ঘটনা ১: গত ৪ সেপ্টেম্বর রাতে খুলনায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে উৎসব মণ্ডল নামে এক তরুণকে উপ পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে ঢুকেই ব্যাপক মারধর করে একদল জনতা। সেসময় সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রচেষ্টায় প্রাণে বাঁচলেও গুরুতর আহত হন উৎসব।
ঘটনা ২: গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে রাজশাহীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামে এক যুবককে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটিতেও সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর মাত্র চার দিন আগে মেয়ে সন্তানের বাবা হয়েছিলেন মাসুদ। সেই মেয়ের জন্য ওষুধ কিনতে বেরিয়ে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে আ্রকান্ত হন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে হামলার অভিযোগ তুলে তাকে ব্যাপক পেটানো হয়। পুলিশে তুলে দেওয়ার পর হাসপাতালে নিলেও তাকে বাঁচানো যায়নি।
ঘটনা ৩: ঢাকার সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর হামলার শিকার হন শামীম মোল্লা নামে এক যুবক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। তার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী বলে ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকাতেই তার বাসা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় গত ১৫ জুলাই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় শামীমও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ আরও অভিযোগ ছিল। বুধবার বিকালে শামীমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটক এলাকায় পেয়ে ব্যাপক মারধর করে একদল শিক্ষার্থী। পরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রক্টর অফিসে ঢুকেও তাকে বেধড়ক পেটানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শামীমকে আশুলিয়া থানা পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছিল। সেখান থেকে তাকে সাভারের গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।
ঘটনা ৪: ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে চোর সন্দেহ শিক্ষার্থীরা আটকে করে তোফাজ্জল নামে এক যুবককে। তাকে হলের গেস্ট রুমে নিয়ে দফায় দফায় পেটানো হয়। এরপর রাতে তাকে ভাত খাইয়ে পরে আবার মারধর চলে। খবর পেয়ে হলের হাউস টিউটররাসহ প্রক্টরিয়াল িটিমের সদস্যরা গিয়ে ওই যুবককে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। অবস্থা গুরুতর দেখে পুলিশ ওই যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলেও বাঁচানো যায়নি। পরে জানা যায়, তোফাজ্জল ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন। মা-বাবাকে হারানোর পর একমাত্র ভাইও মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন। তার মামাতো বোন এই অভিযোগও করেন, তোফাজ্জলকে ধরার পর ফোন করে অর্থও চাওয়া হয়েছিল।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা ঘটে চলছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর এই ধরনের কাজে জড়িয়ে না পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও বলছেন, কেউ যেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড না ঘটায়। তারপরও তা থামছে না।
এর মধ্যে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা দুটি পর সোশাল মিডিয়াসহ দেশজুড়েই সমালোচনার ঝড় বইছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আইন হাতে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।
সাধারণ মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে যখন নিজেই বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাই মব জাস্টিস। কিন্তু তা কেন ঘটে?
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ড. তানিয়া হকের মতে, মানবিকতার অভাবে।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে আমরা এখনও মানবিক হয়ে উঠতে পারিনি। শুধু অন্যকেই বলছি না, একথা আমার নিজের ক্ষেত্রেও সত্য। আমাদের বুঝতে হবে পলিসি, ল, বিধি যাই বলেন না কেন, সবকিছুর ঊর্ধে হলো মানবিকতা। হাজারো ছাত্র-জনতার এই বিজয়কে সার্থক করে তুলতে হলে সবার আগে আমাদের এই গুণটি অর্জন করতে হবে।”
এতে জড়িয়ে পড়ার মনস্তত্বটা কী?
তার উত্তর সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. সামিনা লুৎফা সকাল সন্ধ্যাকে দিলেন এভাবে, “যখন কোনও মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষের উপস্থিতি থাকে। এতে জড়িতরা ভাবে, তাদের আলাদা করে চিহ্নিত করা যাবে না। এই ভাবনা তাদের অপরাধ করতে উৎসাহিত করে।
“এছাড়া বর্তমানে যখন দেশে বিশেষ একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেটার সুযোগে অশুভ উদ্দেশ্য বা চক্রান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টাও করতে পারেন অনেকে।”
বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি লালন করা হচ্ছে, তারই প্রতিফলন এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে বলেও মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, “পুরনো ঘটনাগুলোর বিচার না হওয়ায় এমন ঘটনা বাড়ছে।
“এই সরকারের শুরু থেকেই যেসব বিচারবহির্ভূত কাজ হয়েছে সেগুলোর অপরাধীরাও এখনও বিচারের আওতায় আসেনি। এটা দেখে অপরাধীদের সাহস আরও বেড়ে গেছে। তাদের মনে হচ্ছে, তারাও বিচারের আওতায় আসবে না। এতে অপরাধ করার প্রবণতা বাড়ছে।”
দাপট নিয়ে থাকা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে শিক্ষার্থীরা সফল হওয়ার পর তাদের আচরণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার দিকটিও তুলে ধরেছেন সামিনা লুৎফা, যিনি নিজেও এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন।
তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্ষমতাবান ভাবছে। অনেক শিক্ষার্থী ভাবছে, তারা যা ইচ্ছা তাই করার ব্ল্যাংক চেক পেয়ে গেছে। এটাও মব জাস্টিসের মতো ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত করছে।”
ন্যায়বিচারহীনতার অভিযোগ নিয়েই দেড় দশক দেশ শাসন করেছিল আওয়ামী লীগ। আন্দোলনে সেই সরকারের পতনের পর জনতার রোষ গিয়ে পড়ে এই দল সংশ্লিষ্ট সব কিছুর ওপরই।
ড. তানিয়া হক বলেন, “হতে পারি আমি একজন দাগি আসামি। কিংবা ধরেন খুনের মতো একটা জঘন্য অপরাধ করে ফেলেছি। আমার সেই অপরাধের শাস্তি দেওয়ার জন্য দেশে তো একটা বিধান আছে, আইন আছে। আমার বিচার হবে সেই অনুযায়ী। কিন্তু তা না করে আপনি নিজেই আমার বিচার করে ফেলবেন, সেটা তো মানবাধিকার নয়।”
মব জাস্টিস থামাতে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. সামিনা লুৎফা।
তিনি বলেন, “গত কিছুদিন ধরেই কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অযৌক্তিক ঘটনা ঘটছে। সেসব থামানোরও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আগের ঘটনাগুলোতে ব্যবস্থা নিলে বুধবার রাতের এই ঘটনা ঘটতে না বলে মনে হয় আমার।
“তাই এসব ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাহলে এটি থামতে পারে। আর না হলে সামনে আরও খারাপ সময়ের কিংবা ঘটনার মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে আমাদের।”
এমন শঙ্কা প্রকাশ করে তানিয়া হকও বলেন, “আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এই সরকারকে সময় দিতে হবে। তাদের ওপর ভরসা করতে হবে। তাহলে হয়ত আমরা ভালো কিছু পাব।
“কিন্তু তা না করে যদি নিজেরাই বিচারের দায়িত্ব হাতে তুলে নিই, তাতে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, তা যে কারও পক্ষেই নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর হয়ে উঠবে। আর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি হলে আমরা সবাই তার শিকার হব।”
এই সময়ে শিক্ষার্থীদের দ্রুত ক্লাসে ফেরানোর ওপরও জোর দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা।
“আমার মনে হয় সরকার দ্রুত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিলে এমনটা হতো না। শিক্ষার্থীরা যখন পরিবার ছেড়ে প্রতিষ্ঠানে আছে, সেহেতু শিক্ষার্থীদের দেখভাল করার একটা নির্দিষ্ট অথরিটি থাকা দরকার ছিল। ক্লাস না চললেও শিক্ষার্থীরা কী করছে, কিংবা তাদের নিরাপত্তা এসব বিষয়ে সবসময় দেখভাল করা উচিৎ।”
ড. তানিয়া হক মনে করেন, সবার মনোভাব বদলাতে হবে, নইলে সমাজ বদলাবে না।
“একটি সুন্দর সমাজ গড়তে হলে, নিজের জন্য নিরাপদ জীবন চাইলে আমাদের সবাইকে হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, প্রতিশোধের কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে ধৈর্য ধরা শিখতে হবে। একটি অন্যায়কে প্রতিহত করতে আরেকটি অন্যায় কখনোই কাম্য নয়। আর সেটা সমাজের জন্য ভালো নিয়ে আসবে না।”