ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরে ভর্তি বাতিল হওয়া ১৬৯ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও ভিকারুননিসার ভুলের খেসারত দিচ্ছে বলে মনে করছেন অভিভাবকরা। শিশুদের মানসিক দিক বিবেচনা করে ভর্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছেন তারা।
শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নসরুল হামিদ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলন করেন অভিভাবকরা। সেখানে তারা বলেন, মাউশি এবং ভিকারুননিসা স্কুল কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতার কারণে দেড় শতাধিক শিশু শাস্তি পাচ্ছে।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মাউশিকে দেওয়া আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। মাউশির নির্দেশনায় বলা হয়, এই শিশুদের ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা অনুসরণ করা হয়নি।
গত ১ জানুয়ারি এক অভিভাবকের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে এসব শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পরে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে অভিভাবকরা।
সংবাদ সম্মেলনে অভিভাবকরা দাবি করেন, তারা মাউশির নিয়ম মেনেই সন্তানদের ভর্তি করেছেন। তিন মাস ক্লাস করার পর ভর্তি বাতিল করে দেওয়ায় এখন এসব শিশুদের ভবিষ্যত হুমকির মুখে। মাউশির বিজ্ঞপ্তিতে প্রথম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য নির্ধারিত বয়সসীমা ছয় প্লাস হওয়ার কথা ছিল। অনলাইন আবেদনের সময় ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা টেলিটকের সার্ভারে জন্মতারিখ, শ্রেণি ও এলাকার তথ্য দিলে ভিকারুননিসার নামও আসে। নিয়ম অনুযায়ী আবেদন ফি পরিশোধ করে তারা ভিকারুননিসাসহ পাঁচটি স্কুল সিলেক্ট করে আবেদন ফর্ম পূরণ করেন। পরে লটারির মাধ্যমে ভিকারুননিসায় ভর্তির সুযোগ পায় তাদের সন্তানরা।
সাগর শাহ আলম নামে এক অভিভাবক বলেন, “মাউশি ও ভিকারুননিসা স্কুলের ভুলের খেসারত দিচ্ছে আমাদের কোমলমতি শিশুরা। অথচ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলা হচ্ছে আমরা অবৈধভাবে শিশুদের স্কুলে ভর্তি করেছি। এটা কোনওভাবেই মানতে পারছি না।”
ইঞ্জিনিয়ার আরিফ হোসাইন নামে আরেক অভিভাবক বলেন, “অনলাইন আবেদনে ৫টি স্কুল পছন্দ করার সুযোগ পাই। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট দেখা সম্ভব না। এমনকি মাউশির সার্কুলারেও এ সংক্রান্ত কোনও আদেশ ছিল না। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে জন্মগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা যদি দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারে তবে এই ১৬৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য কেন ভিন্নতা হবে?”
অভিভাবক ডা. মনতাজুর রায়হান বলেন, “১৬৯ অভাগা অভিভাবককের ১ জন আমি। বছরের এই পর্যায়ে এসে অন্য স্কুল বেছে নেওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছি আমরা, সামাজিকভাবেও হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছি। সবাই ভাবছে আমরা অবৈধ উপায়ে সন্তানদের ভর্তি করেছি। অনেকে বলছে আমরা টাকা দিয়ে সন্তান ভর্তি করেছি। এই কথাটা আমাদের গায়ে লাগছে। সবাই অভিভাবকদের দোষ দিচ্ছে, কিন্তু আমাদের দোষটা কোথায়! একইসঙ্গে আমাদের সন্তানরাও বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে।
“বিষয়টা ঘটেছে মাউশি ও ভিকারুননিসার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে, আর শাস্তি দেওয়া হচ্ছে শিশুদের। সবকিছু নিয়মতান্ত্রিকভাবে করার পরও যখন বলা হচ্ছে আমার দোষী, সেটা মেনে নেওয়া কষ্টকর।”
সুমি নামে আরেক অভিভাবক বলেন, “মাউশি ও ভিকারুননিসা স্কুলের সমন্বয়হীনতার কারণে ১৬৯ কোমলমতি শিশুর ভর্তি বাতিল করে সারা জীবনের জন্য ট্রমাটাইজ(মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত) করে ফেলা হচ্ছে। প্রিয় স্কুল হয়ে যাচ্ছে এক দুঃস্বপ্ন, বিষাদ এবং আতঙ্কের নাম। কোন অপরাধে কচি প্রাণে এত বড় আঘাত করা হচ্ছে? তারা কি সইতে পারবে এই নির্মম আঘাত?”
কীভাবে হলো এমন ভুল?
জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়স ৬+ বছরের কথা বলা আছে। এটা ভর্তির নিম্নসীমা। এর ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করতে পারে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ভিকারুননিসা নূন স্কুল কর্তৃপক্ষ বয়সসীমা উল্লেখ করেই ভর্তিবিজ্ঞপ্তি দেয়, যাদের জন্ম ১ জানুয়ারি ২০১৭ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে। তবে সব স্কুলের আবেদন লটারির মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ হয় এক সফটওয়্যারে। সেখানে ভিকারুননিসা স্কুলের বয়সের শর্তটা সঠিকভাবে একীভূত করা ছিল না। একারণে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে জন্ম এমন অনেক শিক্ষার্থী আবেদন করে বসে। এর মধ্যে ১৬৯ শিক্ষার্থী তালিকায় প্রথম দিকে থাকায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়।
অভিভাবকদের দাবি, নিজেদের স্কুলের ভর্তির বয়সসীমা মানা হয়েছে কিনা তা দেখার পুরো কর্তৃত্ব ছিল ভিকারুননিসা স্কুল কর্তৃপক্ষের। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করলে এই শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা সন্তানকে ভর্তি না করিয়ে প্রথম দিনই ফেরত আসতো। স্কুল কর্তৃপক্ষ তা করেনি। এই শিশুদের যেহেতু এক থেকে দুই বছর আগেই ৬+ বয়স হয়েছে, সেহেতু তারা আরও আগেই কোনও না কোনও স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ ছিল। কেউ হয়তো সেই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তো এ বছর। তা ছেড়েও তারা প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয় ভিকারুননিসায়। এই ভর্তি যদি বৈধ না হবে তাহলে সফটওয়ারে ভর্তির আবেদন কেন নিল? জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির বয়স তো ৬+ বছর। অর্থাৎ গলদটা এখানেই।
অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, অভিভাবকরা কিছু বুঝতো না, তা নয়। তারা একটি সিস্টেমের ঘাটতির সুযোগ নিয়েছে। আদালত মাউশি ও ভিকারুননিসা স্কুল কর্তৃপক্ষকে যে নির্দেশনা দিয়েছে তা পালন করে এই ১৬৯ শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিল করা হয়েছে।
ফেরত দেওয়া হবে ভর্তি ফি ও বেতন
তরিকুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে সন্তানকে স্কুলে ভর্তির সময় ফরম, ভর্তি ফি, উন্নয়ন চার্জ, লাইব্রেরি ফি, আইডি কার্ডসহ সব মিলিয়ে ৮০০০ টাকা করে দিতে হয়েছে। এরপর গত জানুয়ারিতে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, ডায়েরি, সফটওয়্যার ফি ও টিউশন ফিসহ সব মিলিয়ে ২০০০ টাকা পরিশোধ করেছি। সব শেষে চলতি মাসে ফেব্রুয়ারি ও মার্চের টিউশন ফিসহ সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৭৭৬ টাকা জমা দিয়েছি। তবে গত ৪ মার্চ ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরীর এক চিঠিতে বলা হয়েছে, ভর্তি বাতিলকৃত ১৬৯ জন শিক্ষার্থীর ভর্তি ফি ও প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত্ব সকল অর্থ যথানিয়মে ফেরত দেওয়া হবে।
এ বিষয়ে কেকা রায় চৌধুরীর সঙ্গে ফোনে, হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে শিশুদের মনে
এ ধরনের পরিস্থিতি ওই শিশুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন আহ্মেদ। তিনি বলেন, “এই ঘটনা শিশুদের মনে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব ফেলবে। স্বল্পমেয়াদী প্রভাবে তাদের রাগ, ক্ষোভ বেড়ে যেতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবে সমাজের সিস্টেমের প্রতি বিশ্বাস কমে যেতে পারে। এছাড়া এই ঘটনা শিশুদের ব্যক্তিত্ব ও আচরণগত সমস্যারও সৃষ্টি করবে। ওই শিশুরা মনে করতে পারে সিস্টেম তাদের বিপক্ষে কাজ করেছে। তখন তারা সামাজিক সিস্টেমের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে।”
সব শিশুর না হলেও বেশিরভাগ শিশুই এতে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যেহেতু এই ঘটনার জন্য কোমলমতি শিশুদের কোনও দায় নেই, তাই ভিকারুননিসা ও মাউশিকে দায়িত্ব নিয়ে এই শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করা উচিত।”