এই তো গত ২৪ জানুয়ারি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের জন্য ১৬ জনের নাম ঘোষণা করা হলো। এবারই প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। আর এ সম্মাননাটি পেয়েছেন মাসুদ পথিক।
নিজেকে অকপটে ‘প্রথমত কবি, দ্বিতীয়ত কবি এবং তৃতীয়ত চলচ্চিত্র নির্মাতা’ বলে মনে করেন মাসুদ পথিক। সম্ভবত এ কারণেই তিনি অন্যদের থেকে এগিয়ে আছেন বাংলা একাডেমি সম্মাননা প্রাপ্তিতে।
কবিতা থেকে বারবার সিনেমা নির্মাণের পেছনে এই কী মূল কারণ তাহলে?
উত্তরে সকাল সন্ধ্যাকে মাসুদ পথিক বললেন, ”আমি কবিতাকে যাপন করি একদম শিশুকাল থেকে। আমার ২৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা লেখার জন্য কিছু স্বীকৃতিও পেয়েছি।
”আমরা কাব্যিক হয়ে উঠতে চাই সবকিছুতেই। সিনেমায় কাব্যিক হয়ে উঠতে চাই, পেইন্টিংয়ে পোয়েটিক হয়ে উঠতে চাই। এই যে কবিতা লিখি, কবিতাকে যাপন করি এজন্যই আমার সবকিছু কবিতা কেন্দ্রিক।”
কবি নির্মলেন্দু গুণের নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ কবিতা অবলম্বনে চিত্রনাট্য লিখেছিলেন মাসুদ পথিক। এরপর তার পরিচালনায় চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছিল নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ। ২০১৪ সালে সেরা সিনেমা হয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘরে তুলেছিল নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ।
এরপর ২০১৯ সালের সিনেমা নিয়ে ৪৪তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আসরে মাসুদ পথিকের মায়া দ্য লস্ট মাদার আটটি পুরস্কার পায়। এই সিনেমার চিত্রনাট্য হয়েছিল কবি কামাল চৌধুরীর ‘যুদ্ধশিশু’ কবিতা অবলম্বনে।
এরপরও আবারও কবিতা থেকে সিনেমা নির্মাণের কাজ শেষ করেছেন এই নির্মাতা। বক: দ্য সোল অব ন্যাচার তার ’কবিতা থেকে নির্মিত তৃতীয় সিনেমা’ বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানালেন। কবি জীবনানন্দ দাশের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ মহাপৃথিবী প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৪৪ সালে। প্রকাশক ছিলেন পূর্বাশা লিমিটেডের সত্যপ্রসন্ন ঘোষ। এই কাব্যগ্রন্থের বহুপঠিত কবিতা হলো ’আট বছর আগে একদিন’। এরও আগে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ’কবিতা’ পত্রিকায় বাংলা ১৩৪৪ সালের চৈত্র সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল ’আট বছর আগে একদিন’।
অর্থাৎ ৮০ বছরেরও বেশি পুরনো সময়ের একটি কবিতা বেছে নিয়েছেন মাসুদ পথিক। মূলত তার সঙ্গে আলোচনা হয় নতুন এ চলচ্চিত্রটি নিয়েই।
এই সিনেমায় কি তাহলে অতীত সময়ের চিত্রায়ন হবে?
উত্তরে কাব্য করেই বক পরিচালক বলেন, “একটি ভালো কবিতা আসলে সর্বকালের হয়ে যায়। ”
সিনেমা নির্মাণে এবার জীবনানন্দের কবিতা বেছে নিলেন কেন?
মাসুদ পথিক বলেন, “বাংলা ভাষায় জীবনানন্দ দাশ আমার অন্যতম পছন্দের কবি।
”তার কবিতায় প্রকৃতি ও পরাবাস্তবতার সমন্বয় অসাধারণ। আমি তার ভক্ত। এই সিনেমার নির্মাণেও দার্শনিক পরাবাস্তব অনুভব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আমরা।”
নিজেকে পরিচালক নয়, নির্মাতা বলতে চান মাসুদ পথিক। তার মতে, ‘কোনো কিছুর প্রকাশের উদ্দেশ্য শুধু বিনোদন দেওয়াই নয়’।
বক সিনেমা নির্মাণের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
”নিখুঁত করা বা রিয়েলিটির কাছাকাছি যেতে চেষ্টা করা এটা আমাদের মধ্যে ছিল”, বলেন মাসুদ পথিক।
আর এই নিখুঁত কাজ করতে গিয়ে শুটিংয়ে মেকআপ ম্যান নিতেন না বলেও জানালেন।
”আমার সেট নির্মাণ হয়েছে এক বছর আগে। জুলাই ও আগস্টে শুটিং হয়েছে। ৩৬ দিনের মত লোকেশনে থাকতে হয়েছিল এই সিনেমার শুটিং কাজে। শুটিং দিনে গরমে জিভ বার হয়ে গিয়েছিল আমাদের। আমার গায়ের চামড়া পুড়ে গিয়েছে, এখনও ঠিক হয়নি। আমরা সবাই কষ্ট করেছি।”
বক সিনেমায় প্রকৃতির চিত্রায়নেও কবিতা লিখতে চেয়েছেন মাসুদ পথিক।
“এই সিনেমায় প্রকৃতি আরেকটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। গ্রামে শুটিং হয়েছে। বক হলো আরেকটি চরিত্র। বকের জন্য আমার অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় হয়েছে। বক পালতে হয়েছে। বকের বাচ্চা বড় করতে হয়েছে এই সিনেমার জন্য।”
বক নির্মাণ করতে গিয়ে আরও অনেক প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়েছে নির্মাতাকে। বড় পর্দায় কবিতা লেখার এই প্রচেষ্টা যে ’একদম সহজ নয়’, জানা গেল তার কাছ থেকে।
”আর্থিক প্রতিকূলতা, সামাজিক প্রতিকূলতা, তারপর টাকা ফেরৎ না আসার চিন্তা, প্রচার না পাওয়ার প্রতিকূলতা তো আছেই।”
তাহলে বক নির্মাণের বাজেট সংকুলান হলো কীভাবে?
”নিজস্ব অর্থায়নের পাশাপাশি স্পন্সর থেকে পাওয়া অর্থে কিছু খরচ মেটানো হয়েছে এই সিনেমার”, বললেন মাসুদ পথিক।
”কিছু টাকা বন্ধুদের থেকে আর কিছু মায়ের থেকে ধারও করতে হয়েছে। দেখা যায় কাজেই টাকা শেষ হয়ে যায়, প্রচারে আর বিদেশি সিনেমা উৎসবে যোগ দিতে প্রস্তুতিতে খুব বেশি টাকা থাকে না হাতে।”
বক প্রযোজনা করেছে ব্রাত্য ক্রিয়েশন এবং কো-স্পনসর প্রতিষ্ঠান হচ্ছে গ্রিপ।
এই সিনেমার প্রধান দুটি চরিত্র সুরুজ দেওয়ান ও সবিতা। তাতে কাজ করেছেন রতন দেব এবং রুনা খান।
সিনেমা মুক্তির আগের রাখঢাকটুকু রেখেই পরিচালক বলেন, ”এই চলচ্চিত্রের প্রোটাগনিস্ট একজন বিপন্ন বিস্ময়ের বাসিন্দা। তার সহধর্মিণীও একটা টানাপড়েন নিয়ে থাকে। মূল চরিত্রে আমার এই কাজের জন্য অভিনেতা রতন দেব নয় মাস অন্য কোনো কাজ করেননি। তিনি মঞ্চের লোক। এর আগে কিছু সিনেমা করেছেন।”
”রুনা খান এই সিনেমায় প্যারালাল ক্যারেকটার, ওমেন প্রোটাগনিস্ট। সেও আমাকে অনেকটা সময় দিয়েছে।”
বক সিনেমার সাথে জড়িয়ে আছে আরও একটি নাম; অঋব অনুসূর্য।
২০২১ সালের ২১ অক্টোবর বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে মারা যায় মাসুদ পথিকের সন্তান অঋব অনুসূর্য। তখন তার বয়স ১০ বছর পেরিয়েছিল।
জীবদ্দশায় ছেলে অঋব অনুসূর্য বাবাকে স্ক্রিপ্ট লেখার কাজে সহযোগিতা করতে শিখেছিল ওই বয়সেই।
সন্তানের কথা মনে করে বাবা মাসুদ পথিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ”আমার সন্তান এই সিনেমার স্ক্রিপ্টের কো-রাইটার ছিল। আট বছর আগে স্ক্রিপ্ট লেখা হয়েছিল। ও ১০ বছর বয়সে মারা যায়। এই সিনেমা তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে।”
এই সিনেমার শুটিং পরবর্তী কাজ প্রায় শেষ হলেও মুক্তি পাবে বছরের শেষ নাগাদ। এর আগে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বক নিয়ে অংশ নেবেন মাসুদ পথিক। আর আগামী মাস থেকেই এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবেন বলে জানালেন।
মাসুদ পথিকের এরপরের সিনেমাও কি কবিতা থেকেই হবে?
দায়বদ্ধতা থেকে সিনেমা বানান জানিয়ে সকাল সন্ধ্যাকে এই নির্মাতা বলেন, ”নান্দনিকতার প্রতিরূপ হলো কাব্যিক হয়ে ওঠা।
”সিনেমা কখনও কনটেন্ট নয়, সিনেমা হচ্ছে সাইকোলজিকাল ফিলসফি। সিনেমা হচ্ছে পোয়েটিক মুভমেন্ট। সিনেমা হচ্ছে লড়াই। আমার তো আরও ১৮টা স্ক্রিপ্ট হাতে আছে, আর সবই কবিতা অবলম্বনে।”