একটা সময় নেইমারকে নিয়ে গরম থাকতো দলবদলের মৌসুম। ব্রাজিলিয়ান তারকাকে নিয়ে গুঞ্জন লেগেই থাকতো। তারই একসময়কার সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপ্পে এখন জায়গাটা নিয়েছেন। তিন বছর ধরে তার রিয়াল মাদ্রিদে যাওয়ার আলোচনা। এবার তো গ্রীষ্মের দলবদলের জানালা খোলার অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে নানা গুঞ্জন। তার সম্ভাব্য গন্তব্য- সেই রিয়াল মাদ্রিদ!
মাদ্রিদের ক্লাবটি খুব করে চায় এমবাপ্পেকে। এমবাপ্পেও যেতে চায় সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। স্প্যানিশ ক্লাবটি তার ‘স্বপ্নের দল’। দুই পক্ষই যখন রাজি, তখন সমস্যা কোথায়? সমস্যাটা পিএসজির। স্বাভাবিকভাবেই সময়ের সেরা খেলোয়াড়কে তারা ছাড়তে চাইবে না। আবার অন্যদিক থেকে দেখলে, এমবাপ্পের পার্ক ডু প্রিন্সেস ছেড়ে যাওয়াটা তাদের অহংয়ে আঘাত লাগার মতো ব্যাপার। যে কারণে রিয়াল ও এমবাপ্পের চাওয়া একসুতোয় বাঁধা হচ্ছে না।
এমবাপ্পের সর্বশেষ অবস্থা
দলবদলের মৌসুমে সব কিছুতেই থাকে ‘যদি-কিন্তু’। এমবাপ্পের রিয়াল-যাত্রা নিয়েও সেটি আছে। সবই এখনও গুজব। কারণ রিয়াল মাদ্রিদ, পিএসজি কিংবা এমবাপ্পে- তিন পক্ষই নীরব। বলার অপেক্ষা রাখে না পিএসজি তাদের সেরা খেলোয়াড়কে ধরে রাখতে সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করবে। সেটি করছেও। ফরাসি সংবাদমাধ্যম আরএমসি’র খবর, এমবাপ্পের জন্য বিশাল অঙ্কের প্রস্তাব দিয়েছে প্যারিসের ক্লাবটি। তিন বছরের নতুন চুক্তিতে বছরে তিনি পাবেন ১০০ মিলিয়ন ইউরো। এমবাপ্পে এই প্রস্তাবে রাজি হবেন কিনা, সেটা সময়ই বলবে।
যদিও ২০২২ সালে রিয়ালে প্রায় পা দিয়েই ফেলেছিলেন এমবাপ্পে। অনেক নাটকীয়তার পর ফরাসি ফরোয়ার্ড প্যারিসেই থেকে যান। চুক্তি করেন ২০২৫ সাল পর্যন্ত। তবে এই চুক্তিতে আছে একটি শর্ত। এমবাপ্পে দুই বছরের স্থায়ী চুক্তিতে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত পিএসজিতে থাকবেন, পরে চুক্তি আরও এক বছর বর্ধিত হবে যদি এমবাপ্পে চান। অর্থাৎ, এমবাপ্পে চাইলেই কেবল ২০২৫ সাল পর্যন্ত গড়াবে চুক্তির মেয়াদ।
কিন্তু বিশ্বকাপজয়ী তারকা সেটি চাইছেন না। তিনি দুই বছরের চুক্তি শেষ করে ছাড়তে চান পার্ক ডু প্রিন্সেস। পিএসজির সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চাইলে অন্য ক্লাবের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন এমবাপ্পে। সেই ‘শর্ত’ মেনেই নাকি রিয়ালের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন এমবাপ্পে। কিন্তু পিএসজি তাকে যেতে দিতে রাজি নয়।
সেসব একপাশে ঠেলে ধরেই নেওয়া হলো, এমবাপ্পে যাচ্ছেন রিয়াল মাদ্রিদে। তাহলে তার এই যাত্রা সত্যিই কি স্বস্তির? নাকি নিজের সঙ্গে সমস্যা তৈরি করতে যাচ্ছে রিয়াল ক্যাম্পে?
অতীত ইতিহাস কী বলছে
এমবাপ্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তিও ভীষণ পছন্দ করেন ফরাসি ফরোয়ার্ডকে। অর্থাৎ, সান্তিয়াগো বার্নাব্যু যাত্রায় রিয়াল তাকে দুই হাত বাড়িয়ে বরণ করে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু রিয়ালের বর্তমান দলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন তো এমবাপ্পে?
বার্সেলোনায় একসঙ্গে খেলেছেন লিওনেল মেসি, লুইস সুয়ারেস ও নেইমার। প্রত্যেকেই নিজেদের জায়গায় সেরা। এই ত্রয়ী একসঙ্গে খেলতে পারবেন কিনা, সেই শঙ্কা জন্মেছিল অনেকের মাঝে। বার্সেলোনার কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ তো বলেই দিয়েছিলেন, “নেইমার যখন বার্সেলোনায় এসে গেছে, তখন মেসিকে বিক্রি করে দেওয়া হোক।”
তবে সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে ‘এমএসএন’ ত্রয়ী রচনা করে বিশ্বের সেরা আক্রমণভাগ। মাঠে গোলের পর গোল করলেন, আর মাঠের বাইরে দেখা মিলল তাদের দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বোঝা গেল, চাইলেই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের একদলে রেখে সাফল্য পাওয়া সম্ভব। ইগো, গুরুত্বের মাপকাঠি কিংবা অর্থের পার্থক্য- কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
আবার বাধা হয়ে দাঁড়ায়-ও। তার বড় উদাহরণ পিএসজি। এই ফরাসি ক্লাবে শুধু পাল্টে গেল সুয়ারেসের জায়গাটা। মেসি ও নেইমারের সঙ্গে যুক্ত হলেন এমবাপ্পে। ‘এমএসএন’-এর মতো তারাও সাফল্যের ফুল ফোটাবেন পিএসজিতে- এই ছিল প্রত্যাশা। কিন্তু ঘটল পুরো উল্টো। ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, ইগো ও গুরুত্বের মাপকাঠি এখানে সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এমনও শোনা যায়, মেসি পিএসজিতে যোগ দেওয়ার পরপরই ফরাসি ক্লাব ছাড়তে চেয়েছিলেন এমবাপ্পে।
মাঠের ভেতরও মেসি ও নেইমারের সঙ্গে সখ্যতা ছিল না এমবাপ্পের। পিএসজির মেসিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা দেখে চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন এই ফরোয়ার্ড। পরে ড্রেসিংরুমে কর্তৃত্ব হাতে পাবেন, এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই নাকি নতুন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন এমবাপ্পে।
২০২২ সালে হওয়া এমবাপ্পের ওই চুক্তি এখনও চলছে। এর মাঝেই নতুন করে উঠেছে তার রিয়াল-যাত্রার গুঞ্জন। তারকা ফুটবলারদের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা তার খুব একটা সুখকর নয়। রিয়ালে গেলে সতীর্থ হিসেবে পাবেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রোদ্রিগো ও জুড বেলিংহামের মতো খেলোয়াড়দের। যারা এরইমধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। এই তারকাদের সঙ্গে মানিয়ে এমবাপ্পে কতটা খেলতে পারেন, অতীত ইতিহাসে চোখ রেখে সেই প্রশ্ন তুলতেই পারেন!
এমবাপ্পে ও বেলিংহাম- কে কার সমস্যা
বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে রিয়াল মাদ্রিদে এসেছিলেন মিডফিল্ডার হিসেবে। অথচ লা লিগার সব ফরোয়ার্ডকে পেছনে ফেলছেন বেলিংহাম! চলতি লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনিই। কোচ আনচেলত্তি ইংলিশ মিডফিল্ডারের জন্য তার ফরমেশন পাল্টে ফেলেছেন। বেলিংহামের সেরাটা বের করে আনতে খেলাচ্ছেন ৪-৪-২ ডায়মন্ড ফরমেশনে। এই ফরমেশনে তার সেরাটা পাচ্ছেও রিয়াল।
মাদ্রিদের ক্লাবটির সমর্থকদের কাছে তিনি নতুন ‘ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো’। তার গোলে গ্যালারিতে উঠছে আনন্দের নৃত্য। এককথায় রিয়ালের প্রাণভোমরা এখন বেলিংহাম। কোচ ও ক্লাব কর্মকর্তারা দারুণ খুশি এই ইংলিশম্যানের পারফরম্যান্সে। ইতিমধ্যেই তিনি হয়ে গেছেন রিয়ালের বড় তারকা। সেখানে এমবাপ্পের প্রবেশকে ‘অনুপ্রবেশ’র মতোই মনে হতে পারে তার জন্য।
আবার অন্যরকমও হতে পারে। এমবাপ্পে এলেই যে বেলিংহামের কদর কমে যাবে, এমনটা ভাবারও সুযোগ নেই। দেখা গেল, বেলিংহাম তার জায়গা ঠিকই ধরে রাখলেন। উল্টো নতুন ক্লাবে এসে হা-হুতাশ করে যাচ্ছেন এমবাপ্পে।
কারণ এই ফরাসি তারকা স্পেনের ক্লাবে এসে কেন্দ্রীয় চরিত্রেই থাকতে চাইবেন। সেটা না হলেই ইগোর দ্বন্দ্ব চলে আসবে সামনে। ড্রেসিংরুম উত্তপ্ত হবে নিশ্চিত। যার প্রভাব গোটা দলের ওপরই পড়বে। রিয়াল কর্তৃপক্ষও নিশ্চয় ভাবছে এ নিয়ে।
পরিবর্তন আসবে রিয়ালের ফরমেশনে
আর একটা বিষয় নিশ্চিত- এমবাপ্পে রিয়ালে এলে বদলে যাবে রিয়ালের ফরমেশন। এখন বেলিংহামকে স্বাধীনতা দিয়ে ডায়মন্ড ফরমেশনে খেলাচ্ছেন আনচেলত্তি। ইতালিয়ান কোচ বেলিংহামকে স্ট্রাইকার হিসেবেও ব্যবহার করছেন না, আবার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকাতেও রাখছেন না। আনচেলত্তির বর্ণনায় বেলিংহাম হলেন ‘ফলস নাম্বার নাইন’।
এমবাপ্পে এলে বেলিংহামের পজিশন কী হবে? ইংলিশ তারকা কি তখন ‘নাম্বার নাইন’-এর ভূমিকায় খেলবেন? আনচেলত্তি চাইলে তাকে এই পজিশনে খেলাতে পারেন। কারণ বেলিংহাম গোল করতে পারদর্শী এবং বক্সের ভেতরে দারুণ।
বেলিংহামের সমস্যার না হয় সমধান হলো। ভিনিসিয়ুসের তখন কী হবে? এমবাপ্পে লেফট উইং ধরে খেলে বক্সে ঢোকার চেষ্টা করেন। রিয়ালে এখন যেটি করে থাকেন ভিনি। এমবাপ্পে এলে তাকে ছেড়ে দিতে হবে এই পজিশন। তখন পাশ বদলে রাইট উইংয়ে যেতে হবে ব্রাজিলিয়ান তারকাকে। যেখানে মোটেও স্বাচ্ছদ্যবোধ করেন না তিনি।
তারপরও ধরে নেওয়া হলো, এমবাপ্পে লেফটে, মিডলে বেলিংহাম ও রাইটে ভিনিসিয়ুস। তাহলে রোদ্রিগোর জায়গা কোথায়? দারুণ মৌসুম পার করা এই ব্রাজিলিয়ান কি একাদশে জায়গা হারাবেন? আনচেলত্তি জানিয়েছেন, তিনি তার দলের সেরা ১১ জনকে সবসময় মাঠে দেখতে চান। রোদ্রিগোর যে পারফরম্যান্স, তাতে এই ফরোয়ার্ডকে বেঞ্চে রাখা সহজ হওয়ার কথা নয় ইতালিয়ান কোচের।
তাহলে কি এমবাপ্পে ‘নাম্বার নাইন’?
বেলিংহামের সবচেয়ে বড় গুণ হলো, তিনি সব পজিশনে খেলতে পারদর্শী। শৈশবের ক্লাব বার্মিংহাম সিটিতে নাম্বার ফোর, নাম্বার এইট, নাম্বার টেন-এর ভূমিকায় খেলেছেন। ২০ বছর বয়সী তরুণ ছোট্ট ক্যারিয়ারে প্রমাণ করেছেন কতটা দ্রুত সব পজিশন মানিয়ে নিতে পারেন। অর্থাৎ, রিয়ালের মাঝমাঠেও আলো ছড়ানোর উপাদান আছে তার মাঝে।
তাহলে তাকে আক্রমণভাগের বাইরে রেখেই কল্পনা করা যাক। সেক্ষেত্রে একাদশে ঢুকে পড়েন রোদ্রিগো। আনচেলত্তি চাইলে ব্যাপারটি আরও মসৃণ করতে পারেন এমবাপ্পেকে ‘নাম্বার নাইন’ করলে। তখন ভিনিসিয়ুস তার প্রিয় লেফট উইংয়ে খেলতে পারবেন। রাইট উইংয়ে রোদ্রিগো। আর মাঝে এমবাপ্পে।
কিন্তু এমবাপ্পে ‘নাম্বার নাইন’ পজিশনে খেলবে কিনা, তাতে সন্দেহ যথেষ্ট। কারণ পিএসজিতে এই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ২০২২ সালের অক্টোবরে তখনকার পিএসজি কোচ ক্রিস্তোফে গালতিয়ের ‘টিপিক্যাল স্ট্রাইকিং’ পজিশনে খেলেছিলেন এমবাপ্পেকে। এই ভূমিকা যে ফরাসি ফরোয়ার্ডের পছন্দ হয়নি, সেটি বোঝা গিয়েছিল গালতিয়েরকে ইঙ্গিত করে দেওয়া তার ইনস্টাগ্রাম পোস্টে।
সমাধান কী
ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো চলে যাওয়ার পর রিয়ালের হাল ধরেছিলেন করিম বেনজেমা। ফরাসি স্ট্রাইকার বার্নাব্যু ছাড়ার পর চলছে বেলিংহাম-জাদু। পার্শ্বচরিত্রে থেকে সাফল্যের পথ তৈরি করছেন ভিনিসিয়ুস-রোদ্রিগোরা। লা লিগায় এখন শীর্ষে তারা। চ্যাম্পিয়নস লিগে উঠেছে শেষ ষোলোতে। বেলিংহাম, রোদ্রিগো ও ভিনিসিয়ুসের সম্পর্কও দারুণ। মিলেমিশে প্রত্যাশা অনুযায়ীই চলছে রিয়ালের গাড়ি।
এই দৃশ্যপটে এমবাপ্পের ঢুকে পড়াটা কতটা স্বস্তির, সেটি নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই। তবে জটিল সব পরিস্থিতি যে তৈরি হতে পারে, সেই আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
কল্পনার জগতে রিয়ালকে রেখে ‘যদি-কিন্তু’-তে একটা ছবি বানানো আর কী। যেমনটা ‘যদি-কিন্তু’র মধ্যে আটকে আছে এমবাপ্পের ভবিষ্যৎ!