামোই বেশি প্রভাবশালী।

মজার ব্যাপার হলো, শরীয়তী নিজেও তার লেখার বিভিন্ন জায়গায় স্বীকার করেছেন, কার্ল মার্কসও ভিত্তিকাঠামোকে নতুন রূপ দানে উপরিকাঠামো তথা ভাবাদর্শ, চৈতন্য এবং মানবীয় নৈতিকতার প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন। আসলে প্রচলিত মার্কসবাদী প্রকল্পের মধ্যে বিষয়টা দেখতে না পেয়েই হয়ত শরীয়তী এই দাবি করে বসেন যে, মার্কস অসঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু তার এই দাবি ভুল।

এই একই কথা মানুষের ভূমিকার সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক কী, সেই বিষয়েও প্রযোজ্য। প্রচলিত মার্কসবাদে অনেক সময় মানুষের ভূমিকাকে এমনভাবে দেখানো হয় যেন তার কোনও স্বাধীন কর্তাসত্তা নেই, তার সব আচরণই যেন ভিত্তিকাঠামো বা উৎপাদন ব্যবস্থা তথা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্বারা উৎপন্ন। মানুষকে এভাবে দেখাটাকে অনেক চিন্তাবিদ ইতরোচিত বস্তুবাদ বলে থাকেন।

বইটিতে মার্কসের পর্যালোচনায় আরেকটি পদ্ধতিগত সমস্যা হলো, মার্কসের চিন্তাভাবনাগুলোকে আগাগোড়াই অন্যান্য মার্কসবাদীদের, যেমন ‘বিদ্যমান সমাজতান্ত্রিক সমাজের’ নেতাদের সঙ্গে এক করে দেখানো হয়েছে। প্রচলিত বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক সমাজকে মার্কসের ভাবনার বাস্তবায়ন হিসাবে গণ্য করে শরীয়তী ভাবনা ও বাস্তব চর্চার ফারাক সম্পূর্ণতই উপেক্ষা করেছেন।

মার্কসের সঙ্গে স্ট্যালিন এবং ক্রুশ্চেভকে গুলিয়ে ফেলে মার্কসবাদের মূর্ত প্রকাশ হিসাবে বিবেচনা করা আর শরীয়তীকে আয়াতুল্লাহ ফাযলুল্লাহ নূরি, আয়াতুল্লাহ কাশানি (বিশ শতকের দুজন বিখ্যাত রক্ষণশীল ধর্মতাত্ত্বিক মোল্লা) এবং আয়াতুল্লাহ খোমেনির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে ইসলামের মূর্ত প্রকাশ হিসাবে বিবেচনা করা একই কথা। যদি একাট্টা ইসলাম বলে কিছু না থাকে তাহলে একাট্টা মার্কসবাদ বলেও কিছু নেই।

তথাপি শরীয়তী বইটিতে তার সমকালের ‘সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর’ যেসব মানবীয় মন্দ দিক সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন, তার অনেকখানি হয়তো বা সত্য। প্রয়োগবাদিতা, আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্য, উৎপাদনবাদিতা সহ মানবীয় সত্তার নানা নিপীড়নমূলক বৈশিষ্ট্য আশ্চর্যজনকভাবে পুঁজিতন্ত্র এবং বিদ্যমান সমাজতন্ত্র উভয়ের মধ্যেই দেখা যায়। তা সত্ত্বেও এটা গুরুত্ব সহকারে বলা দরকার যে, দার্শনিকভাবে আধুনিককালের দুটি ব্যবস্থাকেই একেবারে একইরকম মনে করা অবশ্যই অতি-সরলীকরণ।

পাশাপাশি এটাও অবশ্যই বলা দরকার যে, উপরে মার্কসবাদের পর্যালোচনার যেসব ধরন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো, বিশেষ করে ‘ভিত্তিকাঠামো’ এবং ‘উপরিকাঠামো’র ধারণা সম্পর্কিত তর্ক, সংঘটিত বিপ্লব, ইতিহাসে মানুষের ভূমিকা, ‘মানুষ’ সম্পর্কিত ধারণা, সমাজতান্ত্রিক চর্চা প্রভৃতি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক নতুন কিছু নয়। পশ্চিমা পণ্ডিত সমাজের মার্কসবাদী এবং অমার্কসবাদী উভয় ঘরাণারই বড় বড় পণ্ডিতরা ইতোমধ্যেই মার্কসের সঙ্গে তাদের হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে ফেলেছেন।

তবে আলী শরীয়তীর প্রস্তাবনায় যে জিনিসটি নতুন তা হলো, ইসলামকে মার্কসবাদের বিপরীতে পাল্টা একটি সমন্বিত ধর্মতত্ত্ব, দর্শন এবং একটি বিপ্লবী বুদ্ধিবৃত্তিক-রাজনৈতিক তৎপরতা আকারে হাজির করার চেষ্টা। তিনি মানুষ সম্পর্কে এমন একটি নতুন ইসলামি ধারণার প্রস্তাব হাজির করার চেষ্টা করেছেন, যা শুধু ভিন্ন ধরনের নতুন এক ইসলামি সমাজে দেখা এবং সক্রিয় হওয়া সম্ভব।

ধারণাটি হলো, ইসলামে মানুষের মর্যাদা শুধু সে মানুষ এই জন্যই নয় বরং খোদার সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই তা পরিগঠিত ও স্বীকৃত। শরীয়তী দেখান যে, ইসলামে মানুষ ও খোদার সম্পর্ক তাওহীদ বা একত্ববাদের ওপর ভিত্তি করে গঠিত, যেখানে মানুষকে খোদার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হয় না বরং প্রতিনিধি হিসাবে দেখা হয়। মানুষ সম্পর্কে এই নতুন ও মৌলিক ধারণা এবং ব্যাখ্যাটি সমগ্র বইটিজুড়েই একটি প্রস্তাবনা আকারে হাজির ছিল; কিন্তু গভীরভাবে আলোচিত হয়নি এবং বিশ্লেষিত বা প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। তার একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, বইটি তার ভাষণগুলো থেকে পুনর্লিখিত একটি রচনা।

৪.
তাহলে শরীয়তীর সঙ্গে মার্কসবাদের সংযোগটা কী? তিনি কি প্রকৃতপক্ষে একজন মার্কসবাদী ছিলেন, যিনি নিজেকে ইসলামি ছদ্মাবরণে লুকিয়ে রেখেছিলেন?

নিঃসন্দেহে শরীয়তী কোনও মার্কসবাদী ছিলেন না (যদিও তিনি নিজেকে একজন সমাজতন্ত্রী বলতেন)। তবে এটা নিশ্চিত যে, তিনি মার্কসীয় সামাজিক চিন্তা-ভাবনাগুলো দিয়ে বেশ প্রভাবিত ছিলেন। তিনি মার্কসের কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা গ্রহণ করেছিলেন।

যেমন, ‘শ্রেণি সংগ্রাম’, ‘শ্রেণি শোষণ’, ‘শ্রেণিহীন সমাজ’, ‘ঐতিহাসিক নির্ণয়বাদ’, ‘সম্রাজ্যবাদ’, ‘ভিত্তিকাঠামো’, ‘উপরিকাঠামো’, ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’, এবং ‘স্থায়ী বিপ্লব’ প্রভৃতি ধারণাকে তিনি তার চিন্তা-ভাবনার পর্যালোচনামূলক কাজে পদ্ধতিগতভাবে ব্যবহার করেছেন।

এর প্রমাণ পাওয়া যায় শরীয়তীর ‘জাহাতগিরি-ই তাবাকাত-ই ইসলাম’ (ইসলামের শ্রেণি ঝোঁক) এবং ‘উম্মাহ ও ইমামত’ নামক দুটি লেখায়। এই লেখাগুলোতে তিনি ইসলামের রাজনীতি ও অর্থনীতির পর্যালোচনায় পদ্ধতিগতভাবে উল্লিখিত মার্কসীয় অভিধা-প্রকরণগুলো কাজে লাগিয়েছেন।

তবে একইসঙ্গে, শরীয়তী এসব ধারণার কোনও কোনোটির নতুন অর্থও করেছেন। তার শ্রেণি সম্পর্কিত ধারণা, যা ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকের প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক জর্জ গুর্ভিচের চিন্তা-ভাবনা দিয়ে প্রভাবিত। তার শ্রেণি এমন কোনও অর্থনৈতিক শ্রেণি নয় যা কোনও অর্থনৈতিক স্বার্থের জোটবদ্ধতায় গড়ে ওঠে, বরং তা এমন একটি রাজনৈতিক শ্রেণি, যা গড়ে ওঠে ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রতীক, ঐতিহ্য, এবং সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি প্রভৃতিকে আশ্রয় করে।

আর্থ-সামাজিক শ্রেণি সম্পর্কে এমন একটি নতুন রাজনৈতিক ধারণার পাশাপাশি তিনি আরও বলেন যে, তৃতীয় বিশ্ব বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে সমাজের নেতৃত্ব দেওয়ার এবং বিপ্লবী পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে প্রলেতারিয়েতরা নয় বরং বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকারী শ্রেণি তথা বুদ্ধিজীবি শ্রেণিই প্রধানত সক্ষম শ্রেণী। অর্থাৎ, সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণি নয় বরং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে। কারণ সেই দেশগুলোতে পুরোপুরি শিল্পায়িত সমাজের মতো বিশাল সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণি নেই।

তেমনি ‘ইনতিজার’ বলতে (দ্বাদশ ইমামের পুনরাগমনের জন্য অপেক্ষা) শুধু নিষ্ক্রিয়ভাবে অপেক্ষা নয় বরং ইনসাফের জন্য লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি অপেক্ষা করাকেই বুঝায়। আর তা এমন এক সংগ্রাম যেখানে লক্ষ্য অর্জিত হওয়া একটি নিশ্চিত ব্যাপার

শরীয়তী যেমন বিভিন্ন মার্কসীয় ধারণাকে পুনর্ব্যাখ্যা করে নিজস্ব বয়ানের মধ্যে সংহত করে নিয়েছেন, তেমনি ইসলামের কিছু মৌলিক ধারণারও পুনর্ব্যাখ্যা করেন। তার মতে, বাইবেলের কেইন ও অ্যাবেল (হাবিল ও কাবিল) এর গল্প মুলত শ্রেণি-সংগ্রামেরই একটি প্রতীকায়ন। হাবিল-কাবিলের গল্পের রূপকের মধ্য দিয়ে মূলত শ্রেণি-সংগ্রামকেই তুলে ধরা হয়েছে।

তেমনি ‘ইনতিজার’ বলতে (দ্বাদশ ইমামের পুনরাগমনের জন্য অপেক্ষা) শুধু নিষ্ক্রিয়ভাবে অপেক্ষা নয় বরং ইনসাফের জন্য লড়াই-সংগ্রামের পাশাপাশি অপেক্ষা করাকেই বুঝায়। আর তা এমন এক সংগ্রাম যেখানে লক্ষ্য অর্জিত হওয়া একটি নিশ্চিত ব্যাপার।

শরীয়তীর মতে, ইসলামের শিয়া মতবাদও প্রথমদিকে শোষক-নিপীড়ক ও শোষিত-নিপীড়িতদের মধ্যকার একটি শ্রেণি সংগ্রাম ছিল। আধুনিক ইতিহাসবিদরাও শিয়া মতবাদকে আরব-অনারব দ্বন্দ্বের তথা অনারবদের সঙ্গে আরবদের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখে থাকেন। এরপর ‘সাফাভি শিয়ারা’ আবার শিয়া মতবাদকেই শোষণ-নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করেছিল এবং পরবর্তীরা তথা ‘আলাভি বা রেড শিয়ারা’ একে পুনরায় মুক্তির ভাবাদর্শ হিসাবে হাজির করে।

শরীয়তী বলেন, ইসলাম বা শিয়া মতবাদকে শোষণ-নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত করার জন্য দায়ী মূলত ধর্মতাত্ত্বিকরা তথা মোল্লা শ্রেণি।

এমনকি শরীয়তীর মতে, ধর্মদ্রোহিতা বা কুফরের অভিযোগ, যারা সৃষ্টিকর্তা ও আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করে (যাদের নাস্তিক বলা হয়) তাদের উপর নয় বরং যারা ধর্মের জন্য সুনির্দিষ্ট এবং বাস্তব পদক্ষেপ নিতে অস্বীকার করে তাদের উপরই প্রয়োগ হওয়া উচিৎ। অর্থাৎ, মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও যারা সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অস্বীকৃতি জানায় তারাই প্রকৃত কাফের ও মুরতাদ।

‘কুফর’ সম্পর্কে এমন উপলব্ধির কারণেই শরীয়তী মার্কসবাদীদেরকে রক্ষণশীল মোল্লাদের মতো, তারা দার্শনিকভাবে বস্তুবাদী নাস্তিক, অনৈতিক এবং কুফরকারী বলে খারিজ করে দেননি। তার পরিবর্তে তিনি বরং ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিকদের চিন্তা এবং ফিকাহ শাস্ত্রের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী পর্যালোচনা হাজির করেন।

তিনি ঘোষণা করেন, আমাদের মসজিদ, বিপ্লবী বামরা এবং আমাদের (নিচু তলার) প্রচারকরা মজলুম জনগণের মুক্তির জন্য জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। কিন্তু আমাদের ধর্মতাত্ত্বিক মোল্লারা হলো পুঁজিবাদি এবং রক্ষণশীল। মোদ্দাকথা, আমাদের ধর্মতত্ত্ব পুঁজিতন্ত্রের শোষণ-নিপীড়নের পৃষ্ঠপোষকতা করে।

পরিশিষ্ট:
‘Marxism and Other Western Fallacies’ বইটি, যেখানে মার্কসবাদ নিয়ে শরীয়তীর পর্যালোচনাগুলো সবচেয়ে-বেশি পদ্ধতিগতভাবে হাজির করা হয়েছে, মার্কস ও আলী শরীয়তীর মধ্যে একটি স্পষ্ট তফাতের চিত্র হাজির করে।

শরীয়তীর অবস্থানটা আসলে কী? ‘মার্কসবাদ এবং অন্যান্য পশ্চিমা ভ্রান্ত মতবাদ’ কি মার্কসবাদের প্রতি শরীয়তীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে? আসলে প্রকৃত ঘটনা হলো, এই বইটির বেশির ভাগ লেখারই প্রামাণিকতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

ইরানের মার্কসীয় ঘরানার লেখক আসিফ বায়াত বলেন, ১৯৭৭ সালে ফারসি ভাষায় শরীয়তীর মূল লেখাগুলো তিনি যেভাবে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তার সঙ্গে এই বইটির মূল লেখাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বলার ভঙ্গি ও জোর প্রদানের ক্ষেত্রে ভিন্নতা এবং কিছু বিষয়ের বিলুপ্তি দেখতে পাওয়া যায়।

যেমন, উদাহরণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেন, ফারসি ভাষায় লিখিত মূল রচনাটিতে শরীয়তী সমসাময়িক মার্কসবাদীদের ব্যাপারে, যারা মার্কসের চিন্তা-ভাবনাকে বিকৃত করে ফেলত তাদের ব্যাপারে মার্কসের হতাশার কথা উল্লেখ করে তার বিখ্যাত একটি উক্তি— ‘‘আমি মার্কস, আমি মার্কসবাদী নই’’, এই উক্তিটি দিয়ে তার লেখা সমাপ্ত করেছিলেন।

তথ্যসূত্র:
Shariati and Marx: A Critique of an ‘Islamic’ Critique of Marxism, Assef Bayat, Alif: Journal of comparative poetics, No. 10. pp 19-41, 1990.


লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: [email protected]

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত