Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

মতিয়া চৌধুরী : হংস মাঝে বক

মতিয়া চৌধুরী, অগ্নিকন্যা নামে যার খ্যাতি।
মতিয়া চৌধুরী, অগ্নিকন্যা নামে যার খ্যাতি।
[publishpress_authors_box]

রাজনৈতিক দর্শনের দিক বদলেছিলেন, কিন্তু ব্যক্তি জীবনে পঙ্কিলতার ছোঁয়া লাগতে দেননি তিনি। সেই কারণে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কাছেও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত নাম মতিয়া চৌধুরী।

বাংলাদেশের এখনকার রাজনীতিতে ব্যতিক্রমের নজির হয়ে থাকা মতিয়া চৌধুরীর ৮২ বছরের পথচলা সাঙ্গ হলো বুধবার।

তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে তার এক সময়ের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি, ডাকসুর সাবেক এজিএস নাসির-উদ-দুজা লিখেছেন, “উনার জীবদ্দশায় আমার সাথে একাধিকবার উনার সাক্ষাৎ হয়েছিলো। প্রত্যেক বারই সহমতের বদলে দ্বিমতই প্রাধান্য পেয়েছে। তারপরও নির্দ্বিধায় বলতে হয়, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশে পেশাদার নারী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য একজন।”

ছাত্র আন্দোলন থেকে জাতীয় নেতা হয়ে ওঠা মতিয়া চৌধুরীর নাম বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস লিখতে গেলে নানা ক্ষেত্রেই আসবে সামনে।

বাংলাদেশের কোনও ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে আসা প্রথম নারী তিনি, ডাকসৃুর জিএসের পদে আসা প্রথম নারীও তিনিই। গত শতকের ষাটের দশকে রাজপথে সদর্প বিচরণে তাকে এনে দিয়েছিল ‘অগ্নিকন্যা’র খেতাব।

বাম রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী লীগের এলেও রাজনীতিতে সমান সক্রিয় ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। সেই ধারায় সংসদ সদস্য, এমপি, মন্ত্রী, সংসদ উপনেতা হলেও জীবনাচরণে তিনি ছিলেন সব সময়ের মতো সাদামাটা একজন।

এমন এক সময়ে তার মৃত্যু হলো, যখন আওয়ামী লীগ তার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুঃসময় পার করছে। আন্দোলনের দলটি এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারিয়ে ছন্নছাড়া এক অবস্থায়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এমন দুঃসময় এসেছিল আওয়ামী লীগের জন্য। সেই সময়েই এই দলে যোগ দেন মতিয়া চৌধুরী। তারপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দল পুনর্গঠনের প্রতিটি পর্যায়ে তার সঙ্গেই ছিলেন মতিয়া।

রাজপথে আন্দোলনে সক্রিয় থেকে পুলিশের মার খেয়েছেন, জেলে গিয়েছেন, কিন্তু পথহারা হননি মতিয়া। ২০০৭ সালে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হয়ে যখন কারাগারে, তাকে বাদ দিতে যখন দলেরই একদল নেতা সক্রিয়, তখন মতিয়া চৌধুরী দাঁড়িয়েছিলেন শেখ হাসিনার পাশে।

শেখ হাসিনার কতটা বিশ্বস্ত ছিলেন মতিয়া চৌধুরী; তা বোঝা যায় কয়েকটি ঘটনায়। ২০০৯ সালে রক্তাক্ত বিডিআর বিদ্রোহের পর শেখ হাসিনা যখন সেনানিবাসে গিয়েছিলেন, তখন সঙ্গী করেছিলেন মতিয়াকেই। ঢাকার মেট্রোরেল উদ্বোধনের যাত্রায় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার মাঝে মতিয়ার চৌধুরীর বসা তার গুরুত্বই তুলে ধরেছিল।

একেবারে সাধারণ এক পরিবার থেকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন মতিয়া।

ষাটের দশকে মতিয়া চৌধুরীর রাজপথ কাঁপানো ভূমিকা তাকে এনে দেয় অগ্নিকন্যা খেতাব।

বাম নেত্রী হয়ে উত্থান

মতিয়ার জন্ম ১৯৪২ সালের ৩০ জুন, পিরোজপুরে। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা, মা নুরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী।

ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তির পর ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন মতিয়া। তিনি যোগ দিয়েছিলেন বাম ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নে। ১৯৬১-৬২ সালে ইডেন কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়তা তাকে আন্দোলনের মাঠে পরিচিত করে তোলে।

১৯৬৩-৬৪ সালে ডাকসুর জিএস হন মতিয়া। সেবার ভিপি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নেরই আরেক নেতা্ রাশেদ খান মেনন। রাশিয়া-চীন দ্বন্দ্বে সারাবিশ্বে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে বিভাজনে ছাত্র ইউনিয়নও দুই ভাগ হয় ১৯৬৫ সালে। তাতে এক ভাগের সভাপতি হন মতিয়া; অন্য ভাগের সভাপতি হন মেনন।

ষাটের দশকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের পর্বে মতিয়া চৌধুরী রাজপথে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। রাজপথে তার অগ্নিঝরা বক্তব্য থমকে দিত মানুষকে। তখনই তাকে অগ্নিকন্যা ডাকা শুরু হয়।

১৯৬৭ সালে আইয়ুব খান সরকার গ্রেপ্তার করে মতিয়াকে। আন্দোলন থেকে মেয়েকে সরিয়ে আনতে পুলিশ কর্মকর্তা বাবার উপর ছিল পাকিস্তান সরকারের চাপ। কিন্তু মতিয়া আন্দোলন ছাড়বেন না। তাই বাবার ওপর চাপ কমাতে বিয়ে করেন।

১৯৬৪ সালের ১৮ জুন মতিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় সাংবাদিক বজলুর রহমানের। একই সংগঠনে থাকায় তাদের আগে থেকেই ছিল চেনা-জানা। ২০০৮ সালে মারা যান দৈনিক সংবাদের সম্পাদক বজলুর রহমান। এই দম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান।

এরপর পুরোদমে রাজনীতির মাঠেই ছিলেন তিনি। তখন তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতা। দলটির কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।

ন্যাপের নেতা হিসাবে ১৯৭১ এর উত্তাল মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি ও প্রচারে ছিলেন মতিয়া। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি তিনি ত্রিপুরায় এবং আসামের শরণার্থী শিবিরে কাজ করেন।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) প্রকাশ্য হলে ন্যাপ ছেড়ে সিপিবিতে ফিরে আসেন মতিয়া। পাকিস্তান আমলে এই দলটির অনেকেই অন্য দলে কাজ করতেন।

মতিয়া চৌধুরীর আওয়ামী লীগের যোগদানের খবর ১৯৭৯ সালের ১১ ডিসেম্বর এসেছিল সংবাদের প্রথম পাতায়, পরে যে পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন তার স্বামী বজলুর রহমান।

পথ পাল্টে আওয়ামী লীগে

পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর আবার ন্যাপের হয়ে রাজনীতি করতে থাকেন মতিয়া; ১৯৭৯ সালের ১০ ডিসেম্বর বাম পন্থা ছেড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে।

২০২৩ সালে সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীতে সংসদে বক্তৃতায় নিজেরর দলবদলের সময়ের কথা তুলে ধরেছিলেন মতিয়া।

“যখন আওয়ামী লীগের অফিসে টেলিফোন লাইন, বিদ্যুৎ ছিল না, তখন আমি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছি,” বলেছিলেন তিনি।

মতিয়া জানান, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা উত্থাপনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে, তখন তার দেখা তিনি পেয়েছিলেন নিজেও বন্দি হওয়ার পর।

“৬ দফা দেওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় জেলখানায়। আমি মনে করি, বিধাতার ইচ্ছা, জেলখানায় অনেকেই গেছেন। কলমও নিতে দেয় না। সবকিছু জেল গেটে জমা দিতে হয়। আমি সবকিছু জমা দিচ্ছি, জেলার লিখছে। এই সময় পেছন থেকে একটা আশ্বস্তের হাত। আমি চমকে পেছনে ফিরে তাকাতে দেখলাম বঙ্গবন্ধু। সেই হাত দিয়ে উনি একটা কথাই বললেন- ‘মতিয়া, ভয় পাইয়ো না’।”

তার যোগদান যে আওয়ামী লীগের নেতারাই ভালো চোখে দেখেননি, তাও বলেছিলেন মতিয়া।

তখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা তাতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, “ওই নেতা এসে বললেন- ‘চৌধুরী, এই পার্টিতে জয়েন কইরেন না। এই পার্টি আপনি করতে পারবেন না।’

“ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললাম, ৫টার সময় যোগদানের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি গেছে। এখন বাজে ৩টা ৩৫। তাকে ভাই বলে সম্বোধন করে বললাম, আপনি চিন্তা কইরেন না— আমি আওয়ামী লীগ অফিস ঝাড়ু দেব, কোনোদিন পদ-পদবি চাইব না।”

ঢাকার মেট্রোরেল উদ্বোধনে মতিয়া চৌধুরীকে নিজেদের মাঝে বসিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

আওয়ামী লীগে গিয়েও মতিয়া আওয়ামী লীগের হয়ে উঠতে পারেননি অনেক দিন। তাকে দেখা হতো, ন্যাপের মতিয়া হিসাবে।

কেন তার বিরোধিতা ছিল- তা বোঝা যায় আওয়ামী লীগের এক সময়ের নেতা, বর্তমানে কৃষক, শ্রমিক, জনতা লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর কথায়।

কাদের সিদ্দিকী কিছুকাল আগে বলেছিলেন, “এখন রাত-দিন আওয়ামী লীগে যাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করা হচ্ছে। কিন্তু, আমি কীভাবে আওয়ামী লীগে যাব? যে মতিয়া চৌধুরী আমার নেতার (বঙ্গবন্ধু) চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিল, তার পাশাপাশি বসে রাজনীতি করব? আমার পক্ষে তা সম্ভব না।”

স্বাধীনতার পর ন্যাপ নেতা হিসাবে মতিয়া চৌধুরীর ভূমিকাই তার প্রতি আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরাগের বড় কারণ ছিল।

সেই প্রতিবন্ধকতা ঠেলে কীভাবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এলেন, সংসদে ভাষণে তাও বলে গিয়েছিলেন মতিয়া।

“যখন ৮১টা সম্মেলন (বিভিন্ন শাখার সম্মেলন) হলো, আমি ৭৯টায় যোগদান করেছিলাম। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দুই বছর পার হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার অবর্তমানে যখন কমিটি হলো, আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পর্যন্ত রাখা হয়নি।

“১৯৮৬ সালে যখন সম্মেলন হলো, তখন আমি শেখ হাসিনার হাত ধরে কৃষি সম্পাদক হই। উনি কৃষি সম্পাদক হিসেবে যে মর্যাদা দিয়েছিলেন, সরকার গঠন হলে কৃষির জন্য সুবিধা আমি জনগণের জন্য বিলিয়ে দিয়েছি।”

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম সরকার গঠনের পর মন্ত্রী করেছিলেন মতিয়াকে; দিয়েছিলেন কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত রাজপথে আওয়ামী লীগের আন্দোলন চাঙা রেখেছিলেন মতিয়া।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় অনেক রাজনীতিক, মন্ত্রী, এমপির গায়ে দুর্নীতির কালি লাগলেও মতিয়ার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আসেনি।

শেখ হাসিনার সরকারে তিন বার মন্ত্রী ছিলেন মতিয়া চৌধুরী।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আবার কৃষিমন্ত্রী হন মতিয়া। ২০১৪ সালের সরকারেও মন্ত্রী ছিলেন। তবে ২০১৮ সালের সরকারে বাদ পড়লেও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে থাকেন তিনি।

সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুর পর ২০২৩ সালে একাদশ জাতীয় সংসদের উপনেতা করা হয় মতিয়াকে। এবছর দ্বাদশ জাতীয় সংসদেও উপনেতা নির্বাচিত হন তিনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সংসদ বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত সেই পদেই ছিলেন তিনি।

মতিয়া চৌধুরী তার স্বামী বজলুর রহমানের এলাকা শেরপুর (নকলা-নালিতাবাড়ী) থেকে ১৯৯১ সাল থেকে ছয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন থেকে যে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে, সেই আন্দোলনের সূচনাকারীদের আক্রমণ করে ২০১৮ সালে সংসদে বক্তব্যের জন্য সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিল মতিয়াকে।

আবার ব্যক্তি মতিয়াকে নিয়ে সমালোচনা না থাকলেও আওয়ামী লীগের গণবিরোধী নানা পদক্ষেপের বিরোধিতা না করার জন্য মতিয়ার সমালোচনা করেন অন্য দলগুলোর নেতারা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত