তিন যুগ আগেই একজন নারীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছে পাকিস্তান। ১৯৮৮ সালে দেশটির একাদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রয়াত বেনজির ভুট্টো। বেনজির অবশ্য শুধু পাকিস্তান নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বেরই প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে দেখা যায়নি আরও কোনও নারীকে।
প্রধানমন্ত্রী পদে তিন যুগ আগে একজন নারীকে পেলেও মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানে এখনও কোনও নারীর দেখা মেলেনি। দেশটির ষোড়শ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে একজন নারী মুখ্যমন্ত্রী পেতে যাচ্ছে দেশটি। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন দেশটির তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ শরিফ।
নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মরিয়ম গত ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দেশটির সবচেয়ে সমৃদ্ধ, জনবহুল ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাঞ্জাব প্রদেশের একটি আসন থেকে বিজয়ী হন। শুধু পাঞ্জাব নয়, লাহোরের একটি আসন থেকে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনেও বিজয়ী হন মরিয়ম।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে কোনও দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় পিএমএল-এন ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতারা কয়েক দফা বৈঠকের পর মঙ্গলবার রাতে কেন্দ্র ও প্রাদেশিক পরিষদে জোট সরকার গঠনে ঐকমত্যে পৌঁছান। এরপরই বুধবার মরিয়মকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণা আসে।
৫০ বছর বয়সী মরিয়ম বুধবার পিএমএল-এনের প্রথম সংসদীয় দলের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সেখানে তিনি বলেন, “আল্লাহর রহমতে আমি পাকিস্তানের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়েছি। এটি কেবল মনোনয়ন হলেও আমার জন্য এই ঘটনা অনেক সম্মানের। এই সম্মান আমি প্রতিটি পাকিস্তানি মা, মেয়ে, বোন, কিশোরী এবং নির্বাচিত নারী ও সংরক্ষিত নারী আসনের আইনপ্রণেতাদের উৎসর্গ করতে চাই।”
পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সামরিক ও শিল্প অভিজাত শ্রেণির কেন্দ্রস্থল পাঞ্জাব। ১২ কোটি ৭০ লাখের বেশি মানুষ এখানে বাস করে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি।
পাকিস্তানের পার্লামেন্টে পাঞ্জাবের আসন সংখ্যা ১৭৩টি। এ কারণে এই প্রদেশ ঘিরে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাও সবসময় তীব্র হয়। কোনও দলের পাঞ্জাবের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারার অর্থ জাতীয় রাজনীতিতেও দলটির প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতালাভ। মরিয়ম পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হলে নিঃসন্দেহে সেখানে পিএমএল-এনের শক্তি আরও বাড়বে।
এমন একটি প্রভাবশালী প্রদেশের দায়িত্ব পেয়ে কী করবেন, তা সংসদীয় দলের ওই বৈঠকে তুলে ধরেন মরিয়ম। তিনি বলেন, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতাকে তার সরকার ‘রেড লাইন’ হিসেবে দেখবে, যা কাউকে অতিক্রম করতে দেওয়া হবে না।
বৈঠকে পাঞ্জাবে উন্নয়নের নতুন যুগ শুরুর অঙ্গীকার করেন মরিয়ম। তিনি জানান, তার সরকার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইটিসহ অন্যান্য খাতকে বিকশিত করবে।
জনগণ মরিয়মকে নির্বাচিত করে তাদের সেবা করার যে সুযোগ দিয়েছেন, তার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মরিয়ম। তবে তিনি এও জানান, দেশের বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় পাঁচ বছর যথেষ্ট নয়।
পাঞ্জাবে পাঁচটি আইটি শহর গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে মরিয়ম বলেন, “আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আনব। একই সঙ্গে তরুণদের সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে তাদের আইটি সংক্রান্ত প্রকল্পে উদ্বুদ্ধ করব।”
রাজনীতিতে প্রবেশের আগে শরিফ পরিবারের জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মরিয়ম। শরিফ ট্রাস্ট, শরিফ মেডিকেল সিটি ও শরিফ এডুকেশন ইনস্টিটিউটসের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করেন নওয়াজ শরিফের এই মেয়ে।
২০১৩ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে সামনে রেখে বাবা নওয়াজ শরিফের হয়ে প্রচারণা চালাতে ২০১২ সালে প্রথম রাজনীতির মাঠে পা রাখেন মরিয়ম। সেই নির্বাচনে দলের নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্ব পালন করা মরিয়ম অল্প সময়ের মধ্যেই দলে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যান। নির্বাচনের বিজয়ের পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর ইয়ুথ প্রোগ্রামের চেয়ারপারসন হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
অবশ্য ২০১৪ সালে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। কারণ তার নিয়োগ নিয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলেছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। শুধু তাই নয়, তার বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি সে সময় লাহোর হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জও করা হয়।
নওয়াজ শরিফের প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য হওয়া ও দুর্নীতির মামলায় তাকে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে দোষী সাব্যস্ত করা- বাবার জীবনের এই দুই ঘটনা মরিয়মকে ২০১৭ সালের দিকে রাজনীতিতে আরও সক্রিয় করে তোলে।
লন্ডনে কয়েকটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতিতে সহায়তার মামলায় ২০১৮ সালে মরিয়মকে দোষী সাব্যস্ত করে পাকিস্তানের একটি দুর্নীতি দমন আদালত। সাত বছরের কারাদণ্ড হয় তার। ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক মাস পর ওই মামলা থেকে মরিয়মকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
নওয়াজ শরিফ যুক্তরাজ্যে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাওয়ার পর রাজনীতির মাঠে মরিয়মের বিচরণ বেড়ে যায়। ২০১৯ সালে পিএমএল-এনের সহসভাপতির দায়িত্ব পান তিনি।
সূত্র: ডন ও আরব নিউজ