ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা যাকে এনে দিয়েছিল অগ্নিকন্যা খ্যাতি, একাত্তরে দেশের স্বাধীনতার জন্য যিনি রেখেছিলেন ভূমিকা, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সেই মতিয়া চৌধুরীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ছাড়াই বিদায় নিতে হলো।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সাবেক সংসদ উপনেতা ও মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ৮২ বছর বয়সে বুধবার মারা যান। বৃহস্পতিবার তাকে সমাহিত করা হয় ঢাকার মিরপুরে শহীদ বৃদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
প্রথা ও সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দাফনের আগে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর কথা থাকলেও মতিয়া চৌধুরীর বেলায় তা হয়নি।
গার্ড অব অনার বা রাষ্ট্রীয় সম্মান যারা দেন, সেই পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের কাছে প্রশাসনের কোনও নির্দেশনা আসেনি।
যাদের আয়োজনে সম্মান জানানো হয়, সেই জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, এবিষয়ে তাদের কেউ জানায়নি।
যাদের উদ্যোগ নেওয়ার কথা, সেই মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে যোগাযোগের ঘাটতি থেকে গেছে।
ষাটের দশকে বাম আন্দোলনের কর্মী ছিলেন মতিয়া চৌধূরী; ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন তিনি, ছিলেন ডাকসুর জিএস।
এরপর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) নেতা হিসাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। একাত্তরে ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা দলের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের নয় মাস তিনি ত্রিপুরায় এবং আসামের শরণার্থী শিবিরে কাজ করেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন মতিয়া। ১৯৯১ সালে প্রথম দলটির হয়ে সংসদ সদস্য হন। সব মিলিয়ে ছয়বার সংসদ সদস্য হন তিনি। শেখ হাসিনার সরকারে তিন বার মন্ত্রীও ছিলেন তিনি।
সর্বশেষ ২০২৩ সালে সংসদ উপনেতা হন তিনি; এই বছরের ৭ জানুয়ারিতে নির্বাচনের পর গঠিত সংসদেও একই পদে নির্বাচিত হন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সংসদ বিলুপ্ত হলে সংসদ উপনেতা হিসাবে তার দায়িত্বের অবসান ঘটে। এরপর অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার তার মৃত্যু হয়।
রাষ্ট্রীয় সম্মান যেভাবে জানানো হয়
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধারা চিরবিদায়কালে পান রাষ্ট্রীয় সম্মান। এজন্য সরকারের নির্দেশনাও রয়েছে।
২০২০ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের আদেশ হয়, সেখানে এই প্রক্রিয়া সবিস্তারে লেখা ছিল।
সেখানে বলা আছে, কোনও বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর খবর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল, জেলা কমান্ড কিংবা উপজেলা কমান্ড প্রশাসনকে জানাবে।
মুক্তিযোদ্ধার পরিবারও খবরটি প্রশাসনকে জানাতে পারে। আবার সংবাদমাধ্যমে খবর দেখে প্রশাসনও উদ্যোগ নিতে পারে।
এরপর জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর উদ্যোগ নেবে।
লাশ দাফনের আগে বীর মুক্তিযোদ্ধার কফিন জাতীয় পতাকায় আবৃত করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ফুল দেবে ডিসি, ইউএনও কিংবা সহকারী কমিশনার (ভূমি)। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া হবে গার্ড অব অনার।
মতিয়া চৌধুরী কিছুই পাননি
আটপৌরে জীবন কাটানো মতিয়া চৌধুরীর চিরবিদায়ের আয়োজন ছিল অত্যন্ত সাদামাটা।
বৃহস্পতিবার সকালে তার লাশ রমনায় তার বাসায় নেওয়া হলে সেখানে স্বজনরা শেষ বিদায় জানায় তাকে।
সেখানে জানাজার আগে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের নেতাদের অধিকাংশই কারাগারে কিংবা পালিয়ে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিল না সেখানে।
এরপর দুপুরে গুলশানের আজাদ মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে স্বামী বজলুর রহমানের কবরে শয়িত করা হয় মতিয়াকে।
মতিয়া চৌধুরীর ভাই মাসুদুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, তার বোন তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেও ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া যায়নি। প্রথমে প্রশাসনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল, কিন্তু পরে কেউ আসেনি।
কেন হলো না, কে কী বলছেন
মতিয়া চৌধুরীর দ্বিতীয় জানাজা হয়েছিল গুলশানের আজাদ মসজিদে। সেটা গুলশান থানার অন্তর্ভুক্ত এলাকা।
গার্ড অব অনার না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে গুলশান থানার ওসি তৌহিদ আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।”
মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানটি যে থানা এলাকায় সেই দারুস সালামের ওসি রকিবুল হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের এবিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
“জানাজাসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষ করে আমাদের এখানে শুধু দাফন করা হয়েছে। সাধারণত যেখানে জানাজা পড়ানো হয়, সেখানেই গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।”
সকাল সন্ধ্যা যোগাযোগ করলে ঢাকা জেলা প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ আল রনী বলেন, “কোনও মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানানো হয়। তারা আমাদের জানালে আমরা মৃত মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার ব্যবস্থা করে থাকি।
“মতিয়া চৌধুরীর বিষয়ে আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।”
তবে ঢাকা জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মতিয়া চৌধুরীর মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু মতিয়া চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা হলেও তার কোনও সার্টিফিকেট নেই বলে শুনেছি। একারণে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়নি।”
মতিয়া চৌধুরী একাত্তরে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা দলের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে এই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছিল, সেখানে পিরোজপুর জেলার ১২ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে মতিয়া চৌধুরীর নাম।
তার নির্বাচনী এলাকা শেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদদের সাবেক কমান্ডার আ স ম নুরুল ইসলাম হিরো সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মতিয়া চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন, এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।
“তিনি একজন তালিকভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। আমার জানামতে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেতেন, যেটার পুরোটাই তিনি দান করে দিতেন।”
নুরুল ইসলাম বলেন, মতিয়া চৌধুরীর মৃত্যুর পর শেরপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু জানাজা ও দাফন ঢাকায় হয়েছে বলে তিনি ভেবেছিলেন যে ঢাকায়ই এই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খাজা আমিনুল ইসলাম আমিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মতিয়া চৌধুরীর বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি।”
তিনি জানান, দেশের কোথাও কোনও মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হলে তাদের কাছে খবর আসে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা বা মৃতের পরিবারের সদস্যরা যোগাযোগ করে। অনেক সময় স্থানীয় থানা থেকেও জানানো হয়। খবর পেলে তারা মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেওয়ার ব্যবস্থা নেন।
“কিন্তু এখানে (মতিয়া চৌধুরী গার্ড অব অনার না পাওয়া) আমার মনে হয় কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে এমনটা ঘটেছে। অন্য কিছু নয়,” বলেন আমিন।
আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন জনরোষে রয়েছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের এই বিজয়কে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা। তার মধ্যে যথাযথ সম্মান না পেয়েই চিরবিদায় নিলেন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সেনানী মতিয়া চৌধুরী।