‘লেখা আছে হাতের রেখায়, জাহাজ ডুববে অহমিকায়’- কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের লেখা এক লাইনের এই কবিতা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল নিমিষেই।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১ জুলাই, তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়; ইমতিয়াজ মাহমুদ কবিতাটি ফেইসবুকে দেন ১৭ জুলাই।
তার আগের দিন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ রাজপথে গুলিতে নিহত হন। সেদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে আরও পাঁচজনের মৃত্যু ঘটেছিল।
সেই আন্দোলনের ধারায় কয়েকশ মৃত্যুর পথ পেরিয়ে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। সেদিনও ফেইসবুকে ওয়ালে ওয়ালে ঘুরছিল কবিতাটি।
তারপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়; সেই সরকারের এক মাস গড়িয়েও গেছে।
১৯ সেপ্টেম্বর সেই ইমতিয়াজ মাহমুদ আবার ফেইসবুকে লিখেছেন আরেকটি লাইন : ‘মানুষের মৃত্যুতে যদি আপনার কোনো অনুভূতি না হয়, তবে ধরে নেবেন আপনিও বেঁচে নাই।’
তার এই পোস্টও ভাইরাল, শেয়ার হয়েছে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি।
ইমতিয়াজ মাহমুদের এই লেখার আগের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনকে পিটিয়ে মারা হয়। এই মব জাস্টিসের শিকার একজন মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক, আরেকজন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত শামীম মোল্লার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের পেটানোর অভিযোগ ছিল। চাঁদাবাজিসহ আরও নানা অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে।
তাকে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফটকে আটকের পর ব্যাপক মারধর করা হয়। এরপর প্রক্টর অফিসে নেওয়া হলে সেখানেও পিটুনির শিকার হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে তুলে দিয়েছিল থানা পুলিশের কাচে। সেখান থেকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাকে বাঁচানো যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে চোর সন্দেহে ধরা হয়েছিল মানসিক ভারসাম্যহীন যুবক তোফাজ্জলকে। গেস্ট রুমে রেখে তাকে বেদম পেটানো হয়। তাকেও পুলিশে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা জানায়, এই যুবক আগেই মারা গেছেন।
দফায় দফায় মারধরের মাঝে হলের ক্যান্টিনে নিয়ে রাতের খাবার খাওয়ানো হয়েছিল তোফাজ্জলকে। ভাত খাওয়ার সেই ছবি ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
তোফাজ্জলের ভাত খাওয়ার ছবিটি শেয়ার করে অনেকেই লিখেছেন ‘লাস্ট সাপার’। ১২ জন শিষ্যকে নিয়ে যিশু খ্রিস্টের শেষ নৈশভোজ অবিনশ্বর হয়ে আছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির তুলিতে, দ্য লাস্ট সাপার নামে চিত্রকর্মে। তার পরদিনই ক্রুসবিদ্ধ করে মারা হয়েছিল খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যিশুকে।
তোফাজ্জলের ভাত খাওয়ার ছবিটি শেয়ার করে নারী অধিকারকর্মী মুনমুন শারমিন শামস ফেইসবুকে লিখেছেন, “এরপর যখন আপনারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ভাতের থালা নিয়ে বসবেন, গ্লাসে ঢেলে জল খাবেন, তখন যেন তফাজ্জলের এই ম্লান, বিষন্ন, মনমরা মুখটা আপনাদের চোখের সামনে ভাতের বদলে ফিরে ফিরে আসে। আপনারা যেন এই মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণের মৃত্যুর অভিশাপে আর কখনও ভাত মুখে দিতে না পারেন।”
তোফাজ্জলের মৃত্যুর পর তার পরিচিতরা লিখেছেন, বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সন্তান তোফাজ্জল। ছাত্রলীগ করতেন তিনি। পাথরঘাটা কলেজে ভর্তির পর বরগুনা ডিগ্রি কলেজে অনার্সেও ভর্তি হন। স্থানীয় চেয়ারম্যানের মেয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সর্ম্পক গড়ে উঠেছিল। সেই মেয়ের অন্য স্থানে বিয়ে হয়ে যায়। মাস খানেকের মধ্যে তোফাজ্জল বাবা-মাকে হারান। তখন থেকেই শোকে-কষ্টে মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করেন তোফাজ্জল। বড় ভাই ছিলেন পুলিশে কর্মরত, যিনি দেখে রাখতেন তোফাজ্জলকে। সেই ভাই মারা যাওয়ার পর মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতেন তোফাজ্জল।
মুনমুন সেই সূত্র ধরে লিখেছেন, “ছেলেটা বাবা, মা, ভাইকে হারিয়েছে, প্রেম হারিয়েছে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে, স্বাভাবিক জীবন হারিয়েছে। ওর আসলে আর হারানোর কিছুই ছিল না। কিন্তু পেটের খিদের দায় বড় দায়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে ও খাবার চেয়ে বেড়াত।
“হত্যা করার আগে ওকে পেটপুরে খাইয়ে দিয়েছেন। এই বা কম কী সে! এই ভাতের থালায় থাকা প্রতিটা অন্ন ওর শরীরের ভেতরেই জমে ছিল, যখন ওকে আপনারা মারছিলেন। এই তো আমাদের গর্বের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়!”
তোফাজ্জলের ভাত খাওয়ার ছবি শেয়ার করে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক ফেইসবুকে ব্যঙ্গমিশ্রিত ক্ষোভের সুরে লিখেছেন, “অন্তত এই একটা মৃত্যু পাওয়া গেল, যেখানে আমরা শান্তিমতো প্রতিবাদ করতে পারলাম। লোকটা যেহেতু পাগল ছিল, এবং পাগল ও শিশুরা নিরপেক্ষ, সুতরাং এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করাটা ঝামেলামুক্ত। আমিও করলাম। আপনিও করতে পারেন।”
ফেইসবুকে এই ছবি দেখে অনেকে সোশাল মিডিয়া থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন। তেমনই একজন সাঈদা মিতা লিখেছেন, “অস্থির লাগলে আগেও আমি দীর্ঘ সময়ের জন্য ফেসবুক থেকে বিরতি নিতাম। আবার বোধহয় নেয়ার সময় হলো। এই সিচুয়েশন আমার জন্য না। আমার মতো দুর্বল মনের মানুষ এসবের জন্য ফিট না।”
নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, যিনি ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে সরব ছিলেন প্রতিক্ষণ, তিনিও এই মৃত্যু নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
ফারুকী লিখেছেন, “আব্বার কাছে শুনতাম, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকের মধ্যেই জোশ চলে আসছিলো যে সে-ই সব। সে নিজেই অভিযোগকারী, নিজেই বিচারক, নিজেই এক্সিকিউশনার। হাতে অস্ত্র আছে, অথবা আছে মবের শক্তি। সুতরাং মারো, মেরে ফেলো। ফল কী হয়েছিল, আমরা জানি।”
আওয়ামী লীগে আমলেও এমন ঘটনাগুলো স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন, কিন্তু নতুন সরকারের কাছে তার আশা ছিল অন্যরকম।
“আমি আশা করছিলাম, এই নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাথে সাথে নতুন দায়িত্বের ব্যাপারটা আমার উপলব্ধি করব। আমাদের দিলে রহম জিনিসটা আসবে। একশো জন মববাজি করতে আসলে দুইজন হলেও রুখে দাঁড়াবে! ঢাকা আর জাহাঙ্গীরনগরে কি এরকম চারজন ছিল না রুখে দাঁড়ানোর? এটা লজ্জার, বেদনার।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজওয়ানা কবির স্নিগ্ধা আওয়ামী লীগে আমলে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের পিটিয়ে মারার বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, “আবরারকে পেটানোর ঘটনা খুব পৈশাচিক ছিল, ঠিক একইভাবে জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে মারার ঘটনাও নিন্দনীয় এবং ঘৃণিত। আমার কাছে শিবির ট্যাগ দেয়া বুয়েটের আবরার অথবা ছাত্রলীগ শামীম দুজনই মানুষ।”
এমন ঘটনার বিচার চেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিনও।
তিনি লিখেছেন, “সশস্ত্র ডাকাতদেরও তো ক’দিন আগে মেরে ফেলা হয়নি! অথচ চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন একজনকে হত্যা করা হয়েছে ক্যাম্পাসে!
“ছবি আছে, সাক্ষী আছে, প্রক্টররাও উপস্থিত ছিলেন। বিচার করতে হবে। মব জাস্টিস বলে কিছু নেই এখানে। বর্বরতা ও খুনের বিচার চাই।”
বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কর্মরত আশরাফুল আলম রিপন তোফাজ্জলকে স্মরণ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত মুগ্ধর সঙ্গে।
ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পানি লাগবে পানি বলে ঘুরছিলেন মুগ্ধ। তার কিছুক্ষণ পরই গুলিতে নিহত হন তিনি। কপালের একদিক দিয়ে গুলি ঢুকে আরেকদিকে বেড়িয়ে যায়।
সেই মুগ্ধর কথা সম্মরণ করে আশরাফুল আলম রিখেছেন, “আহ মুগ্ধ! আহ তোফাজ্জল! পানি, ভাত …. সবই বিবমিষা হয়ে গেল!”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ শিক্ষক শামীম মোল্লার মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবিধান চেয়ে উপাচার্যকে চিঠি দিয়েছে।
সেই চিঠিতে তারা বলেছে, শামীম মোল্লা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার।
শামীমের হত্যাকারীদের শনাক্ত করে বহিষ্কার এবং রাষ্ট্রীয় আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে তারা। প্রক্টরের জিম্মায় থাকার পরেও শামীমের মৃত্যুর দায় প্রক্টরিয়াল টিমকে নেওয়ার কথাও তারা বলেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবে অবসানে প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়ার দাবিও জানিয়েছে এই শিক্ষকরা।
দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজনকে পিটিয়ে মারার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ঘটনায় প্রক্টরিয়াল বডি দায় এড়াতে পারে না এবং ফ্যাসিবাদী কায়দায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, “৫ আগস্টের পর এমন হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, ফ্যাসিবাদী কাঠামো ও ব্যবস্থা এখনও বহাল রয়েছে। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদাসীনতা এবং বিভিন্ন হামলার পরেও আইনি পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে এ ধরনের মব ভায়োলেন্সের পূনরাবৃত্তি ঘটছে।”
শামীম মোল্লার মৃত্যুকে বিচারবহির্ভূত হত্যা দাবি করে তার বিচার চেয়ে বিক্ষোভ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও সেখানকার ঘটনায় মর্মাহত জানিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছে।
মব জাস্টিস প্রতিরোধ নিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সম্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহও।
তিনি বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক দুটি ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদেরকে দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
“যে বা যারাই এর সাথে জড়িত, তাদেরকে আইডেন্টিফাই করে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার্থী দাবি করে কেউ যেন পার পেয়ে যেতে না পারে।”
মব লিঞ্চিং সমাধান নয় মন্তব্য করে হাসনাত লিখেছেন, “সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে ছাত্রলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পুনর্বাসনের কোনও পথ যেমন উন্মুক্ত নেই, তেমনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে অপরাধে অভিযুক্ত হলে তাকেও শাস্তি পেতে হবে।
“পাশাপাশি স্বৈরাচারী হাসিনার ফাসিস্ট রেজিমকে পাকাপোক্ত করতে যেসব সুশীলরা কালচারালি কিংবা পলিটিকালি মদদ যুগিয়েছিল, নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আলাপে তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।”
শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সরব থাকা রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক দিদারুল ভুঁইয়া সতর্ক করেছেন এই বলে যে মব জাস্টিস গণঅভ্যুত্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিটিয়ে খুন গণঅভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। মব জাস্টিস, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায় প্রধানত সরকার ও বৃহত্তর সরকারসহ সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে না আনলে রাষ্ট্র সংস্কারের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে,” ফেইসবুকে লিখেছেন তিনি।