অন্তত এক শতাব্দী ধরে ভারতে সমাজের আয়না হয়ে উঠেছে বলিউড।
ভারতে প্রতি বছর কতগুলো সিনেমা মুক্তি পায়?
সিএনএন বলছে, অন্তত পক্ষে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে চলে। কোটি কোটি ডলারের এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ২০টি ভাষায় সিনেমার বাজার গড়ে তুলেছে; আরও কোনো দেশ এই পাল্লায় কম পড়ে যাবে।
বলিউড সিনেমার আলাদা আবেদন আছে ভারতের সংস্কৃতি, পরিচিতি এবং অর্থনীতিতে। গান দিয়েই একেকটি সিনেমা বাজার মাত করে দিতে পারে। তবু বড় পর্দায় বাদ যায় না রাজনীতি, ধর্ম এবং সামাজিক সমস্যাও।
এক সময় হিন্দি সিনেমা জুড়ে থাকতো ভারতের জাতির পিতার আদর্শে ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কাহিনী। কিন্তু সিএনএনের পর্যবেক্ষণ বলছে, গত এক দশকে এই ইন্ডাস্ট্রি সেখান থেকে সরে গেছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি মানে বিজেপি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে হিন্দি সিনেমার হাবভাবেও লেগেছে ডানপন্থি হাওয়া।
নিরপেক্ষ ভাবনা থেকে এবং সিনে পাড়ার একজন হয়ে অনেকে টানা কয়েকটি ব্লকবাস্টার সিনেমার দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন, এসব রীতিমতো মুসলমান বিদ্বেষী এবং বিরোধী মতকে কোনঠাসা করার ছক।
যদিও প্রতি বছর যত সংখ্যক সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে আসে তার অল্প সংখ্যকই এ ধরনের বিষয় নিয়ে হয়; কিন্তু এসব সিনেমা একটু বেশি মাত্রায় প্রচার এবং সরকারের সমর্থন পাচ্ছে। আর এ কারণেই সমালোচকরা মাথা ঘামাচ্ছেন; তাদের আশংকা, জাতীয় নির্বাচনে টানা তৃতীয় দফায় সরকারে আসার লক্ষ্যে এসব সিনেমা বিজেপির প্রপাগান্ডা চালানোর হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
বলিউডের এই মোড় বদল অনেকখানি গভীরেই ঘটছে; যেমন করে রিপাবলিকান দলের দিকে ঝুঁকছে হলিউড।
গৎবাঁধা রোমান্টিক ছকে এসব সিনেমায় নায়ক চরিত্রটি মোদীর হিন্দু নীতি সমর্থক থাকে। আর ভিলেন থাকে একজন মুসলমান যে ভারতের হিন্দুদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। কোথাও ধর্মের উল্লেখ না থাকলেও বিজেপির রাজনীতি প্রচারের অংশ হচ্ছে এসব সিনেমা।
পুরস্কার জয়ী পরিচালক রাজা সেন এক সাক্ষাৎকারে সিএনএনকে বলেন, “এমন সিনেমা কিন্তু সামনে আরও মুক্তি পাবে।
”নির্বাচনের বছরে এ ধরনের কাজের অনুমতি দেওয়া কিন্তু একেবারে ঠিক নয়।”
ভারতেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোটার রয়েছে। এরমধ্যে ২০ কোটিরও বেশি মুসলমান মোদীর জয়ের সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে আছেন।
বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর মানবাধিকার সুরক্ষার আইনে পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে করে একদিকে সংখ্যালঘু অনুসারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে ইসলাম বিদ্বেষী মতবাদ চাঙ্গা হচ্ছে।
বিজেপির আয়না হয়ে ওঠা এসব সিনেমা প্রয়োজনা ও পরিচালনায় অবশ্য সরাসরি এই দলের থেকে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে না। তবে কখনও দল এবং কখনও মোদীর সরাসরি সমর্থন কুড়াচ্ছে সিনেমাগুলো।
সমালোচনা যতই হোক, এসবের মধ্যে অর্থনীতির চাকা সচল রাখায়, বিদেশে সুসম্পর্ক ধরে রাখায় এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রচারণা বাড়ানোর কারণে সাধুবাদও উপভোগ করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী।
সে কারণেই মোদীর উৎসাহ পাওয়া সিনেমাগুলো দর্শক ও বাণিজ্যিক সফলতা দুটোই পাচ্ছে। এতে করে ভারতে ধর্মীয় ভেদাভেদ আরও গভীর ভাবে গেঁড়ে বসেছে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বলিউডের শহর মুম্বাইয়ের সাংবাদিক ও সিনেমা সমালোচক তানুল ঠাকুর বললেন, “জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার এই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়াটা আমি শুরুতেই খেয়াল করেছিলাম। এই সিনেমাগুলো শুধু সরকারের মুখপত্র হয়ে উঠছে তা নয়, বরং খারাপ উদাহরণ উঠছে।
“যে মাত্রায় জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমায় এসব রাজনীতি ঢুকে যাচ্ছে … সংখ্যালঘুদের প্রতি এসব নির্লজ্জ অবহেলা … এসব একেবারে বিরক্তিকর।”
বিজেপির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিল সিএনএন; সেখানে সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন কর্তৃপক্ষের কাছে মন্তব্য চেয়েছিল এতো সব আলাপ ও সমালোচনার বিপরীতে।
এর আগে বিজেপির এক মুখপাত্র সিএনএনকে বলেছিলেন, মুসলমানদের প্রতি এই দলের কোনো রকম বিদ্বেষ নেই। বরং মোদীর নেতৃত্বে ভারতে এই জনগোষ্ঠী ভালো আছে।
এই মুখপাত্র বলছেন, “ভারতের সংবিধানই ভারতের গণতন্ত্রের সুরক্ষায় কাজ করে।”
সিএনএনের কাছে সব বিশেষজ্ঞরাই বলেছেন, সরকারমুখী ও মুসলমানবিরোধী সিনেমার সংখ্যা বেড়েছে মোদীর আমলেই।
এ বছর মুক্তি পেয়েছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দু মহাসভার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব বিনায়ক দামোদর সাভারকরের জীবনী নিয়ে ‘স্বতন্ত্র বীর সাভারকর’ সিনেমা। সামনেই মুক্তির সারিতে আছে ‘জেএনইউ’ অর্থাৎ ‘জাহাঙ্গীর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ সিনেমা। জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি নামের ছায়া অবলম্বনে এই সিনেমা বামপন্থি ছাত্ররাজনীতির চর্চাকে ধূলিসাৎ করার চক্রান্ত হতে পারে বলে মনে করছেন সমালোচকরা।
২০২২ সালে ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ এবং ২০২৩ সালে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ সিনেমা দুটো মুসলমানদের হেয় করা, নেতিবাচক ধারণাকে উস্কে দেওয়া, ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলা এবং ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করায় সমালোচনার মুখে পড়েছিল।
যদিও দুটো সিনেমা বক্স অফিসে ব্যবসা সফল হয়েছে। ৩০ লাখ রুপিতে বানানো ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ কামিয়েছিল ৩ কোটি রুপি; আর এর বড় কারণ সরকারের ভীষণ রকম উৎসাহ ছিল এই সিনেমা নিয়ে।
বিজেপির তহবিল থেকে অর্থায়ন করা না হলেও, মোদী এবং দলের জ্যেষ্ঠ নেতা দুটো সিনেমার সাফাই গেয়েছিলেন বারবার। এমনকি বিজেপি নেতৃত্ব রয়েছে রাজ্যগুলো সিনেমার টিকেট থেকে ট্যাক্স প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কোনো কোনো রাজ্যে পুলিশ ও সরকারি চাকুরিজীবীদের ছুটি দেওয়া হয়েছিল ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’ দেখার জন্য।
নব্বইয়ের দশকে হিন্দুদের গণহারে কাশ্মির ছাড়ার পটভূমিতে নির্মাণ হয়েছে ‘দ্য কাশ্মির ফাইলস’। এই সিনেমার কলাকুশলীদের ভালো অভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছে। কাশ্মিরের অনেক হিন্দু মনে করছেন, এই অঞ্চলের রক্তাক্ত ইতিহাসকে এতদিন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে; সেই সব ঘটনার ওপর আলো ফেলেছে এ সিনেমা।
এই সিনেমার নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রী সমালোচনার তোয়াক্কা না করে ২০২২ সালে সিএনএনকে বলেন, “এই সিনেমা শুধু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। আমি মুসলমানদের বিদ্রুপ করিনি এতে।”

‘দ্য কেরালা স্টোরি’ পরিচালনা করেছেন সুদীপ্ত সেন। এই সিনেমা ইসলামোফোবিয়া আক্রান্ত এমন কথা নাকচ করে দিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি বলেন, “কোনো ধর্মের সঙ্গে এই সিনেমার লেনদেন নেই।”
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে মুক্তি পেয়েছিল ‘আর্টিকেল ৩৭০’। ২০১৯ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। এতে আগেকার অবিভক্ত জম্মু ও কাশ্মির (রাজ্য) হয়ে যায় জম্মু-কাশ্মির (কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল)। আর জম্মু-কাশ্মীরের লাদাখও আলাদা হয়ে হয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল।
মিডিয়া ও অধিকারগোষ্ঠী মোদী সরকারের ওই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধীতা করেছিল সেসময়। আর সিনেমা সমালোচকরা বলছেন, এতে তথ্য বিকৃত করে পরিবেশন করা হয়েছে যেন মনে হয় ওই সময় সরকারের এই সিদ্ধান্ত অপরিহার্য ছিল।
মোদীর মেয়াদে ২০১৯ সালেও ভোটের মৌসুমে সিনেমা হয়েছিল সরকারি রণকৌশল। ওইবার মোদীর জীবনী নিয়ে সিনেমা হয়েছিল; যদিও তা পরে আটকে যায়।
ভারতের সেন্সর বোর্ড যথেষ্ট কড়া; তারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, অশ্লীলতা অথবা অনৈতিক কারণ দেখিয়ে প্রেক্ষাগৃহ থেকে সিনেমা নামিয়েও দিতে পারে।
বলিউড আজকাল হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের মুখে পড়ছে; বিশেষ করে যদি সিনেমায় সরকারের সমালোচনা থাকে অথবা হিন্দু-মুসলমান ঐক্য দেখানো হয়। ধর্মীয় সংগঠন থেকে ভারতের বিনোদন দুনিয়া আজকাল প্রায়ই চোখ রাঙানি দেখছেন। আর এতে করে নির্মাতারা নিজেরাই নিজেদের উপর নিয়ন্ত্রণ বসাচ্ছেন।
২০২০ সালে তোপের মুখে পড়েছিল নেটফ্লিক্সের ‘আ সুইটেবল বয়’। এতে এক হিন্দু তরুণীকে মন্দিরে চুম্বন করেছিল এক মুসলমান পুরুষ। ২০২১ সালে অ্যামাজনে এসেছিল ‘তাণ্ডব’। এতে কিছু হিন্দু দেবতাদের প্রতিকৃতি দেখানো হয়েছিল। নেটফ্লিক্সে ‘অন্যপূরানি: দ্য গডেস অব ফুড’ আসে এই বছর। এই সিনেমায় উচ্চ গোত্রের হিন্দু নারী শেফ হতে গিয়ে মাংস রান্না করে ও খায়।
এসব ক্ষেত্রেই নির্মাতারা উগ্রপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও রাজনীতিকদের বয়কটের শিকার হয়েছিল। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। পরে ‘অন্নপূরানি’ সরিয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা হিসাবে নেটফ্লিক্স বলেছিল, “লাইসেন্স প্রদানকারীদের অনুরোধে এমনটি করা হয়েছে।”
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মধ্য-পূর্ব, দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক দেবশ্রী মুখার্জী বলেন, “ঔপনিবেশিক আমল থেকেই সিনেমার পটভূমি ও ধর্মীয় দিক থেকে অসহিষ্ণুতা দেখানোর উদাহরণ রয়েছে।”
তবে এখন শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে এই প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ থাকছে না।
“বরং সংঘবদ্ধভাবে ক্ষমতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংখ্যালঘুদের একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।”
তানুল ঠাকুর এবং সুদীপ্ত সেন দুজনেই বলছেন, চড়া মূল্য দিতে হবে ভেবে অধিকাংশ সিনেমা নির্মাতা ও শিল্পীরা এখন কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না।
সিনেমা বানানো অনেক খরচের কাজ। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে দেবে বা কর্তৃপক্ষ সেন্সর করে দেবে এমন সিনেমা বানানোর জন্য নির্মাতাদের হাতে খুব বেশি পয়সা নেই – বিশেষ করে যারা স্বাধীনভাবে কাজ করেন; এ কথা বললেন জয়পুর ও মুম্বাই ভিত্তিক স্ক্রিনরাইটার দারাব ফারুকি।
ভারতের আইনে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে’ আঘাত দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ; এতে তিন বছরের জেল আর জরিমানা হতে পারে।
ফারুকি বললেন, “উগ্রপন্থিরা এসব নিয়ে প্রকাশনা করবে, চরিত্র হনন করবে।
“একবার ভাবুন আপনার কলেজে পড়া একটি মেয়ে আছে, তার বন্ধুরা তাকে বলে বসলো, তোমার বাবার সমস্যা কী? তোমার বাবা কি দেশদ্রোহী হয়ে গেছে না কি? আপনার সন্তান এসবের মধ্যে দিয়ে যাক তা আপনি কখনই চাইবেন না।”
এমনকি বলিউডের রথি-মহারথিরাও ছাড় পায়নি। মুসলমান তারকা আমির খানকে দুটো ব্র্যান্ড তাদের অ্যাম্বাসেডর হওয়ার চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে। এরমধ্যে সরকারের ট্যুরিজম বিভাগও ছিল। ২০১৫ সালে সংবাদমাধ্যমে এই খবর বেরিয়েছিল।
ভারতের সিনে পাড়ায় “আগে যারা খোলাখুলি ভাবে কথা বলতেন … তাদের অনেকেই কিন্তু চুপ হয়ে গেছেন”, বললেন ফারুকি।
এই প্রতিবেদন করতে গিয়ে সিএনএন অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিল; যাদের অনেকেই এসব নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মুখার্জী জানালেন, আগের বলিউডে অন্তত এই ধরনের টানাপড়েন ছিল না। আগেকার নির্মাতা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়া নিয়ে অনুপ্রাণিত ছিলেন। দেশভাগের সময় মুসলমানরা পাকিস্তান চলে যান এবং হিন্দু শিখ জনগোষ্ঠী ভারতে। এই ভাগাভাগির দুর্দশা ও ধর্মীয় সংঘাতের বিপরীতে ভারতের সংবিধানের ধর্ম নিরপেক্ষ শপথ নিয়ে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু – এসব ছিল বলিউড সিনেমার পটভূমি। পঞ্চাশের দশকে বলিউড সিনেমা ছিল হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃত্ব নিয়ে।
ওই যুগে ইয়াশ চোপড়ার সিনেমায় হিন্দু ও মুসলমানের প্রেম হতো; যা সমাজ ও ধর্মের রক্ষণশীলতার বিপরীতে গিয়ে বার্তা হিসেবে কাজ করত।
অবশ্য বলিউড যে সব সময় সম্প্রীতির কথা বলেছে তা নয়। দশকের পর দশক ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের পটভূমিতে দেশপ্রেমের সিনেমা হয়েছে। তাতে ভিলেন চরিত্র ছিল মুসলমান বা পাকিস্তানি। এসব আসলে দিল্লির পররাষ্ট্র নীতির প্রতিচ্ছবি ছিল।
পরিচালক রাজা সেনের দৃষ্টিতে, যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলা পর পশ্চিমে ইসলামোফোবিয়ার ধাক্কা হিন্দি সিনেমাতেও লেগেছিল। এই সময় অনেক বলিউড নির্মাতা ভিলেন চরিত্রকে মুসলমান দেখাতেন।
ভারতের দুই হাজার বছরের সমাজে জন্মগতভাবে যে শ্রেণি বিভেদ করা হতো তা ১৯৫০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হলেও এখনও চিন্তাভাবনায় বিদ্যমান। এক সময় বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে সিনেমার জন্য কর মওকুফ করে দিতো সরকার থেকে।
আজকের পরিস্থিতির পেছনে সেসব দিনও রয়েছে বলতে চান সাংবাদিক ঠাকুর।
“সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া সিনেমাগুলো জাতীয় পর্যায়ে কথা বলতো, যেন সবাই একতাবদ্ধ হতে পারে।”
উগ্রপন্থিদের হাতপা ঝেড়ে ওঠার প্রভাব ভারতের সৃজনশীল চর্চায় পড়েছে, বললেন সেন।
“নাট্যশালাগুলো শিক্ষার্থীরা কী দেখবে বা বানাবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। কমেডিয়ানকে হাজতে নেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য।”
মোদী সরকারের আমলে সাংবাদিকরাও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
“গত তিন-চার বছরে, শিল্পচর্চায় ভাঙ্গন দেখতে পাচ্ছি আমরা। আমাদের এমনিতেই অনেক রক্ষণশীলতা আছে, কিন্তু এখন সুনির্দিষ্ট তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি … আপনি সরকার বিরোধী হতে পারবেন না।”
বলিউডের এই সংকোচনে স্বাধীন নির্মাতারা আঞ্চলিক সিনেপাড়ায় চলে যাচ্ছে। মুম্বাই থেকে দূরে আঞ্চলিক ভাষায় সিনেমা বানাতে আগ্রহী হচ্ছে তারা। এসব সিনেমার বাজারও বেশ ভালো। দক্ষিণী সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি গত কয়েক বছর ধরে দ্বিগুণ পসার করছে। ২০২৩ সালের এক পরিসংখ্যানে তাই দেখা যায়।
দক্ষিণী সিনেমায় অনেক জোরালো গল্প নিয়েও কাজ করার সুযোগ রয়েছে; বিশেষ করে যেসব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় নেই।
তামিল ও মালয়ালাম সিনেমা হলো দক্ষিণের তামিল নাড়ু ও কেরালা রাজ্যের। আর এখানে বিজেপি শাসন চলে না।
“এদিকের সিনেমা তুলনামূলকভাবে ভালো করছে। এরা তির্যক কাহিনী নিয়েও সিনেমা বানাচ্ছে”, বললেন ফারুকি।
“এর কারণ তাদের রাজনৈতিক সুরক্ষা বলয় রয়েছে। তারা তাদের সরকারের অধীনেই আছে। আসলে সরকারের ছত্রচ্ছায়া ছাড়া আপনি কখনই দারুণ কোনো শিল্প করতে পারবেন না।”
পরের পাঁচ বছরেও মোদী ও বিজেপি সরকার গঠন করবে এমন সম্ভাবনা অনেক পরিচালককে বলিউড বিমুখ করছে।
সেন বললেন, “আমার মনে হয় আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে আছি, যদি এই সরকার আবারও ক্ষমতায় আসে তাহলে শিল্পচর্চায় দমন-পীড়ন আরও বেড়ে যাবে।”



