কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির কারণে গত ৭ জুলাই রবিবার থেকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সব সড়কেই যানজট হচ্ছে। এই চিত্র দুপুরের পর আরও ভয়ানক আকার ধারণ করছে। অনেকটা নিশ্চল হয়ে পড়ছে বিভিন্ন সড়ক। কোনও কোনও সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও গণপরিবহন পাওয়া যাচ্ছে না। পেলেও সেই গণপরিবহন আবার যানজটে আটকে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই বিকল্প বাহন হিসেবে হিসেবে বেছে নিচ্ছেন মেট্রোরেল।
মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বলছে, স্বাভাবিক সময়ে রাজধানীর মতিঝিলে থেকে উত্তরায় মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোতে গড়ে প্রতিদিন তিন লাখ যাত্রী চলাচল করে। গত ৭ জুলাই রবিবার থেকে গতকাল ১০ জুলাই বুধবার পর্যন্ত গড়ে সেই সংখ্যা তিন লাখ ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। যাত্রীদের চাপে স্টেশনের প্রবশপথ বন্ধও রাখতে হয়েছে।
ডিএমটিসিএলের তথ্য অনুযায়ী, ৭ জুলাই থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত এই চারদিনে মেট্রোরেলে মোট ১৪ লাখ ১২ হাজার যাত্রী চলাচল করেছে। এর মধ্যে ৭ জুলাই রবিবার সবচেয়ে বেশি যাত্রী ছিল। এদিন মেট্রোরেলে মোট যাত্রী ছিল তিন লাখ ৬৫ হাজার। পরদিন ৮ জুলাই সোমবার মেট্রোরেলে চলাচল করেছে তিন লাখ ৫২ হাজার যাত্রী। ৯ জুলাই মঙ্গলবার যাত্রী সংখ্যা কিছুটা কম ছিল। এদিন মেট্রোরেলে মোট যাত্রী ছিল তিন লাখ ৩৩ হাজার। ১০ জুলাই বুধবার এই সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ৬২ হাজার।
ডিএমটিসিএলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে জানান, ৭ জুলাই থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির চাপ মেট্রোরেলের ওপর পড়ছে। যানবাহন আটকে থাকায় মানুষ মেট্রোরেলকে বেছে নিচ্ছে। এই সপ্তাহে দুপুরের পর থেকে যাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিকাল থেকে সন্ধ্যায় যাত্রী এত বেড়ে যায় যে, স্টেশনগুলোর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোর মতো জায়গাও থাকে না। বাধ্য হয়ে স্টেশনেরে প্রবেশপথ বন্ধও রাখতে হয়।
তিনি বলেন, “বাস স্টপেজ হলে না হয় যাত্রীরা লাইন ধরে শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দাঁড়াতেন। কিন্তু মেট্রোরেলের স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের নির্দিষ্ট আয়তন আছে। এর বাইরে তো যাত্রীদের জায়গা দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই স্টেশনগুলোর প্রবেশপথ বাধ্য হয়ে বন্ধ রাখতে হয়েছে। ট্রেন আসার পর যাত্রী কমে গেলে পর্যায়ক্রমে যাত্রীদের স্টেশনের ভেতরে যেতে দেওয়া হয়েছে।’
ওই কর্মকর্তা জানান, ভিড়ের সময় স্টেশন ও আশপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। এজন্য পুলিশসহ মেট্রোরেলের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী, আনসার সদস্যরা সার্বক্ষণিক টহল দিচ্ছে। পাশাপাশি মেট্রোরেলের সব প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিকালের পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে কাজ করছেন।
ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ জানায়, এখন শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে ছয়দিন নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলাচল করে মেট্রোরেল। প্রতিদিন মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১৯৬ বার চলাচল করছে মেট্রোরেল। এর মধ্যে উত্তরা থেকে সকাল ৭টা ১০ মিনিট থেকে সকাল ৭টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত এবং মতিঝিল থেকে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত স্পেশাল অফপিক আওয়ারে ১০ মিনিট পরপর একটি করে ট্রেন চলছে।
উত্তরা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সকাল ১১টা ৩৬ মিনিটে পিক আওয়ারে ৮ মিনিট পরপর ট্রেন আসে। মতিঝিল থেকে এই পিক আওয়ার থাকে সকাল ৮টা ০১ মিনিট থেকে বেলা ১২টা ০৮ মিনিট পর্যন্ত।
উত্তরা থেকে সকাল ১১টা ৩৭ মিনিট থেকে দুপুর ২টা ২৪ মিনিট পর্যন্ত এবং মতিঝিল থেকে বেলা ১২টা ০৯ মিনিট থেকে দুপুর ৩টা ০৪ মিনিট পর্যন্ত মেট্রোরেলের অফপিক আওয়ার। এ সময় প্রতি ১২মিনিট পর পর একেকটি ট্রেন স্টেশনে আসে।
উত্তরা থেকে দুপুর ২টা ২৫ মিনিট থেকে রাত ৮টা ৩২ মিনিট পর্যন্ত এবং মতিঝিল থেকে দুপুর ৩টা ০৫ মিনিট থেকে রাত ৯টা ১২ মিনিট পর্যন্ত আবার শুরু হয় পিক আওয়ার।
এরপর মতিঝিল থেকে রাত ৮টা ৩৩ মিনিট থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এবং উত্তরা থেকে রাত ৯টা ১৪ মিনিট থেকে রাত ৯টার ৪০ মিনিট সুপার অফপিক আওয়ারে মেট্রোরেল চলাচল করছে।
যাত্রী চাহিদা বাড়লেও শিডিউল নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের (এমআরটি লাইন-৬) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশে ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করা হয়। পরদিন থেকে সাধারণ মানুষ মেট্রোরেলে যাতায়াত শুরু করে।
এরপর গত ৪ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। পরদিন উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের চলাচল শুরু হয়। সবশেষ ৩১ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের শাহবাগ ও কারওয়ান বাজার স্টেশন চালু হয়। এর মধ্য দিয়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এমআরটি-৬ লাইনের ১৬টি স্টেশনই চালু হয়।
গুরুত্বপূর্ণ দুই এলাকা শাহবাগ ও কারওয়ান বাজার স্টেশন চালু হওয়ায় যাত্রীদের চাপ, প্রত্যাশা দুটোই বাড়ে। তবে শুরু থেকেই যাত্রীদের দাবি ছিল শুক্রবারসহ সপ্তারের সাতদিন এই পরিষেবা চালু রাখার। এমনকি ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার দাবিও উঠেছিল।
কোটা সংস্কারের দাবিতে চলতি মাসের শুরু থেকেই শাহবাগে নিয়মিত অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। তারা এই কর্মসূচির নাম দিয়েছে ‘বাংলা ব্লকেড’। প্রথমে শুধু শাহবাগে বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে গেলেও কয়েকদিন পর তা ঢাকার আরও কিছু স্থানেও পালিত হয়।
গতকাল বুধবার কোটা পুনর্বহালের রায়ে ওপর আপিল বিভাগ এক মাসের স্থিতাবস্থা জারি কর করলেও রাজপথ ছাড়েনি আন্দোলনকারীরা। তার বলছে, সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহাল করতে হবে।
দাবি আদায়ে গতকাল দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এতে পুরো রাজধানীর সড়ক অচল হয়ে পড়ে। ভোগান্তিতে পড়ে অসংখ্য মানুষ। তাদের একজন মিরপুরের বাসিন্দা শেখ তানজিমুল হক। সকাল সন্ধ্যাকে তিনি জানিয়েছেন, গত ৭ জুলাই রবিবার থেকে মেট্রোরেলে ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে তার মতো অগণিত মানুষকে অনেক সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
দেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিমুল হক জানান, শিক্ষক ধর্মঘটের কারণে বেশ কয়েকদিন ক্লাস বন্ধ রয়েছে। ব্যক্তিগত প্রয়োজন বুধবার বিকালে কারওয়ান বাজারে যেতে হয়েছিল তাকে। মিরপুর থেকে বিকাল ৩টার দিকে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই কারওয়ান বাজার পৌঁছে যান তানজিমুল। কিন্তু সন্ধ্যা ৬টার পরপরই বিপত্তিতে পড়েন ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির জন্য।
যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপের মেট্রোরেলের কারওয়ান বাজার স্টেশনের প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এজন্য সেখানে ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করেন তিনি।
তানজিমুল হক জানান, এসময় গণপরিবহনে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। তার মতো হাজারো মানুষ গতকাল সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় পড়েন দুর্ভোগে। ভিড় ঠেলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে কারওয়ান বাজার স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছান তিনি। ১০ মিনিট পর ট্রেন এলেও ভেতরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। আরও ২০ মিনিট অপেক্ষার পর ট্রেনে উঠতে পারেন তিনি। এর কিছু সময় পর পৌঁছে যান মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনে।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম. এ. এন. ছিদ্দিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখন মেট্রোরেলে প্রচণ্ড যাত্রী চাপ বেড়ে গেছে। এ সপ্তাহে রবিবার থেকে এই চাপ বেড়েছে। মেট্রোরেলে প্রতিদিন প্রায় অর্ধ লাখ বাড়তি যাত্রী চলাচল করছে। যাত্রীদের ভিড় সামাল দিতে আমরা আমাদের সর্বস্তরের লোকবল নিয়ে কাজ করছি।”