১.
ধর্মীয় ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিচারে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণের নামে কিছু বামপন্থীদের মধ্যে একটি মত খুব প্রচলিত, যা কেবলই “ধর্ম কীভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে বিলম্বিত করেছিল অথবা শ্রেণি নিপীড়ন টিকিয়ে রাখার জন্য ভাবাদর্শিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল” এই ধারণার ওপরই আলোকপাত করে, যা একটি গড়পড়তা অতি-সরলীকরণ। কারণ কার্ল মার্কস নিজেও আধুনিকতাপূর্ব মানবসমাজে সভ্যতার একধাপ থেকে অন্যধাপে অগ্রগতির ক্ষেত্রে ধমের্র গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন।
সুতরাং কেবল দুনিয়াবি ভীতিই একটি শ্রেণি সমাজে গণমানুষকে ধর্মপরায়ণ করে তোলে না। বরং ধর্ম হলো সামাজিক সচেতনতার একটি বিশেষ রূপ, অথবা মার্কসের ভাষায় বললে, “সে মানুষের আত্মসচেতনতা, যে হয় নিজেকে এখনও খুঁজে পায়নি নয়তো ইতিমধ্যেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।’’
মার্কস অন্যত্র মন্তব্য করেন যে, ধর্ম অনেক সময় “বাস্তব দুর্দশার অভিপ্রকাশ এবং তার বিরূদ্ধে প্রতিবাদও হয়ে উঠতে পারে।” ধর্ম সম্পর্কে মার্কস কাব্যদীপ্ত ভাষায় তার অসাধারণ সংবেদ ও সুক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টিজাত সারমর্ম ব্যক্ত করেছেন এভাবে, ধর্ম হলো “নিপীড়ত সৃষ্টিজীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, আত্মাহীন অবস্থার আত্মা।” দীর্ঘশ্বাস ছাপিয়ে হৃদয়ের অধিষ্ঠান তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। হৃদয় মানুষের, পরমার্থিকতা উদয়ের।
মার্কস আরও বলেছিলেন, শোষিত-নিপীড়িত মানুষের কাছে ধর্ম হলো আফিমস্বরূপ। আফিম কথাটাকে মার্কস এখানে ব্যাথা বা চেতনানাশক হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তখনকার দিনে চিকিৎসকরা ব্যাথা বা চেতনানাশক হিসাবে আফিম ব্যবহার করতেন।
মার্কস নিপীড়িত, শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম আফিম স্বরূপ বলতে বোঝাতে চেয়েছিলেন, সমাজ থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় দুঃখ, যন্ত্রণা, কষ্ট, অন্যায়, নির্যাতন লাঘবের চেষ্টায় যখন কোনও ব্যাক্তি ব্যর্থ হয়, তখন এক কল্পিত সৃষ্টিকর্তার কাছে সমস্ত অন্যায়ের বিচারের ভার সে অর্পন করে। পরকালে বিচার পাবার আশায় ইহকালের যন্ত্রণা ও ব্যর্থতা ভুলে থাকে।
ধর্মকে আশ্রয় করেই তার সকল যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করে কিংবা ভুলে থাকে। নিজে যখন বদলা নিতে ব্যর্থ হয় তখন সে মনে করে এক দিন না একদিন তার প্রতি এ অন্যায়ের বিচার সৃষ্টিকর্তা করবেন। এভাবে ধর্ম তার জাগতিক বেদনানাশক হিসেবে কাজ করে।
মার্কস-এঙ্গেলস এর প্রত্যয় অনুসারে একটি ধর্ম যে জাতির মধ্যে উদ্ভূত হয়েছে, যে বিশেষ প্রথা-পদ্ধতি এবং আচার অনুষ্ঠান ঘিরে চর্চিত হয় তা থেকে ধর্মটিকে আলাদা করলে, আশ্রিত সাংস্কৃতিক প্রকাশের খোলস ছাড়িয়ে নিলে, ধর্মটির একটি বৈশ্বিক রূপ ধরা পড়বে। ভাবাদর্শিক পর্যায়ে একটি বিশ্বধর্ম যে সমাজিক গড়নের মধ্যে উদ্ভূত হয়েছে তা-থেকেও ধর্মটি উল্লেখযোগ্য স্বাধীন সক্রিয়তাও ভোগ করে।
শুধু তাই নয়, সমাজের একটি উপাদান হিসাবে বিরাজ করা সত্ত্বেও ঐ সমাজের আর্থ-সামাজিক সম্পর্কগুলোর চূড়ান্ত রূপান্তরের ক্ষেত্রে ধর্ম একটি ম্যাটারিয়াল ফোর্স বা বৈষয়িক-শক্তি হিসাবেও ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে যেকোনও চিন্তা বা আদর্শ মানুষের মন জয় করে দুনিয়াকে বদলানোর একটি বস্তুগত বা বৈষয়িক তথা বাস্তব জাগতিক পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠতে পারার যে ধারণা মার্কস পোষণ করতেন তা স্মরণ করা যেতে পারে। হেগেলের অধিকার দর্শন পর্যালোচনার ভূমিকায় এই আলোচনা তিনি করেছেন।
ধর্মকে আইনী, রাজনৈতিক এবং ভাবাদর্শিক চরিত্রের অন্যান্য সামাজিক সম্পর্কের মতোই কেবল উপরিকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে দ্বিবিভাগ করা এবং সেই বিভাজনজনিত পৃথকীকরণের বরাতে উৎপাদন সম্পর্কগুলোর অন্তর্গত কোনও বিষয় হিসাবে না দেখাটা স্পষ্টতই ভ্রান্তিমূলক এবং মার্কসীয় পদ্ধতির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
মার্কসীয় কাঠামোর মধ্যে কোনও বিশ্বজনীন ধর্মকে ইতিহাসের কোনও উত্তুঙ্গ যুগসন্ধিক্ষণে সামনে চলে আসা দুনিয়াতীত ধ্যান-ধারণা, আবেগানুভুতি ও ভাব প্রকাশের একটি পদ্ধতি বলেও সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। তবে ধর্মের ধ্যান-ধারণা এবং চিন্তা-ভাবনাগুলো পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন ধরনের বিকাশের প্রতিক্রিয়ায় প্রতিনিয়তই সারবত্তা এবং গঠন উভয় দিক দিয়েই পরিবর্তিত হয়ে চলেছে।
ধর্মের এই পরিবর্তনও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে ঘটে চলা আমূল রূপান্তরের ফলে উদ্ভূত নতুন সামাজিক নীতিমালার সঙ্গে শুধু পুনরায় খাপ খাওয়ানোর দিকেই ঝোকে না, বরং তাদের রূপ রূপান্তরেও অংশগ্রহণ করে। যেমন এঙ্গেলস বিশ্বজনীন ধর্মগুলোর উত্থানকে, বিশেষত ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মের বেলায়, ধর্মীয় আবরণে একটি ঐতিহাসিক লড়াই সংগ্রামের অভিব্যক্তি বলেই ব্যাখ্যা করতে বেশি পছন্দ করতেন।
এ ব্যাপারটা আরও স্পষ্টরূপে দেখা যায় এশীয় সমাজগুলোর ইতিহাসে। একারণেই মার্কস প্রশ্ন তুলেছিলেন “প্রাচ্যের ইতিহাস বারবারই ধর্মের ইতিহাস হিসাবে হাজির হয় কেন?” এই প্রশ্ন তুলে মার্কস মূলত বিভিন্ন ধর্মের নিজস্ব সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত সামাজিক ভূমিকার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
উপরোক্ত তাত্ত্বিক ছকটি ইসলামকে বুঝার ক্ষেত্রে খুবই দরকারি। আর মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামের মতো একটি বিশ্বজনীন ধর্মের ঐতিহাসিক বিচার করতে গেলে এটি যে সভ্যতার জন্ম দিয়েছে তারও একটি বিচার অবশ্যই করতে হবে। উল্লেখ্য, এঙ্গেলস খ্রিস্টধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে ইসলামকেও বিশ্বজনীন ধর্ম মনে করতেন।
২.
ইসলামের ইতিহাস এবং ইসলামি সভ্যতার চরিত্র নিয়ে ইতিমধ্যেই এমন প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, যেগুলোতে মার্কসীয় তত্ত্ব থেকে জারিত ও প্রচারিত বিভিন্ন ধারণা এবং প্রকরণ ব্যবহার করে বিভিন্নজন বিভিন্ন মতামতে উপনীত হয়েছেন। যেমন, A Short History of the World এর সোভিয়েত ঐতিহাসিকগণ ইসলাম যে সামাজিক বিন্যাসের মধ্যে আবির্ভূত হয়েছিল— “আরব উপদ্বীপে সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্কের উত্থান”, তাকেই ইসলামের কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচনা করেছেন।
তারা ইসলামের প্রসারের মধ্য দিয়ে আরবদের একত্রীকরণ এবং “যাযাবর ও স্থায়ী বাসিন্দা উভয়েরই সামন্তীয়করণ”কে একই প্রক্রিয়ার এপিঠ-ওপিঠ হিসাবে দেখে থাকেন। কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গিতে দূরপাল্লার-বাণিজ্য পেশার ভেতর দিয়ে জন্ম নেওয়া মক্কার বণিক সম্প্রদায়ের নিয়ামক চরিত্রটিকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া তা স্পষ্টতই ৭ম শতকের আরবীয় সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয় নি।
আর তাছাড়া এই মতটি মার্কস ও এঙ্গেলসের শুধু ছড়ানো ছিটানো কয়েকটি মন্তব্যকে পর্যালোচনাহীনভাবে নিয়ে গঠিত হয়। মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের এসব মন্তব্যে অনেক সময় ইসলামি সভ্যতা প্রসারকালে এর অওতাধীন অঞ্চলগুলোতে সামন্ততান্ত্রিকতার পথ-যোগানোর প্রতি ইসলামের অন্তস্থিত প্রবণতার দিকে ইংগিত করেছিলেন মাত্র।
এই সংকীর্ণ মতের বিপরীতে মন্টেগোমারি ওয়াট এবং ম্যাক্সিম রুডিনসন-এর মতো প্রাচ্যতাত্ত্বিকরা খাঁটি তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে এবং মার্কসীয় ধারণাগুলোকে একটু উদারভাবে প্রয়োগ করে তাদের মতামত হাজির করেন। এই ইদিহাসবেত্তারা ইসলামকে ৭ম শতকে মক্কার উচ্চ বাণিজ্যিকীকৃত সামাজিক পরিস্থিতি থেকে উৎপন্ন ভাবাদর্শ হিসাবে দেখে থাকেন। তারা ইসলামকে আরবের বেদুইন গোত্রগুলোর নৈরাজ্যকর বর্বরতার বিরুদ্ধে মক্কা-মদীনার স্থায়ী বাসিন্দাদের একটি ভাবাদর্শিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে ব্যাখ্যা করেন।
এই ব্যাখ্যানুযায়ী মক্কা-মদীনায় মুসলিম ক্ষমতার প্রতিষ্ঠালাভ এবং পর্যায়ক্রমে সকল আরবগোত্রের তা গ্রহণ করাকে গোত্রীয় বিচ্ছিন্নতাবাদের ফলে সমগ্র আরব সমাজ বৈষয়িক সংস্কৃতির যে নিচু স্তরে স্থবির হয়ে ছিল, তার বিরুদ্ধে সভ্যতার উচু স্তরে উন্নীতকরণ প্রয়াসী একটি শহুরে মতবাদের বিজয় হিসাবে চিত্রায়িত করা যায়। আর এটা স্পষ্টতই শুধু মক্কার বড় বড় ধনকুবেরদেরকে দমনের মধ্য দিয়েই সম্ভব ছিল, যারা বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোচ্চুরি, বিশেষ করে আরবের মধ্য দিয়ে পরিচালিত বহির্বাণিজ্যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মাধ্যমে মাঝারি-পর্যায়ের এবং কম বিত্তবান বণিকদের শোষণ করত।
ইসলামি ঘরানা থেকে আসা মার্কসবাদী এবং কিছু র্যাডিকাল উদারপন্থীর লেখায়ও কমবেশি এরকম একটি ব্যাখ্যা দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে মোহাম্মদ হাবিব, আলি মোহাম্মদ ফাহমি, আহমদ আল কুদসি এবং আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
এই লেখকদের ইসলামি ঐতিহ্যের উৎস এবং কোরআন-উত্তর সময়কালে যেসব অঞ্চলে তা বিকশিত হয়েছে তার সঙ্গে সরাসরি পরিচিতি রয়েছে। এছাড়াও তারা ইসলামি সমাজে হাল জমানায় চলতে থাকা মৌলবাদি বনাম প্রগতিশীলদের তর্ক-বিতর্ক সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। এই লেখকদের অনেকে ইসলামের ভেতর নগর-সভ্যতার প্রতি উৎসাহ যোগানোর স্পষ্ট প্রবণতার উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি ইসলামের সামাজিক মূলনীতিগুলোর সঙ্গে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের নৈকট্য দেখাতে চান।
তাদের এই বিচার বিশ্লেষণও মার্কস ও এঙ্গেলসের ইসলাম সম্পর্কিত ছড়ানো-ছিটানো মন্তব্যগুলোর ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু কেউই মার্কস ও এঙ্গেলসের মন্তব্যগুলোর খুব বেশি পদ্ধতিগত বিচার-বিবেচনা করেন নি। বিশেষ করে, এসব মন্তব্য কী ধরনের তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে গঠিত, কোন ক্রম এবং প্রেক্ষিতে এসব করা হয়েছিল এবং বিশেষ করে তারা যেসব ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন, যা তাদের ভিন্ন ভিন্ন উক্তিতে দেখা যায়, সেসব বিষয় সঠিকভাবে উপলব্ধি করার তাগিদে কোনও অনুসন্ধান চালানো হয়নি।
অথচ এভাবে বিস্তারিত নিরীক্ষণ ছাড়া ইসলাম সম্পর্কে মার্কস ও এঙ্গেলসের সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া সম্ভব নয় এবং ইসলামি সমাজের বিশ্লেষণে তাদের মেধাবী অর্ন্তদৃষ্টিও সঠিকভাবে ব্যাবহার করা সম্ভব হবে না।
এই লেখায় আমরা মার্কস ও এঙ্গলসের চিঠিপত্র এবং বিভিন্ন লেখার কিছু অতি পরিচিত মন্তব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেষ্টায় মনোযোগ দিব আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইকতিদার আলম খানের একটি লেখাকে আশ্রয় করে।
৩.
মার্কস ও এঙ্গেলস ইসলামি সভ্যতা সম্পর্কে গবেষণায় আগ্রহী হয়ে উঠেন ১৮৫৩ সালের দিকে, যখন তারা ইউরোপের বাইরের সমাজগুলোর প্রাকপুঁজিতান্ত্রিক গড়ন এবং পশ্চিমা-পুঁজিতান্ত্রিক আগ্রাসনের মুখে তাদের বিলীন হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করার পদক্ষেপ নেন। ইসলাম সম্পর্কে তাদের প্রাথমিক ভাবনা মূলত ইতিহাসবিদ গীবনের আরবদের ইতিহাস সম্পর্কিত লেখালেখির উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে।
গীবনের লেখালেখি তৎকালীন ইউরোপীয় প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এক অর্থে সম্পূর্ণ আলাদা এক ধারার সূচনা করেছিল। আরবদের চরিত্র সম্পর্কে ইউরোপীয় প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের মুল্যায়ন তখনও পর্যন্ত “নবী ঈসমাইলের উত্তরসুরিদের স্বাধীনতা-প্রেমি রোমান্টিক ইমেজ এবং নৈতিকতা ও বিবেক বর্জিত স্বেচ্ছাচারি বর্বরতার” মধ্যে খাবি খাচ্ছিল।
কিন্তু, ঈসমাইলের উত্তরসূরীদের অনুকুলে থাকা নবীত্ব ও অলৌকিকতার ফল হিসাবে আরবরা অনন্ত মুক্তি উপভোগ করছিল বলে চালু থাকা যাজকীয় মতামত গীবন দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। গীবন বলেন, আরবদের স্বাধীনতাপ্রেম কোনও নরগোষ্ঠীগত ব্যাপার নয় বরং তারা যে ভৌগলিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করত তারই ফল ছিল। ইসলামের আবির্ভাবকালে মক্কার অর্থনৈতিক কাঠামোর বিশ্লেষণে তিনি মক্কার ভৌগোলিক অবস্থানের উপর জোর দেন সবচেয়ে বেশি।
গীবনের মতে, মক্কা ছিল ইয়েমেনের বন্দরগুলো থেকে সিরিয়ার বসরা এবং দামেস্কে চলাচলকারী বাণিজ্যবহরগুলোর একটি মিলনস্থল। ওই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যরুটের মাঝখানে ছিল মক্কার অবস্থান। যেখানে বিনিময় বাণিজ্যের মধ্যদিয়ে প্রচুর ধন সম্পদের আমদানি হতো।
তার মতে, ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে এমন একটি সমাজে যার বিকাশ ঘটেছিল আরব ও ইয়েমেনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পূর্ব-পশ্চিমের বাণিজ্যের মাধ্যমে। সুতরাং ইসলামকে কোনও আধা-বর্বর বেদুইনদের সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি হিসাবে নয় বরং আরব জাতিকে সভ্যতার উচ্চতর স্তরে ঐক্যবদ্ধকারী হিসাবে পাঠ করতে হবে।
মার্কস ও এঙ্গেলস গীবনের এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি কিছুটা সহানুভুতিশীল ছিলেন বলে মনে হয়। তবে এ পর্যায়ে মার্কস প্রধানত মুসলিমদের শাসনাধীন অঞ্চলে ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থসামাজিক গতিধারা সম্পর্কে অনুসন্ধানে মনোযোগ দেন। অন্যদিকে এঙ্গেলস মূলত ইসলমি বিশ্বাসের সামাজিক উৎস এবং বিশ্ব-ইতিহাসে এর কী ভূমিকা সে বিষয়ে অনুসন্ধানে নিবিষ্ট হন। বিষয়টি ১৮৫৩ সালে তাদের লেখা কয়েকটি চিঠিপত্র থেকে জানা যায়।
১৮৫৩ সালের ১৮ মে মার্কসকে লেখা একটি চিঠিতে এঙ্গেলস চার্লস ফস্টারের The Historical Geography of Arabia বইটি পাঠ করে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত টানেন সে বিষয়ে আলোচনা করেন। বইটি ছিল বিভিন্ন স্থানের নাম, গোত্রীয় বংশবৃত্তান্ত, প্রাক-ইসলামি শিলালিপি— যেগুলো মাত্র কয়েক দশক আগে ইয়েমেনে পরিচালিত একটি ভারতীয় নৌ-অভিযানের সময় আবিস্কৃত হয়, সেসবের বিস্তারিত পাঠ সম্বলিত। বইটিতে প্রাচীন খ্রিস্টান ও গ্রিক উৎসগুলো থেকে প্রচুর সাক্ষ্য-প্রমাণের সহায়তা নেওয়া হয়েছিল।
যাই হোক, এঙ্গেলস বইটির একটি ভাসাভাসা পাঠ থেকে কয়েকটি অনুমানমূলক সিদ্ধান্ত টানেন যার উপর ভিত্তি করে তিনি তার ইসলামি ঐতিহ্য সম্পর্কিত মূল্যায়নটি হাজির করেন। তার বিশ্লেষণের কেন্দ্রীয় বক্তব্য ছিল “মোহাম্মদের ধর্মীয় বিপ্লব ছিল অন্যান্য ধর্মীয় আন্দোলনগুলোর মতোই একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এবং সেই পুরনো ও স্বাভাবিকের দিকে একটি কথিত প্রত্যাবর্তন।’’ তিনি ইসলামকে খ্রিস্টান এবং ইহুদী ধর্মেরও পূর্ববর্তী সময়কালের আরবদের বিস্মৃত সেই পুরনো একেশ্বরবাদী ঐতিহ্যের পুনরুত্থান হিসাবেই চিত্রায়িত করেন।
ইসলামকে বিশ্বজনীন প্রাসঙ্গিকতাহীন একটি ‘কৃত্রিম’ ধর্ম হিসাবে বিবেচনা করা এবং উর্বর অর্ধচন্দ্রভূমি (ফারটাইল-ক্রিসেন্ট) অঞ্চলে প্রাক-ইসলামি বসতি স্থাপন এবং ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে আরবদের বিপুল প্রসারের মধ্যে গুণগত তফাৎ না করাকে মার্কস কখনওই পুরোপুরি অনুমোদন করেননি। ১৮৫৩ সালের ২ জুন এঙ্গেলসকে লেখা মার্কসের একটি চিঠিটি থেকে বিষয়টি জানা যায়।
ওই চিঠিতে মার্কস এঙ্গলসকে যে সামাজিক গড়নের মধ্যে ইসলামের আবির্ভাব হয়েছিল তার রূপদানে আন্তদেশীয় বর্হিবাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। মার্কস গীবনের চমৎকার অন্তদৃষ্টিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আরও বলেন যে, ইউরোপ থেকে এশিয়ায় বাণিজ্যিক গমনাগমনের পথ পরিবর্তনের ফলে যে ব্যবসায়িক অবনতি দেখা দিয়েছিল তাও ইসলামের আবির্ভাবের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ইসলামি সম্প্র্রসারণের ফলে উর্বর অর্ধচন্দ্রভূমিতে (আধুনিক যুগের ইরাক, ইসরায়েল, জর্ডান, লেবানন, ফিলিস্তিন ও সিরিয়া এবং এর সঙ্গে উত্তর কুয়েত, দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্ক এবং পশ্চিম ইরান অঞ্চল) বড় বড় নগরের উত্থানের ঘটনা, যা নগর সভ্যতার প্রতি উৎসাহ প্রদানে ইসলামের অন্তর্গত স্বভাবের ইংগিত করে, এর সঙ্গে মিলিয়ে মার্কস ফ্রাসোয়া বার্নিয়ারের মুঘলদের সময়কালের বিশাল বিশাল নগরগুলোর পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেন।
এঙ্গেলস যেভাবে ব্যাপকহারে ক্রমবর্ধমান পণ্য উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে গঠিত ৭ম এবং ৮ম শতকের ইসলামি সভ্যতাকে ইউফ্রেতিসের উপত্যকায় আরবদের আগমনে জেগে ওঠার সঙ্গে তুলনা করেছেন তার সঙ্গেও মার্কস একমত পোষণ করেন নি।
মার্কস ‘প্রাচ্যের নগরসমূহ’ এবং মোঘল সামরিক ব্যবস্থার উপর বার্নিয়ারের বিভিন্ন লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, ইসলামি ঐতিহ্যের মূলে প্রোথিত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার ফলে এশিয়ার সর্বত্রই উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটি নগরায়ণ ঘটেছে। আরব তুর্কি মোগল সব শাসনের বেলায়ই একই কথা প্রযোজ্য।
দেখা যাচ্ছে, মার্কস ইসলামের ইতিহাস বিচারে এঙ্গেলস থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করছেন। তিনি বলেন যে, ইসলামী সভ্যতার প্রকৃতি অনুসন্ধানে ইসলামের উত্থানে অবদান রাখা প্রাক-ইসলামি চিন্তাধারা ও সামাজিক প্রবণতা সমূহের উপর গুরুত্ব না দিয়ে বরং ইসলামি শাসন ব্যবস্থার অধীনে যে সামাজিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে উঠেছে সেসবের একটি সুক্ষ বিচারের মধ্য দিয়েই শুরু করতে হবে।
এঙ্গেলসকে লেখা তার ঐ চিঠিতে মার্কস ইসলামি বিশ্বে কোনও “ব্যক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ত্ব ছিল না”, বর্নিয়ারের এই মত পুরোটাই অনুমোদন করে একেই ইসলামি সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে আখ্যা দেন। কেননা এটিই ইসলামি সমাজে পরিলক্ষিত বিশেষ ধরনের সামাজিক গড়নের পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে; যা আদিম স্তর থেকে এশিয়ার সমাজিক উন্নতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করেছে এবং প্রাচ্য পশ্চিম ইউরোপ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক গতিপথ অনুসরণ করে।
এই সময় বার্নিয়ার এবং পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছু কর্মকর্তার চোখে দেখা “ভূমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতি”কে মার্কস ইসলামি শাসনের ফল হিসাবেই ব্যাখ্যা করেন।
১৮৫৩ সালের ১৪ মে তারিখে এঙ্গেলসকে লেখা আরেকটি চিঠিতে মার্কস বলেন যে, সমগ্র এশিয়াজুড়ে ভূমিতে কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকার নীতিটা মুসলমানরাই সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিল। এসব মন্তব্য তিনি স্পষ্টতই বার্নিয়ার এবং অন্যান্যদের উপর নির্ভর করেই করেছিলেন।
কিন্তু এই লেখকরা ভারতবর্ষের ভূমি-সম্পর্কের বিচিত্র ধরন পুরোপুরি উপলব্দি করতে পারেননি। মার্কস-এঙ্গেলসও মুঘল সাম্রাজ্যের রাজস্ব ব্যাবস্থার মূল দলিলপত্র বা ভূমিতে বিভিন্ন ধরনের অধিকার নির্ধারণ করে দেওয়া ইসলামি দলিল-দস্তাবেজগুলো পড়ার সুযোগ পান নি। আর এ কারণেই তারা তাদের এই অশুদ্ধ মতামত আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ পাননি।
তবে মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের কোনও মতামতের ব্যাপারে কখনওই গোঁড়া ছিলেন না, যা পরবর্তী বিভিন্ন লেখায় স্পষ্ট হয়। মার্কস ও এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে তারা যেই তর্কের লাইন ধরে এই ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন সে বিষয়ে একটি পর্যলোচনা করে নিলে ভালো হবে।
৪.
ইসলামি শাসনের ফল হিসাবে ভূমিতে ব্যাক্তি মালিকানার অনুপস্থিতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত টানতে গিয়ে মার্কস ইসলামের বিভিন্ন রাজনৈতিক তত্ত্ব বা এর আইনী নীতিমালাগুলো অধ্যয়নের উপর নির্ভর করেননি। বরং শতশত বছরজুড়ে মুসলিম শসনাধীনে থাকা অঞ্চলগুলোর কিছু প্রশাসনিক দলিল-পত্রাদি ঘেঁটে ভূমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকার বিষয়ে মন্তব্য করেন।
১৮৫৩ সালের ১৪ মে তারিখের চিঠিতে মার্কস মোহাম্মদের (সা.) অনুসারীদেরকেই বিশ্বে সর্বপ্রথম ভূমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা ব্যক্তিমালিকানা না থাকার নীতি প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেন। পাশাপাশি মন্তব্য করেন যে, তবে সল্পসময়ের জন্য ইসলামি শাসনাধীনে থাকা অঞ্চলগুলোতে ভূমিতে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্ব দেখা যায়।
এর মধ্য দিয়ে মার্কস মূলত পরিস্কার করতে চাচ্ছেন যে, ভূমিতে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি উপস্থিত থাকার বিষয়টি শুধু ভারতের সেসব অঞ্চলের ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপ্রমাণগুলোতে পাওয়া যায় যেসব অঞ্চল অপেক্ষাকৃত কম সময়ের জন্য ইসলামি শাসনাধীনে ছিল। যেমন বাংলা ও বিহার, যেখানে লম্বা সময়জুড়ে ইসলামি শাসন ছিল, মার্কসীয় পাঠ অনুযায়ী এই অঞ্চলে লক্ষণীয়ভাবেই ভূমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুপস্থিতি ছিল।
এভাবে মার্কস মনে হয় মুসলিম শাসনাধীনে বিরাজিত এশীয় ধরন নামক সামাজিক গড়নকে প্রাচ্যজগতের বাকি অঞ্চল থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। এই সামাজিক গড়নের প্রধান চরিত্র ছিল কৃষক সম্প্রদায়ের উপর একটি বিছিন্ন ক্ষুদ্র শাসক-গোষ্ঠীর জন্য কৃষি উৎপাদনে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি নিশ্চিত করা এবং তা আত্মসাৎ করে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো বজায় রাখা।
এমন একটি সামাজিক গড়নে কৃষক সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরে কোনও ধরনের অর্থনৈতিক স্তরভেদ বা শ্রেণিভেদ করা সম্ভব হতো না। অন্যদিকে, বড় আকারের জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রের উপর কৃষক শ্রেণির একান্ত নির্ভরশীলতার কারণে, এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসক শ্রেণির সঙ্গে কৃষক শ্রেণির আর্থ-সামাজিক দ্বন্দ্বও কখনও দানা বাঁধতে পারেনি। মুসলিম রাষ্ট্রও সেই দায়িত্ব পুরোপুরি নিজে কাঁধে তুলে নেওয়ার ফলে বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে বিরাজমান বিরোধগুলো দানা বাঁধেনি এবং সমাজ একটি অন্তহীন বন্ধ্যাবস্থার মধ্যে পতিত হয়।
তবে, মার্কস ও এঙ্গেলস ইসলামি শাসনের চরিত্র এবং সামাজিক পরিণতি নিয়ে তাদের এসব চিন্তা-ভাবনা পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ১৮৫৮ সালের দিকেই মনে হয় মার্কস ভারতে ভূমিতে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির অস্তিত্বের বিষয়টি নিয়ে পুনরায় ভাবা শুরু করেন।
সে বছর নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে প্রকাশিত “ল্যান্ড টেনিওর ইন ইন্ডিয়া” শিরোনামের প্রবন্ধে মার্কস অযোধ্যার তালুকদারকে “সামন্ত-ভূমি-মালিক” হিসাবে আখ্যা দেন। মার্কস বলেন, তাদের অধিকারের উৎস যাই হোক না কেন তারা তাদের নিজেদের অনুকূলে আইনকানুন প্রণয়নের দাবি করতে পারত এবং তাদের এ দাবির একটি আইনী ভিত্তিও ছিল।
একই সময়ে নিউ অ্যামেরিকান সাইক্লোপিডিয়াতে এঙ্গেলস তার একটি লেখায় বলেন, আফগান গোত্র প্রধানরা তাদের গোত্রগুলোর উপর “এক ধরনের সামন্তীয় প্রভুত্বের” চর্চা করে থাকেন। ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকা মুল্যায়নে এটা ছিল মার্কস ও এঙ্গেলসের চিন্তা-ভাবনার নতুন দিগন্তের সুচনা।
তাদের মতে, তুর্কি অথবা মোঘলরা কেউই আধা-বর্বর আগ্রাসনকারী ধাঁচের কোনও দল ছিল না, যারা কালক্রমে ভারতীয় গ্রাম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিত অনড় সামাজিক ভিত্তির উপর তাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠায় থিতু হয়েছে। সেসময় মার্কসও আর বিশ্বাস করেন না যে, মুসলিম শাসকরা অবশ্যম্ভাবীরূপে ভূমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির নীতি রদ করেছিলেন। তিনি বিশ্বের অন্যান্য অংশের মুসলিম শাসকদেরকেও বিজিত অঞ্চলগুলোতে সামন্ততান্ত্রিক বা আধা সামন্ততান্ত্রিক সম্পত্তি-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব প্রদান করেন।
এই স্বতন্ত্র ভাবনাটি এঙ্গলসের ১৮৭০ এর দশকের লেখাগুলোতে বারবারই দেখা যায়। এ থেকে মনে হয় যে, তারা বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। কিন্তু মার্কস ও এঙ্গেলস বিষয়টিকে একটি যথার্থ বিশ্লেষণাত্মক কাঠামোর মধ্য দিয়ে হাজির করতে পারেননি। কারণ, এসময় তারা ভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
যাই হোক, এ প্রসঙ্গে Anti-Duhring (1878)-এ এঙ্গেলসের একটি উক্তির উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন “তুর্কিরা প্রাচ্যে তাদের বিজিত দেশগুলোতে একটি সামন্তীয় ধরনের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিল।’’ ঐ একই বইয়ে তিনি স্পেনের মুরদেরকে তাদের খ্রিস্টান বিজিতদের চেয়ে সভ্য হিসাবে উল্লেখ করেন। এসব বক্তব্যে এঙ্গেলসের যে ভাব প্রকাশ পায়, তা আরও জোরালো হয় ১৮৮২ সালের ডিসেম্বরে মার্কসকে লেখা তার আরেকটি চিঠিতে। এতে তিনি পুরোনো তুর্কী আধা-সামন্ততান্ত্রিক যুগের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খ্রিস্টানদের অবস্থাকে ভূমিদাসত্ব এবং বন্দীত্বের সঙ্গে তুলনা করেন।
মার্কস ও এঙ্গেলস মুসলমানদের শাসিত দেশগুলোতে প্রাপ্ত অবস্থাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই নতুন ধারণায় উপনীত হন প্রধানত ১৮৭০ এর দশকে ভারতীয় ইতিহাসের উপর তাদের পড়াশুনার উপর ভিত্তি করে। এ প্রসঙ্গে মার্কসের “নোটস অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রির”র কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে মার্কস তুর্কি বিজয় থেকে শুরু করে উনিশ শতকের মাঝমাঝি সময় পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছিলেন।
এসব আলোচনা মার্কস সম্ভবত এলফিনস্টোনের ‘হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ এবং রবার্ট সোয়েলের ‘এ্যানালিটিকাল হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ পড়ে করেছেন। মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠালগ্নকে মার্কস তার ভারতীয় ইতিহাস অনুসন্ধানের সূচনাবিন্দু হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, মার্কস মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাকে ভারতের ইতিহাসে একটি মোড়-পরিবর্তনকারী ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করতেন, যা ভারতের ইতিহাসে এক নতুন ধরনের উৎপাদন সম্পর্কের প্রবর্তন করেছিল।
“নোটস অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি”-তে মার্কস দিল্লি সালতানাত ও মোঘল সাম্রাজ্যের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ম-কাণ্ডের বিবরণ সম্বন্ধে যেসব পরিভাষা, সংজ্ঞা এবং সাধারণ মন্তব্যের উপর জোর দিয়েছেন তা খুবই লক্ষণীয়। যেমন গজনভীদের অধীনস্ত সমাজ সম্পর্কে বর্ণনায় তিনি আরবীয় অভিজাতদেরকে বেসামরিক সরকার পরিচালনাকারী পারসিক এবং তাতার পশুপালকদের থেকে আলাদা করছেন।
এ থেকে বোঝা যায়, মার্কস অভিজাত ও রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের মধ্যে একটি শ্রেণিগত ফারাক করছেন যা এশীয় স্বৈরতান্ত্রিক মডেলের মধ্যে ব্যত্যয়ের একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ। মার্কসের প্রাথমিক সংজ্ঞানুযায়ী, ভূমিতে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সম্পূর্ণরূপে রদকরণের মাধ্যমে যা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা আহরণ করত। এ প্রসঙ্গে “জায়গীর” প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তার বর্ণনাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জায়গীরকে রাজা কতৃক কোনও ব্যক্তিকে প্রদত্ত পুরস্কার হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে মার্কস উপর থেকে আরোপিত একটি সামন্তীয়করণ প্রক্রিয়ার দিকেই ইংগিত করেন।
আকবরের রাজস্বব্যবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি যেসব বিষয়ের উপর জোর দেন তা থেকে মনে হয়, তিনি রাষ্ট্রকতৃক প্রতিবিঘা জমিতে গড়পড়তা উৎপাদনের উপর নগদ অর্থে রাজস্ব ধার্য করার বিষয়টিকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করতেন। এ থেকে বোঝা যায়, এ সময় মার্কস আকবরের রাজস্ব ব্যবস্থা হতে উদ্ভূত সামাজিক সম্পর্কগুলোর সঙ্গে এশীয় উৎপাদন ব্যাবস্থার উপর তার প্রাথমিক প্রতিপাদ্যের মীমাংসা কিভাবে করা যায় এ প্রশ্নটি নিয়েও স্পষ্টতই উদ্বিগ্ন ছিলেন।
৫.
উপরে আলোচিত মার্কস ও এঙ্গেলসের মেধাবী অন্তদৃষ্টি এবং চরিত্রায়নের আলোকে ইসলামের ঐতিহাসিক ভূমিকার ব্যাখ্যা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম মানুষের অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বের কতিপয় অন্ধ-বিশ্বাসই মাত্র নয়। ইসলাম শুধু পরকালের ভয় দেখিয়েই একজন বিশ্বাসীকে একটি সাধু জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে না বরং তাদের বিবেক এবং ইনসাফ ও সততার প্রতি তার দায়বদ্ধতার ব্যাপারটিও স্মরণ করিয়ে দেয়।
সেখানে শুধু প্রত্যাদেশের উপরই আটকে থাকতে বলে না বরং নিজের বোধবুদ্ধি ও বিবেকের আশ্রয় গ্রহণেরও তাগিদ দেয়। ইসলামের এই সৎ, সুন্দর, নৈতিক জীবন যাপনের আকুতি সপ্তম শতকের প্রথমার্ধের মক্কার ব্যবসা-বাণিজ্যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমকামি মহাজনশ্রেণি এবং যাযাবর দস্যুদের বিরুদ্ধে উদীয়মান মাঝারি পর্যায়ের ব্যাবসায়ী ও চাষী সম্প্রদায় এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র উৎপাদকদের লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই রূপ লাভ করে।
একই সঙ্গে ইসলাম সমগ্র মানব সমাজে এই জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি আত্মনিবেদিত সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। ইসলামের প্রথম যুগে এই সম্প্রদায় বা উম্মা ইসলাম-পূর্ব মক্কা-মদীনার আরবদের আন্ত-গোত্রীয় রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সম্মিলনের মাধ্যমে গঠিত একটি ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র কাঠামোর উপর ভিত্তি করেই গঠিত হয়।
কিন্তু উর্বর অর্ধ-চন্দ্রভূমি, পারস্য এবং মিশর ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে আসার পর তা সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ধরনের ক্ষমতা-কাঠামোর রূপ নেয় এবং উদ্ভব ঘটে এক স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের যা মূলত সেক্যুলার তথা ইহজাগতিক হলেও সবসময় একটি ধর্মতাত্ত্বিক ন্যায্যতার প্রয়োজন অনুভব করত। আব্বাসী খেলাফতের ধ্বংসস্তুপের উপর প্রতিষ্ঠিত তুর্কী রাষ্ট্রে এই ধরনের রাষ্ট্রীয় সংগঠনের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।
রাজস্ব প্রশাসনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই রাষ্ট্র-ব্যবস্থা তার অধীনস্থ সমাজগুলোর অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে এক সুদূর-প্রসারি পরিবর্তন সাধন করে। উদাহরণ স্বরূপ, হিন্দুস্তানে বিশেষ করে দিল্লি সালতানাত এবং মোঘলদের সময় এই ধরনের রাষ্ট্র-কাঠামো, প্রধানত অমুসলিম বংশানুক্রমিক শাসক-প্রধানদের ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক আধিপত্যকে খর্ব করে, উপর থেকে নগর ভিত্তিক একটি শাসক শ্রেণিকে চাপিয়ে দেয়।
আব্বাসীদের পরবর্তী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে আসা এই ধরনের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতেই মার্কস ও এঙ্গেলস মুসলমানদেরকে তুরস্ক ও হিন্দুস্তানে একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক ধরনের শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন এক সভ্যতা প্রবর্তনের কৃতিত্ব দেন।
তথ্যসূত্র: Marx’s Assessment of Islamic Tradition, Iqtidar Alam Khan, Social Scientist, Vol. 11, No. 5. (May, 1983) pp. 3-15.
লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
ইমেইল: [email protected]