২০১৭ সালের ১১ মার্চ তারিখে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যের উপর দীর্ঘ চারঘণ্টা সরকার ও বিরোধীদলীয় অর্ধশতাধিক সংসদ সদস্য আলোচনা করেন। আলোচনার প্রেক্ষিতে একটি সংশোধিত প্রস্তাব উত্থাপন করে বলা হয়—
“ যেহেতু গণহত্যার শিকার বিভিন্ন দেশ গণহত্যায় নিহতদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি গণহত্যার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য জাতীয় পর্যায়ে গণহত্যা দিবস পালন করে, সেহেতু আমরা ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করছি।’’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামরিক নৃশংসতা শুরুর দিনটিকে জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। একইসাথে এই নৃশংসতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রস্তাবও গৃহীত হয়। সেই থেকে সরকারীভাবে ২৫ মার্চ ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
এই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং জরুরি। তবে, একটা কথা এখানে স্পষ্ট হওয়া জরুরি যে, একাত্তরের বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ২৫ মার্চ কালরাতে যে জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ শুরু করেছিল সেসব তারা ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণের আগপর্যন্ত চালিয়ে গেছে। কিন্তু প্রতীকীভাবে এই নৃশংসতা শুরুর দিনটি, অর্থাৎ ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা’র দিন হিসেবে আমরা স্মরণ করছি।
তবে ২৫ মার্চ ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ পালন বিষয়ে দুটো সম্পূরক ভাবনা রয়েছে।
প্রথম ভাবনাটি হলো, সংশোধিত প্রস্তাবেই বলা হয়েছে—“গণহত্যার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য” এই উদ্যোগ। এরকম আরও কিছু অপরাধমুলক বা ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দিবস পালনের উদাহরণ রয়েছে। যেমন ২১ মার্চ ‘বর্ণ বৈষম্য বিলোপ দিবস’, ২৮ মার্চ ‘জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস’, ৩১ মে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’।
অন্যদিকে, ২০১৫ সাল থেকে জাতিসংঘের আয়োজনে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে ৯ ডিসেম্বর পালিত হচ্ছে ‘জেনোসাইড প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শুরু করা নৃশংসতা নিশ্চয় আমরা উদযাপন করছি না। তাই এটি ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা যেমন অর্থবোধক হয়না তেমনি তা শোভনও নয়। সেক্ষেত্রে দিনটি ‘জাতীয় গণহত্যা স্মৃতি দিবস’ বা ‘জাতীয় গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালিত হতে পারত বলে মনে হয়।
একই সাথে দ্বিতীয় ভাবনাটি হলো— একাত্তরের ওই ভয়াবহ নৃশংসতা, ওই হত্যাযজ্ঞকে আদৌ আমরা শুধু ‘গণহত্যা’ বলতে পারি কিনা?
৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের আহ্বানে আন্তর্জাতিকভাবে এখন যে ‘জেনোসাইড প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হচ্ছে তার একটি ঐতিহাসিক পরম্পরা আছে।
১৯৪৮ সালের এই দিন জাতিসংঘে গৃহীত হয়েছিল ‘দ্যা কনভেনশন অন দ্যা প্রিভেনশন এন্ড পানিশমেন্ট অফ দ্যা ক্রাইম অফ জেনোসাইড’। এই কনভেনশন অনুযায়ীই ‘জেনোসাইড’ একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, জেনোসাইড প্রতিরোধ করা এবং জেনোসাইডের শাস্তি নিশ্চিত করা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যকর্তব্য বলে ঘোষিত হয়।
রাফায়েল লেমকিন নামে একজন পোলিশ আইনজ্ঞ ও অধ্যাপকের দীর্ঘ দেড়যুগের প্রায় একক প্রচেষ্টার অর্জন ছিল জাতিসংঘের ওই কনভেনশন। ‘জেনোসাইড’ শব্দটিও তাঁর গৃহীত, যা মূলতঃ একটি গ্রিক শব্দ।
জাতিসংঘ কনভেনশনে খুব স্পষ্টভাবে জেনোসাইডের সংজ্ঞাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে— জেনোসাইড একটি সমন্বিত, পূর্বপরিকল্পিত অপরাধ। একটি জনগোষ্ঠীর ধর্ম/গোত্র/নৃতাত্ত্বিক/জাতি পরিচয় আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যদি হত্যা, শারীরিক ক্ষতি করা হয় বা এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যে তাদের জীবনধারণ ও স্বাভাবিক সন্তান উৎপাদন ব্যাহত হয় কিংবা তাদের সন্তানদের জোরপূর্বক সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে সেটি জেনোসাইড।
জেনোসাইডে মূল অপরাধ— জনগোষ্ঠীর পরিচয় নির্মূল করে দেওয়ার অভিপ্রায়। ইংরেজিতে বলা হয়েছে— ‘ইন্টেন্ট টু ডেস্ট্রয়’।
জেনোসাইড বাস্তবায়নের একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় গণহত্যা বা মাসকিলিং। কিন্তু জেনোসাইডে কেবল গণহত্যার ঘটনাই ঘটেনা। আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর নারীদের ধর্ষণ করা হয়, জোরপূর্বক উদ্বাস্ত করা হয়, সম্পদ লুট করা হয়, পরিচয় বহন করে এমন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা এসব অপরাধের প্রতিটিই ঘটিয়েছে। এসব অপরাধ ঘটানোর পেছনে তাদের অভিপ্রায়ও সুস্পষ্ট ছিল।
দীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে নিজস্ব জাতিপরিচয় গড়ে উঠেছিল তা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল, তাই সেই পরিচয় ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে এসব বহুমুখী নৃশংসতা ঘটিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রশক্তি।
জাতিপরিচয় নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্য স্পষ্ট বলেই, জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী ’৭১-এর নৃশংসতা একটি পূর্ণাঙ্গ জেনোসাইড। গণহত্যা সেই জেনোসাইডে ব্যবহৃত অনেকগুলো হাতিয়ারের অন্যতম, কিন্তু একমাত্র নয়। আলাদাভাবে গণহত্যা কোনও আন্তর্জাতিক অপরাধও নয়, তাই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও হয়না। আন্তর্জাতিক অপরাধটি হচ্ছে ‘জেনোসাইড’, সেজন্য জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি করা হয়। আমরাও তাই করছি।
‘জেনোসাইড’-কে শুধু ‘গণহত্যা’ বলা হলে একদিকে যেমন একটি আন্তর্জাতিক অপরাধকে স্থানীয় অপরাধে পরিণত করা হয় তেমনি জেনোসাইডারদের মূল অভিপ্রায় (আমাদের ক্ষেত্রে জাতিপরিচয় নিশ্চিহ্ন করা) আড়ালে চলে যায়। এ ছাড়া জেনোসাইডকালে সংগঠিত অপরাপর অপরাধগুলোও গুরুত্ব হারায়।
তাই সবদিক বিবেচনায়— ২৫ মার্চ শুরু হওয়া নৃশংসতাকে গণহত্যার বদলে জেনোসাইড বলা যৌক্তিক। আমরা যদি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে চাই তাহলে এমন শব্দচয়ন করা প্রয়োজন যা জেনোসাইড ধারণাকে পূর্ণভাবে প্রকাশ করে।
গণহত্যা কোনওভাবেই জেনোসাইডকে পূর্ণভাবে বোঝায়না। জেনোসাইড মূলত গ্রিক শব্দ হলেও এখন তা ইংরেজি ভাষায় অঙ্গীভূত এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত একটি শব্দ। বাংলা ভাষা এমনিতেই ঋদ্ধ হয়েছে প্রচুর বিদেশি শব্দে। এই শব্দটিকেও আত্মীকরণ করে নিলে আমাদের ক্ষতির কিছুর নেই।
সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে বলা যায় ২৫ মার্চকে তাই জাতীয়ভাবে ‘জেনোসাইড স্মরণ দিবস/প্রতিরোধ দিবস” হিসেবে পালন করা জরুরি। অন্যথায় উদ্যোগটির অর্থময়তা সাংঘর্ষিক হবার ঝুঁকি রয়ে যায়।
লেখক: গবেষক ও লেখক।
ইমেইল: hasan_murshed@hotmail.com