আওয়ামী লীগের গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীরা এক কোটি টাকা বা এর বেশি জমা রেখেছেন—এমন হিসাব সংখ্যা চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৮৪টিতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালের শেষে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি।
অর্থাৎ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ৯৯ হাজার ৬২১টি।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে কোটিপতি ১৯ হাজার ১৬৩টি হিসাবে জমা ছিল ৭৭ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে কোটিপতি হিসাবে জমার পরিমাণ বেড়েছে ৬ লাখ ৯৫ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।
বিবিএসের তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়।
১৯৮০ সালে ব্যাংকে কোটিপতি হিসাব ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি ও ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি।
২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটিপতি ব্যাংক হিসাব সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এই সংখ্যা আরও বেড়ে ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬টিতে পৌঁছায়। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা বেড়ে হয় এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি।
সেইসঙ্গে ২০১৮ সালে সম্পদশালী বৃদ্ধির হার ও ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণ ধরে ওয়েলথ-এক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩ কোটি ডলারের বেশি সম্পদের মালিকের সংখ্যা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে।
ওয়েলথ-এক্স যুক্তরাষ্ট্রের ফিনটেক কোম্পানি; তারা বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে সম্পদশালী ব্যক্তিদের গোপন সম্পদের তথ্য প্রকাশ করে আসছে।
৩ মাসে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ২৮৯৪
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ২ হাজার ৮৯৪টি। একই সময়ে কোটিপতিদের হিসাবে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত জুনের শেষে দেশের ৬১টি ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা থাকা হিসাবগুলোতে মোট ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকা জমা ছিল। এর তিন মাস আগে অর্থাৎ মার্চের শেষে কোটিপতি হিসাবগুলোতে জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৪০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
সেই হিসাবে বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোটিপতি হিসাবগুলোতে নতুন করে ৩২ হাজার ৯০৮ কোটি টাকার আমানত যোগ হয়েছে।
এই টাকাগুলো ব্যাংকে ফেরত আসাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) পরিচালক শাহ মো. আহসান হাবীব। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোটিপতিদের আমানত বেড়েছে মানেই কোটিপতি বেড়েছে এমন নয়।”
প্রতিষ্ঠানেরও আমানত বাড়তে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে তথ্য দেয় তাতে এটা সুস্পষ্ট করে উল্লেখ থাকে না। এই তিন হাজার হিসাব নতুন খোলা হয়েছে অর্থ এই নয় যে নতুন কোটিপতি ৩ হাজার বেড়েছে।
“আগে হয়তো কারও ১০ কোটি টাকা ব্যাংকে ছিল, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আরও ৫ কোটি টাকা বিভিন্ন ছোট ছোট জায়গায় লগ্নি করে রেখেছিল, সেগুলো তুলে এবার ব্যাংকে রাখল, তাতে নতুন করে ৫ কোটি টাকা ব্যাংকে এল।”
তাছাড়া গত নির্বাচনের আগে-পরে অনেক ব্যবসায়ী বা রাজনীতিবিদ তাদের ঘরে বড় অঙ্কের নগদ অর্থ রেখেছিলেন নানা ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে। সরকার পতনের পর এমন এক সাবেক সচিবের বাসা থেকে ৩ কোটি টাকা উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বিআইবিএমর এই অধ্যাপক বলেন, “এইভাবে অনেকেই টাকা বাসায় রাখতে বাধ্য হন। এই টাকা সব সময় যে অবৈধ টাকা, তা নয়। সেক্ষেত্রে বৈধ টাকা ব্যাংকে ফিরে এলে তা অর্থনীতির জন্য ভালো।”
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর (জানুয়ারি-মার্চ সময়ে) কোটিপতিদের হিসাব সংখ্যা ও জমার পরিমাণ দুটোই কমেছিল।
ভোটের আগে গত অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকে কোটিপতি হিসাব ও জমা দুটোই বেড়েছিল।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বড় অঙ্কের আমানত হিসাব ও জমার পরিমাণ বাড়া ইঙ্গিত করে যে দেশের মানুষের হাতে বড় অঙ্কের টাকা এসেছে। তবে যে হিসাবগুলো বেড়েছে, তার সবগুলোই যে একই কারণে বেড়েছে তা বলার সুযোগ নেই।
তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আলোচিত তিন মাসে কোটিপতিদের হিসাবগুলোতে যে পরিমাণ আমানত বেড়েছে, তার প্রায় ৪৭ শতাংশই বেড়েছে ৫০ কোটি টাকা বা এরও বেশি জমা থাকা হিসাবগুলোতে।
অর্থাৎ আলোচিত সময়ে কিছু ব্যাংক হিসাবধারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বড় অঙ্কের টাকা ব্যাংকে জমা করায় কোটিপতিদের জমার পরিমাণে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা দেয়।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত জুনের শেষে ব্যাংকে ৫০ কোটি টাকা বা এর বেশি অঙ্ক জমা ছিল– এমন হিসাব ছিল ১ হাজার ৮১৮টি। তবে গত মার্চ শেষে এ ধরনের হিসাব ছিল ১ হাজার ৮২৬টি। সেই হিসাবে আলোচিত তিন মাসে এ ধরনের বড় ৮টি হিসাব কমলেও অন্যান্য হিসাবগুলোতে জমার পরিমাণ বেড়েছে ১৫ হাজার ২৯২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কোটিপতি হিসাবে জমা থাকা আমানতের ৬২ শতাংশ বেসরকারি খাতের আমানত।
ব্যাংক খাতে মোট আমানত কত
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা যায়, গত মার্চের তুলনায় জুন প্রান্তিকে ব্যাংক খাতের আমানত বেড়েছে ৭৬ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চ প্রান্তিকে আমানত বেড়েছিল ১৩ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ জুনে মোট আমানতে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি ছিল।
জুনের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের আমানত ৮২ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
মোট হিসাবধারীদের দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ কোটিপতি হিসাব। মোট আমানতের ৪২ শতাংশই এই কোটিপতি হিসাবধারীদের।
মোট আমানতের ৮৫ শতাংশ এসেছে শহরের গ্রাহকদের কাছ থেকে। ১৫ শতাংশ আমানত গ্রামের গ্রাহকদের।
গত জুনের শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানত হিসাব ছিল ১৫ কোটি ৮৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫২৩টি।
মোট আমানতের মধ্যে মেয়াদি আমানত ৪৪ শতাংশ। পরিমাণ ৮ লাখ ২২ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বড় অংশটি ৩-৬ মাস মেয়াদি আমানত।
কোন ধরনের হিসাবে কত জমা
কোটিপতি হিসাবে জমার পরিমাণ বৃদ্ধিতে অবদান রাখা হিসাবগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা হিসাবগুলো।
আলোচিত তিন মাসে ১ কোটি টাকার বেশি কিন্তু ৫ কোটি টাকার কম জমা আছে– এমন হিসাবগুলোতে ৫ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা বেড়েছে। এপ্রিল, মে ও জুন মাসে ব্যাংকে এ ধরনের হিসাব বাড়ে ২ হাজার ৩৩০টি। এতে জুন শেষে এ ধরনের হিসাব দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৯৫৩টিতে, যেসব হিসাবে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা।
জুন পর্যন্ত ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা হিসাব সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ হাজার ৬৯১টিতে, মার্চের তুলনায় বাড়ে ২৪৫টি। এই হিসাবগুলোতে জমা ছিল ৯০ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। জমার পরিমাণ বাড়ে ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা।
১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা হিসাবগুলোতে টাকার পরিমাণ আলোচিত তিন মাসে কমেছে। মার্চের শেষে এ ধরনের হিসাব সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৩৯৬টি, জমা ছিল ৫৪ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। জুন শেষে এ ধরনের হিসাব সংখ্যা কমে ৪ হাজার ৩১১টিতে নেমে আসে। জমা টাকার পরিমাণ কমে ৫২ হাজার ১৬৩ কোটিতে নেমে আসে।
আলোচিত তিন মাসে ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমার সংখ্যা বেড়েছে। জুনের শেষে এ ধরনের হিসাব সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৪টি। এসব হিসাবে জমা ছিল প্রায় ৩৬ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। মার্চের শেষে এ ধরনের হিসাব ছিল ১ হাজার ৯৬১টি। জমার অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা।
জুনের শেষে ব্যাংকগুলোতে ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা হিসাব সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৩৯টি। জমা ছিল ৩০ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা। এর তিন মাস আগে (মার্চ শেষে) এ ধরনের হিসাব ছিল ১ হাজার ২২১টি। তাতে জমা ছিল ২৭ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা।
২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা হিসাব সংখ্যা ছিল ৯৩৪টি। হিসাবগুলোতে জমা ছিল মোট ২৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে এ ধরনের হিসাব সংখ্যা ছিল ৮৭৫টি। তাতে জমা ছিল মোট ২৪ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা।
৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা জমা থাকা হিসাবের সংখ্যা ছিল ৫০৩টি। জমা ছিল ১৬ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। মার্চ শেষে এ ধরনের হিসাব ছিল ৫০১টি। জমার পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ২৩২ কোটি টাকা।
৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা জমা থাকা হিসাব ছিল ৩৯৬টি। জমার মোট পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। মার্চ শেষে এ ধরনের হিসাব ছিল ৩৬০টি। জমার মোট পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা।
জুন শেষে ৪০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত জমা থাকা হিসাব ছিল ৭৮৫টি। মোট জমার পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে এ ধরনের হিসাব ছিল ৬৮১টি। তাতে জমা ছিল ৩১ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। এই ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা বেড়েছে ৫ হাজার ৫ কোটি টাকা।
দেশে কোটিপতির প্রকৃত সংখ্যা কত
দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা কতগুলো তা জানা গেলেও দেশে প্রকৃত কোটিপতির সংখ্যা কত, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না।
কোনও ব্যক্তি তার সম্পত্তি বেচে বা লটারি জিতে ব্যাংকে কোটি টাকা রাখলেন, এক্ষেত্রে তাকে কোটিপতি বলা যাবে না। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণে তাকেই কোটিপতি বলা যাবে, যখন কারও টাকার প্রবাহ কোটি টাকা বা এর বেশি থাকে।
ব্যাংকে কোটি টাকার হিসাব মানেই ব্যক্তি কোটিপতি নয়, এটি শুধু ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত অর্থের হিসাব।
তবে এমন অনেক কোটিপতি রয়েছেন, যাদের ব্যাংকে হয়তো জমানো অর্থ নেই, কিন্তু দেশে ও দেশের বাইরে প্রচুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে, যার পরিমাণ কোটি টাকারও বেশি।
আবার ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়াও প্রতিষ্ঠান বা একাধিক ব্যক্তি থাকতে পারেন। তাছাড়া একজনের একাধিক কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব থাকতে পারে।
সেই হিসাবে দেশে এখন কোটিপতির প্রকৃত সংখ্যা কত, সে বিষয়ে ব্যাংকের এই প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট কোনও চিত্র পাওয়া যায় না। এ নিয়ে কোনও পরিসংখ্যানও নেই।