বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন সাকিব আল হাসান হয়ে ওঠার টেস্ট এই ম্যাচ দিয়ে শুরু করেছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত ম্যাচ শুরুর আগে তা নিশ্চিত করেছেন। সাকিব হয়ে ওঠার চাপ কম না। দেশের ক্রিকেটের সেরা অলরাউন্ডারের অভাব ভুলিয়ে দেওয়া পারফরম করা চাই। ঠিক এই সময় মিরাজ হাল ধরলেন – শুধু শান্ত নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের জানিয়ে দিলেন – “আমি আছি”।
ক্যারিয়ার জুড়ে মিরাজ এমন হাত তোলার উদাহরণ কম দেখাননি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেরা “কামব্যাক”-এর ইতিহাস ঘটেছিল মিরপুরে। ২০২২ সালে ভারতের সঙ্গে ওই ওয়ানডেতে ১৮৭ রানের জবাবে বাংলাদেশ ৯ উইকেট হারায় ১৩৬ রানে। নবম উইকেটে ৫১ রানের জুটি গড়ে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন মিরাজ। নিজে অপরাজিত ছিলেন ৩৮ রানে। মোস্তাফিজ ১০। দলের বিপদে সেদিন হাল ধরেছিলেন মিরাজ।
পারফরম করে ম্যাচ জেতালেন। এমন অনেক পারফরমার আছেন বাংলাদেশ দলে। কিন্তু নিজের পজিশন ছেড়ে দলের জন্য এগিয়ে যাওয়ার সাহসটা ক’জন দেখান। জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার আগে ২০১৬ যুব বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার ছিলেন মিরাজ। ওই আসরে মিডলঅর্ডারে ব্যাট করেছেন। জাতীয় দলে আসার পর মিরাজ হয়ে ওঠেন সাত নম্বর ব্যাটার। অথচ ২০২২ সালে তাকে মেকশিফট ওপেনার করে দেওয়া হয়।
ওপেন করতে হবে – টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে এমন বার্তা পাওয়ার পর বুক চিতিয়ে সামনে আসেন মিরাজ। ক্যারিয়ারে তিনটি ওয়ানডেতে ওপেন করেছেন। ২০২৩ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরিও আছে ওপেন করতে নেমেই। এছাড়া তিন নম্বরে নামার অভিজ্ঞতা আছে মিরাজের। ২০২৩ বিশ্বকাপে আফগানদের বিপক্ষে তিনে নেমে ফিফটি করেছেন। এই দুই ম্যাচেই জিতেছিল বাংলাদেশ। শুধু ওয়ানডে নয়, টি-টোয়েন্টিতেও ২৭ ম্যাচের মধ্যে ৫ ম্যাচে ওপেন করেছেন মিরাজ।
২০২২ এর ভারত সিরিজে আবার ফেরা যাক। ১ উইকেটে জয়ের অবিশ্বাস্য কীর্তির পরের ম্যাচেও বাংলাদেশকে টেনে তুলেছিলেন মিরাজ। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আগে ব্যাট করে ৬৯ রানে ৬ উইকেট পড়ার পর মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে জুটি বাঁধেন। নিজে ৮৩ বলে ১০০ রান করে দলকে এনে দেন ২৭১ রানের পুঁজি। ওই ম্যাচেও জিতেছিল বাংলাদেশ।
এছাড়া ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দলকে জেতানোর আরেকটি কীর্তিতে মিরাজ আছেন। ২০২৩ সালে আফগানদের বিপক্ষে ৪৫ রানে ৬ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে ১৭৪ রানের জুটি গড়ে জয় এনে দেন। ওই ম্যাচে মিরাজ ৮১ রানে অপরাজিত ছিলেন, আফিফ ৯৩ রানে।
নিজের ৭-৮ নম্বর পজিশন ছেড়ে টপঅর্ডারে ওঠাই শুধু নয়। মিরাজ হাত তুলে এগিয়ে এসেছেন, পারফরমও করেছেন। দলের বিপদ সামাল দিতে যতবার মিরাজ হাত তুলেছেন ততোবার বাংলাদেশ জিতেছে। টেস্টে হয়তো এমন উদাহরণ নেই। তবে মিরাজ টেস্টেও দলের ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরেছেন।
আট নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি করার কীর্তি আছে তার। মিরাজের ব্যাটে চট্টগ্রামের ওই ম্যাচে উইন্ডিজকে হারানোর সুযোগ তৈরি করেছিল বাংলাদেশ। কাইল মায়ার্সের রেকর্ডগড়া ডাবল সেঞ্চুরিতে তা হয়নি। এছাড়া শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮১ রানের ইনিংসে হারের ব্যবধান কমানো বা পাকিস্তানের বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডিতে ২৬ রানে ৬ উইকেট হারানোর পর লিটনের সঙ্গে জুটি বেঁধে ৭৮ রানের ইনিংসে জয়ের সুর বেঁধে দেওয়া।
দলের জন্য যে কোন সময়, যে কোন ভাবে মিরাজ এগিয়ে এসেছেন। তার পারফরম্যান্সের দিনে বাংলাদেশ জয়ের পথ পেয়েছে শতকরা ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশ দলেই এমন ওপেনার আছেন যিনি টেস্টে ওপেন করতে চান না বলে গুঞ্জন আছে। কিন্তু টেস্টে উইন্ডিজের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে তিনে নেমেছিলেন মিরাজ।
মিরাজের এই এগিয়ে আসার মানসিকতা এসেছে সাহস ও বিশ্বাস থেকে। মিরপুর টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা শেষে দলের লেগ স্পিন কোচ মুশতাক আহমেদ বলছিলেন, “আজকে মিরাজ যেভাবে সুইপগুলো খেলছিল এটা আসলে ওর বিশ্বাস থেকে এসেছি। ও নিজের ওপর খুব বিশ্বাস রাখে। যে দিন সে ভালো খেলে বিশ্বাসটা সে বাংলাদেশ দলেও ছড়িয়ে দিতে পারে। যেভাবে সে খেলছে আশাকরি আমরা এই ম্যাচে জয়ের মুখ দেখতেও পারি।”
১১২ রানে ৬ উইকেটের সময় নেমে মিরাজ সাহসী ব্যাটিং করেছেন। দলের প্রয়োজনে হাল ধরেছেন। তার ব্যাট থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া বিশ্বাসের রেণু এখন বাংলাদেশ দলে ছড়িয়েছে। ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর যে বিশ্বাস ছিল ম্যাচের শুরুতে তা আবার ফিরেছে।
সাকিব আল হাসান নেই বলে স্বস্তির কথা বলেছিলেন প্রোটিয়া অধিনায়ক এইডেন মারক্রাম। কিন্তু মিরাজ যে হাত তুলেছেন, সাকিব হয়ে উঠেছেন। তার পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ ম্যাচে জিতে! এই টেস্টে তিনি পারফরম করছেন। এবার মিরাজের মতো বাকি ক্রিকেটারদের হাত তোলার পালা।