গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভেরিফাইড ফেইসবুক পাতা থেকে এবারের একুশে পদকপ্রাপ্তদের নামের ঘোষণা আসে। পোস্টটিতে ক্লিক করতে পাওয়া গেল বিজ্ঞপ্তির একটি স্ক্রিনশট। যে মোবাইলে স্ক্রিনশটটি নেওয়া হয়েছে, সে মোবাইলে যে ৪৯ শতাংশ চার্জ রয়েছে, তাও দেখা গেল।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘ডিজিটাল’ বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তার এত অভাব যে বিজ্ঞপ্তিটি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে কিংবা স্ক্রিনশটটি কেটে বা ক্রপ করে নিতে পারেননি।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমেদ অবশ্য কারণ দেখালেন, তাড়াহুড়ার ভুল।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা তথ্য মন্ত্রণালয়কে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তারা প্রকাশে দেরি করছিল। তাই আমি তাড়াতাড়ি এটা প্রকাশ করার জন্য বলেছিলাম। তাই এই ভুল হয়েছে।”
শুধু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ই নয়, অন্য সব মন্ত্রণালয়ের ফেইসবুকে উপস্থিতি থাকলেও তাকে নামকাওয়াস্তেই বলা যায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শেষ ফেইসবুক পোস্টটি গত বছরের জুনের ২৬ তারিখ। তাও নিজস্ব পোস্ট নয়, তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর নিজস্ব ফেইসবুক পাতার বাজেট সমাপনী বক্তব্যের ভিডিও শেয়ার করা হয়েছিল। এরপর থেকে আর কোনও পোস্ট নেই।
আরও সব মন্ত্রণালয় ফেইসবুকে থাকলেও সেগুলোও এমনই বেহাল।
বিশ্বের প্রায় সব দেশের সরকার ডিজিটাল ডিপ্লোম্যাসি তথা ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম, যেমন- ফেইসবুক, টুইটার ও ইউটিউব ব্যবহার করে জনগণকে হালনাগাদ তথ্য জানিয়ে থাকে।
কিন্তু বাংলাদেশে মন্ত্রণালয়গুলোর ফেইসবুক পোস্টে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। মন্ত্রীদের নানা কর্মসূচির ভিডিও, ছবি শোভা পায় সেখানে।
অথচ পাশের দেশ ভারতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ফেইসবুক পাতা থেকে প্রত্যেকদিন কম হলেও ৩-৪ টি পোস্ট করা হয়। সেখানে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা রাখছে, প্রত্যেক বছরে কাজের অগ্রগতি কতটুকু, বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন বা বিজ্ঞপ্তি নিয়মিত পাওয়া যায়।
অন্যদিকে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের ভেরিফাইড ফেইসবুক পাতায় শেষ বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করা হয়েছে ২০২০ সালের ২৯ মে। তার যে পোস্টগুলো আছে, তা মন্ত্রীর কর্মসূচির ছবি-ভিডিও।
ফেইসবুকের পাশাপাশি ভারতের প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয়ের উপস্থিতি রয়েছে এক্সে (আগের টুইটার)। পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়গুলোর এক্স হ্যান্ডেলেও হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাদে আর কোনও মন্ত্রণালয়ের এক্সে উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আসাদুজ্জামান এনিয়ে প্রশ্নে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটা স্ব স্ব মন্ত্রণালয় ঠিক করে। এগুলোর কোনও সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই।
তিনি বলেন, “আমরা সব তথ্যই নিয়মিত ওয়েবসাইটে দিই।”
সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমেদ বলেন, “ফেইসবুকের থেকে ওয়েবসাইটকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিই। আমাদের সকল আইন-বিজ্ঞপ্তি আমরা ওয়েবসাইটে নিয়মিত দিয়ে থাকি।”
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি নিজেও বেশ কয়েকবার এসব সাইটে ঢুকেছি। সেখানে কোনও আপডেট তথ্য নাই। পুরাতন জিনিসপত্র দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে।”
ওয়েবসাইটেও তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না কেন- প্রশ্নে সংস্কৃতি সচিব বলেন, “এ বিষয়ে ঠিক আমি জানি না। এরকম হওয়ার কথা না। আমি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলব।”
তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আসাদুজ্জামান বলেন, “কোনও মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে যদি তথ্য নিয়মিত দেওয়া না হয়, তাহলে এটা সেই মন্ত্রণালয়ের বিষয়। এনিয়ে আমি কী বলতে পারি।”
এবিষয়ে কথা বলতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস অভিযোগ করেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সরকারের বুলি হয়েই থাকছে। কাজ হচ্ছে না।
“ডিজিটাল বাংলাদেশ বা স্মার্ট বাংলাদেশ, এগুলো আলঙ্করিক কথা, গালভরা বুলি। আসলে এর মধ্যে কোনও সারবস্তু নেই। থাকলে এগুলো নিয়মিত আপডেট থাকত। কিন্তু এগুলো আপডেটও থাকে না এবং সরকার এসব গুরুত্বও দিচ্ছে না।”
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ডাক দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের যাত্রা শুরুর সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব ছিলেন নজরুল ইসলাম খান। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘একসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই)’ জাতীয় প্রকল্প পরিচালকও ছিলেন। তার সময়ই সরকারি ওয়েবসাইটগুলো সচল হয়েছিল।
নজরুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন তো কঠিন সময় ছিল। এগুলো কেউ বুঝত না। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এ পর্যন্ত করা গেছে। কিন্তু যেভাবে নজরদারি হত আমার মনে হয়, এখন এটা হচ্ছে না। তাই এসব ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।”
কেন এই সমস্যা হচ্ছে- তার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “আমাদের সাংস্কৃতিক সমস্যা রয়েছে। আমরা আমাদের মেইল বা মেসেজ অনেক কিছু ঠিকমত লক্ষ্যই করি না। এসব বিষয়ে কিছুটা অনীহা আমাদের আছে। আমরা এসব মাধ্যমকে ফেলনা জিনিস জানার মাধ্যম বানিয়ে ফেলছি, কিন্তু এগুলো যে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সে উপলব্ধি কম।”
এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার উপর গুরুত্ব দিয়ে নজরুল বলেন, “সমস্যাগুলো মেটানো খুব কঠিন না। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের উধ্বর্তন কর্মকর্তারা যদি নিয়মিত সাইটগুলো মনিটর করে, তাহলে সেই তো বলতে পারবে, কোনটা যাচ্ছে বা কোনটা যাচ্ছে না। সে সেই অনুযায়ী বলে দিবে, তাহলেই তো হল।”
ফেইসবুকে মন্ত্রণালয়গুলোর পাতায় শুধু মন্ত্রীদের কাজের বিবরণ দেওয়া কোন চোখে দেখছেন- প্রশ্নে অবসরপ্রাপ্ত এই সচিব হেসে বলেন, “এ বিষয়ে আমি আর কী বলব?
“যারা মন্ত্রী, তাদের মন্ত্রণালয়ে তারাই ঠিক করে কীভাবে চলবে তাদের সব। এ বিষয়ে আমি কি উচিৎ মনে করলাম বা না করলাম, তাতে কিছুই আসে যায় না।”